বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড : বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক রাজনীতির উত্থান
বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত অসাম্প্রদায়িকতা, সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায় বিচার বাংলাদেশের এইসব মৌলিক আদর্শ হত্যা করার জন্যই কী ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যা করা হয়েছিল?
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের পরদিন সকালে রেডিও-তে মেজর ডালিম ঘোষণা দিয়েছিলেন যে, খন্দকার মোশতাক আহমদের নেতৃত্বে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী ক্ষমতা দখল করেছে এবং সামরিক আইন জারি করা হয়েছে। এরপরেই তিনি বলেছিলেন যে, বাংলাদেশ এখন থেকে ইসলামী প্রজাতন্ত্র। এই বক্তব্যটি কী যথেষ্ট মাত্রায় ইঙ্গিত দেয় না যে, রাষ্ট্র গঠনে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে ৩০ লাখ শহীদ আত্মত্যাগ করেছিল সেই রাষ্ট্রকে তারা কোন পথে নিয়ে যাওয়ার জন্য হত্যাকাণ্ডটি ঘটিয়েছিল?
বিজ্ঞাপন
এই প্রশ্নের উত্তরের জন্য বঙ্গবন্ধুর ত্যাগী ও সংগ্রামী জীবনের কাহিনি উপলব্ধি করার পাশাপাশি বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাস এবং বঙ্গবন্ধু হত্যা পরবর্তী পরিস্থিতির দিকে লক্ষ্য করতে হবে। একই সাথে শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করতে হবে মানুষের জন্য জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর অনুভূতি, বাঙালিদের স্বাধীনতা ও মুক্তির জন্য তার আন্তরিকতাপূর্ণ প্রতিশ্রুতি ও আত্মত্যাগ এবং সর্বোপরি একটি অসাম্প্রদায়িক দেশ হিসেবে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের জন্য তার দৃঢ়চেতা, সংগ্রামী, ঐতিহাসিক ও অনন্য সাধারণ অবদানের কথা।
বঙ্গবন্ধুর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ থেকে আমরা জানতে পারি, মানুষ হিসেবে সমগ্র মানবজাতি নিয়ে বঙ্গবন্ধু ভাবতেন। একজন বাঙালি হিসেবে যা কিছু বাঙালিদের সঙ্গে সম্পর্কিত তাই তাকে গভীরভাবে ভাবিয়েছে। আর এই নিরন্তর সম্পৃক্তির উৎস হচ্ছে ভালোবাসা, অক্ষয় ভালোবাসা, যে ভালোবাসা তার রাজনীতি এবং অস্তিত্বকে অর্থবহ করে তুলেছে।
বঙ্গবন্ধু প্রথমে বাঙালি, তারপরে মানুষ এবং তারপরে মুসলমান হিসেবে তার পরিচয় তুলে ধরেছেন। তার ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ গ্রন্থের ৭৮ পৃষ্ঠায় বঙ্গবন্ধু “মিশন উইথ মাউন্টব্যাটেন” শীর্ষক একটি বইয়ের কথা বলেছেন। ১৯৫১ সালে প্রকাশিত এই বইটি লিখেছিলেন ব্রিটিশ ভারতের শেষ গভর্নর জেনারেল লর্ড মাউন্টব্যাটেনের প্রেস অ্যাটাশে, ব্রিটেনের লিবারেল পার্টির রাজনীতিক এবং সাংবাদিক অ্যালান-ক্যাম্পবেল জনসন (১৯১৩-১৯৯৮)।
জনসন এই বইটির মুখবন্ধে বলছেন, ‘লর্ড মাউন্টব্যাটেনের সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব হচ্ছে সম্ভবত একটি সমাধান বের করা, আসন্ন বৈপ্লবিক সংকটের ঝড়ে টিকে থাকার যথেষ্ট সারবত্তা ও আনুকূল্য যার মধ্যে নিহিত আছে এবং দেশভাগ হওয়া সত্ত্বেও অতীত ও ভবিষ্যতের মধ্যে যা গুরুত্বপূর্ণ সংযোগ বজায় রাখবে।’
বঙ্গবন্ধুর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ থেকে আমরা জানতে পারি, মানুষ হিসেবে সমগ্র মানবজাতি নিয়ে বঙ্গবন্ধু ভাবতেন। একজন বাঙালি হিসেবে যা কিছু বাঙালিদের সঙ্গে সম্পর্কিত তাই তাকে গভীরভাবে ভাবিয়েছে।
ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের যুগ অবসানের ৭৪ বছর, পাকিস্তানের ধর্মীয় ঔপনিবেশিক শোষণ অবসানের ৫০ বছর এবং বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের ৪৬ বছর পর বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক রাজনীতির উত্থান ও বর্তমান পরিস্থিতি অনুধাবনের জন্য ‘অতীত ও ভবিষ্যতের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ’ সংযোগ স্থাপনকারী বিষয়গুলোর দিকে আমাদের নজর দেওয়া প্রয়োজন।
আমাদের জীবদ্দশায় দেখা বিশ্বের নিপীড়িত মানুষের সর্বজনস্বীকৃত নেতা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কর্মকাণ্ড বা বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে সমসাময়িক কালে বিভিন্ন গবেষক ও বিশ্লেষকের লেখাগুলো এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ উৎস হিসেবে গৃহীত। তবে, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রচেষ্টায় বঙ্গবন্ধুর লেখা ডায়েরি থেকে ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’, ‘কারাগারের রোজনামচা’, ‘আমার দেখা নয়াচীন’ প্রভৃতি গ্রন্থ প্রকাশ।
সর্বশেষ, পাকিস্তানের গোয়েন্দারা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সম্বন্ধে সুদীর্ঘ ২৪ বছর ধরে যেসব গোপন রিপোর্ট দিয়েছিল সেইসব রিপোর্ট মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রচেষ্টায় ‘সিক্রেট ডকুমেন্টস অব ইন্টেলিজেন্স ব্রাঞ্চ অন ফাদার অব দ্য নেশন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান’ শিরোনামে হাক্কানি পাবলিশার্স এবং পরে বিশ্বখ্যাত প্রকাশনা সংস্থা রুটলেজ কর্তৃক প্রকাশিত হওয়ার কারণে অনেক অজানা তথ্য জনসমক্ষে প্রকাশিত হয়েছে এবং তা আমরা জানতে পারছি।
স্বপ্নের স্বদেশ বাংলাদেশ স্বাধীন করার পর, এই দেশটিতে মাত্র সাড়ে তিন বছর বা ‘এক হাজার তিনশ চৌদ্দ দিন রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় থেকে বাঙালি জাতিকে একটি মর্যাদাপূর্ণ জাতিতে পরিণত করেছিলেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান’ (রায় ২০২১, ৮১)।
‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ পাঠে জানা যায় ১৯৩৬ সালের দিকে বঙ্গবন্ধু যখন মাদারীপুর ছিলেন তখন তার চোখের চিকিৎসার জন্য পড়ালেখা বন্ধ ছিল। এসময় তিনি নেতাজী সুভাষ বোসের ভক্ত হতে শুরু করেছিলেন। তিনি স্বদেশী আন্দোলনকারীদের সাথেই মেলামেশা করতেন (পৃ: ৯)।
বঙ্গবন্ধুর জীবনে ১৯৩৮ সালে প্রথম জেল খেটেছিলেন ৭ দিন। যে মামলায় তিনি জেল খেটে ছিলেন সেটি হিন্দুরা দিয়েছিল। কিন্তু ঘটনার বিবরণ থেকে উপলব্ধি করা যায় মামলার বাদী-বিবাদী সবাই পরস্পরের খুব ঘনিষ্ঠ ছিলেন, ভিন্ন ভিন্ন ধর্মাবলম্বী হওয়া সত্ত্বেও। এ ঘটনায় হক সাহেব ও সোহরাওয়ার্দী সাহেবকে টেলিগ্রাম করা হয়েছিল। কলকাতায়ও লোক চলে গিয়েছিল। কিন্তু বাইরের কোনো হস্তক্ষেপ ছাড়াই শেষ পর্যন্ত নিজেদের মধ্যে আলাপ আলোচনার মাধ্যমে বিষয়টি মীমাংসা হয় এবং মামলা না চালানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল (পৃ: ১৩)।
বঙ্গবন্ধু বলেছেন, ‘...আমি মানুষকে মানুষ হিসেবেই দেখি। রাজনীতিতে আমার কাছে মুসলমান, হিন্দু ও খ্রিষ্টান বলে কিছু নাই। সকলেই মানুষ’
১৯৪৩ সালের দুর্ভিক্ষের সময় তিনি ইসলামিয়া কলেজের বেকার হোস্টেলের আবাসিক ছাত্র। ‘হোস্টেলে যা বাঁচে দুপুরে ও রাতে বুভুক্ষুদের বসিয়ে ভাগ করে দেন’ (পৃ: ১৮)।
হিন্দু নেতা শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জীর সাথে মিলে মন্ত্রিসভা গঠন সত্ত্বেও শেরে বাংলা এ. কে. ফজলুল হকের প্রতি বঙ্গবন্ধুর পিতা ও অন্যান্য গ্রামবাসীর প্রবল সমর্থনের কথা জানা যায় (পৃ: ২১-২২)। নিঃস্বার্থ স্বাধীনতা সংগ্রামী ও ত্যাগী যেসব নেতা ইংরেজকে তাড়াবার আন্দোলন করেছেন তাদের প্রতি বঙ্গবন্ধুর ছিল গভীর শ্রদ্ধাবোধ। তবে, তিনি ‘হিন্দু ও মুসলমানদের মিলনের চেষ্টা’র ঘাটতির কারণে এই দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে তিক্ততা বৃদ্ধির বিষয়টি লক্ষ্য করেছেন। বঙ্গবন্ধু বলেছেন, ‘হিন্দু নেতাদের মধ্যে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ এবং নেতাজী সুভাষ বসু এ ব্যাপারটি বুঝেছিলেন. . . । একথাও সত্য, মুসলমান জমিদার ও তালুকদাররা হিন্দু প্রজাদের সঙ্গে একই রকম খারাপ ব্যবহার করত...’ (পৃ: ২৪)।
আবার ৩৭ পৃষ্ঠায় বঙ্গবন্ধু বলছেন, ‘ ইসলামিয়া কলেজে গরিব ছেলেদের সাহায্য করবার জন্য একটা ফান্ড ছিল। সেই ফান্ড দেখাশোনা করার ভার ছিল বিজ্ঞানের শিক্ষক নারায়ণ বাবুর। তিনি যদিও জানতেন, বঙ্গবন্ধু প্রায় সকল সময়ই ‘পাকিস্তান’. ‘পাকিস্তান’ করে বেড়াতেন। তবু নারায়ণ বাবু বঙ্গবন্ধুকে স্নেহ করতেন। ইসলামিয়া কলেজের সকল ছাত্রই মুসলমান।
একজন হিন্দু শিক্ষককে সকলে এই কাজের ভার দিত কেন? বঙ্গবন্ধু বলেছেন, ‘কারণ, তিনি সত্যিকারের একজন শিক্ষক ছিলেন। হিন্দুও না, মুসলমানও না। যে টাকা ছাত্রদের কাছ থেকে উঠত এবং সরকার যা দিত, তা ছাড়াও তিনি অনেক দানশীল হিন্দু-মুসলমানদের কাছ থেকে চাঁদা তুলে জমা করতেন এবং ছাত্রদের সাহায্য করতেন।’
বঙ্গবন্ধু বলেছেন ‘এই রকম সহানুভূতি পরায়ণ শিক্ষক আমার চোখে খুব কমই পড়েছে’ (পৃ: ৩৭-৩৮)। বঙ্গবন্ধুর শৈশব, কৈশোর ও যৌবনের শিক্ষা তথা তার ত্যাগী ও সংগ্রামী জীবনের ঘটনা পর্যালোচনা করে অসাম্প্রদায়িকতার প্রতি বঙ্গবন্ধুর আন্তরিকতাপূর্ণ ও দৃঢ় অবস্থান আমরা উপলব্ধি করতে পারি। স্বাভাবিকভাবেই তিনি ১৯৪৬ সালে মুসলিম লীগ আহুত ডাইরেক্ট অ্যাকশন ডে-তে হিন্দু মুসলমানের মধ্যে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ফিরিয়ে আনার জন্য মহাত্মা গান্ধীর সাথে বঙ্গবন্ধু কলকাতার বিভিন্ন স্থানে কাজ করেছেন (পৃ: ৮১)।
আবার দেখা যাচ্ছে, ফরিদপুর জেলে বঙ্গবন্ধুর সাথে ছিলেন মাদারীপুরের ফনিভূষণ মজুমদার এবং গোপালগঞ্জের চন্দ্র ঘোষ (বোস)। চন্দ্র বোসের উদ্দেশ্যে বঙ্গবন্ধু বলেছেন, ‘...আমি মানুষকে মানুষ হিসেবেই দেখি। রাজনীতিতে আমার কাছে মুসলমান, হিন্দু ও খ্রিষ্টান বলে কিছু নাই। সকলেই মানুষ’ (পৃ: ১৯১)।
অন্যান্য নেতাদের সাথে বঙ্গবন্ধুর প্রচেষ্টায় ১৯৪৯ সালে প্রতিষ্ঠিত আওয়ামী মুসলিম লীগ থেকে ১৯৫৫ সালে ‘মুসলিম’শব্দটি বাদ দিয়ে ‘আওয়ামী লীগ’ করা হয়। এভাবে বঙ্গবন্ধু ধর্মের ভিত্তিতে সৃষ্ট পাকিস্তানের বিরুদ্ধে, ভাষাভিত্তিক অসাম্প্রদায়িক বাঙালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছেন। ফলে, ১৯৪৮ ও ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের পর ১৯৫৪ সালে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে সাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক দল মুসলিম লীগ বাংলাদেশে অস্তিত্বহীন হয়ে পড়ে।
এরপর ১৯৬২ সালের শিক্ষা আন্দোলন, ১৯৬৬ সালের ৬ দফা আন্দোলন, ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার প্রধান আসামি শেখ মুজিব জেল থেকে মুক্তি পাওয়ার পর বাংলার জনগণের পক্ষ থেকে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিতে ভূষিত হয়েছিলেন।
অনুষ্ঠানে বঙ্গবন্ধু স্মরণ করিয়ে দিয়েছিলেন, ... একমাত্র কুমিল্লার শ্রী ধীরেন্দ্রনাথ দত্তই উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার প্রতিবাদ করেন এবং উর্দুর সাথে বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবি জানান। কোনো বাঙালি মুসলমান প্রতিবাদ করেননি।
চূড়ান্ত পর্যায়ে ১৯৭০ সালের নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। ১৯৭১ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারিতে বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে আয়োজিত ভাষা আন্দোলনের স্মরণ সপ্তাহের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বঙ্গবন্ধু স্মরণ করিয়ে দিয়েছিলেন, ‘রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি নয়, মূল শুরু হয়েছিল ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ। এই দিনই বাংলা ভাষার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করে করাচিতে অনুষ্ঠিত জাতীয় পরিষদের অধিবেশনে উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার জন্য প্রস্তাব উত্থাপন করা হয়। একমাত্র কুমিল্লার ধীরেন্দ্রনাথ দত্তই উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার প্রতিবাদ করেন এবং উর্দুর সাথে বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবি জানান। কোনো বাঙালি মুসলমান প্রতিবাদ করেননি। এটা লজ্জাজনক ইতিহাস।’ ভাষা আন্দোলনের রক্ত পিচ্ছিল পথ ধরে, স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে আন্দোলনের পরিণতিতে চূড়ান্ত পর্যায়ে স্বাধীনতা যুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে আমরা বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে উপনীত হয়েছি। তাই রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন শুধু ভাষার আন্দোলনই ছিল না; বাঙালির অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক তথা সার্বিক স্বাধিকার প্রতিষ্ঠার প্রশ্ন এর সাথে জড়িত (রায় ২০২১, ৮২)।
১৯৭১ সালের ৭ মার্চ ও ২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ডাকে সমগ্র বাংলাদেশে পাকিস্তানের হানাদার দখলদার বাহিনীর বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়। দীর্ঘ ৯ মাস রক্তাক্ত যুদ্ধ শেষে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশ শত্রু মুক্ত হয়।
১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পর ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বিশাল জনসমুদ্রে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘আমি স্পষ্ট ভাষায় বলে দিতে চাই যে, বাংলাদেশ একটি আদর্শ রাষ্ট্র হবে। আর তার ভিত্তি বিশেষ কোনো ধর্মভিত্তিক হবে না। রাষ্ট্রের ভিত্তি হবে গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা। এদেশের কৃষক-শ্রমিক, হিন্দু-মুসলমান সুখে থাকবে, শান্তিতে থাকবে’ (পৃ: ১৬৪)।
স্বাধীনতার পর ধর্মনিরপেক্ষতা, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র এবং জাতীয়তাবাদ রাষ্ট্রীয় নীতি হিসেবে বাংলাদেশের ১৯৭২ সালের সংবিধানে সংযোজিত হয়েছিল। ১৯৭৩ সালের ৫-৯ সেপ্টেম্বর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জোট নিরপেক্ষ আন্দোলনের অধিবেশনে অংশগ্রহণের সময় সৌদি বাদশা ফয়সালের সাথে তার সাক্ষাৎ হয় (মুকুল, ১৯৮৫)।
বঙ্গবন্ধু এসময় বাদশা ফয়সালকে বলেন, ‘এক্সিলেন্সি,আপনি জানেন এই দুনিয়ায় ইন্দোনেশিয়ার পর বাংলাদেশ হচ্ছে দ্বিতীয় বৃহত্তম মুসলিম জনসংখ্যার দেশ। তাই আমি জানতে চাচ্ছি, কেন সৌদি আরব আজ পর্যন্ত স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশের স্বীকৃতি দিচ্ছে না?’
এর উত্তরে বাদশা ফয়সাল বলেন, ‘আমি পরম করুণাময় আল্লাহ তাআলা ছাড়া আর কারো কাছে জবাবদিহি করি না। তবু আপনি একজন মুসলমান, তাই বলছি, সৌদি স্বীকৃতি পেতে হলে বাংলাদেশের নাম পরিবর্তন করে ইসলামিক রিপাবলিক অব বাংলাদেশ করতে হবে।’
তখন বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘এই শর্তটা কিন্তু অন্তত বাংলাদেশের জন্য প্রযোজ্য হতে পারে না। বাংলাদেশের বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ জনসংখ্যা মুসলমান হলেও এ দেশে প্রায় এক কোটির মতো অমুসলিম রয়েছে। সবাই একই সঙ্গে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছে, না হয় দুর্ভোগ পোহায়েছে তা ছাড়া এক্সিলেন্সি, সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে যে, পরম করুণাময় আল্লাহ তাআলা তো শুধু ‘মুসলেমিন’ নন তিনি হচ্ছেন ‘রাব্বুল আলামিন’। তিনি শুধু মুসলমানদের আল্লাহ নন, তিনি হচ্ছেন সব কিছুর একমাত্র অধিকর্তা। তিনিই হচ্ছেন সব কিছুর একমাত্র স্রষ্টা। এক্সিলেন্সি, বেয়াদবি মাফ করবেন। আপনাদের দেশের নামও তো ইসলামী প্রজাতান্ত্রিক সৌদি আরব না। এই মহান দেশের নাম আরব জাহানের অন্যতম শ্রেষ্ঠ মনীষী ও রাজনীতিবিদ মরহুম বাদশাহ ইবনে সউদের সম্মানে ‘কিংডম অব সৌদি অ্যারাবিয়া’। কই আমরা কেউই তো এ নামে আপত্তি করিনি।’
ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বিশাল জনসমুদ্রে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘আমি স্পষ্ট ভাষায় বলে দিতে চাই যে, বাংলাদেশ একটি আদর্শ রাষ্ট্র হবে। আর তার ভিত্তি বিশেষ কোনো ধর্মভিত্তিক হবে না। রাষ্ট্রের ভিত্তি হবে গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা...
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সপরিবারে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার পর নিজেদের গ্রহণযোগ্যতা সৃষ্টির প্রচেষ্টার অংশ হিসেবে সামরিক শাসকেরা রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহার শুরু করে।
আমরা জানি বঙ্গবন্ধু হত্যার পর দেশ থেকে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নাম মুছে ফেলে, বাংলাদেশকে পাকিস্তানীকরণ তথা একটি সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠার জন্য অতীতের সামরিক বেসামরিক সরকারগুলো ও তাদের অনুসারীরা ষড়যন্ত্রমূলক কর্মকাণ্ড অব্যাহত রেখেছে।
অপরদিকে, ১৯৭৫-এ বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর তার সুযোগ্য কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনার বেঁচে থাকার কণ্টকাকীর্ণ পরিস্থিতি, এবং ঘাতক ও তাদের সহযোগী সামরিক ও বেসামরিক সরকার এবং তাদের দোসরদের বিরুদ্ধে জীবনপণ সংগ্রাম করে বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা টিকিয়ে রাখার জন্য ঝুঁকিপূর্ণ পথ পরিক্রমণও অব্যাহত রয়েছে। এপর্যন্ত ২১ বারেরও বেশি হত্যার চেষ্টা থেকে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা স্রষ্টার অসীম কৃপায় এবং বাংলার মানুষের আন্তরিক দোয়া ও আশীর্বাদে বেঁচে গিয়েছেন।
বঙ্গবন্ধুর খুনি দেশদ্রোহী স্বাধীনতা বিরোধীদের কদর্য মুখাবয়ব:
এ এল খতিব এর ‘হু কিলড মুজিব?’ এবং বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার বাদী আ ফ ম মহিতুল ইসলামের বর্ণনা থেকে জানা যায় ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ভোরে বঙ্গবন্ধুর খুনিরা কি নিষ্ঠুর পৈশাচিকতার মধ্য দিয়ে বঙ্গবন্ধু এবং তার পরিবারের সবাইকে হত্যা করেছিল।
মুক্তিযুদ্ধের পরাজিত পাকিস্তানি শক্তি ও তাদের দেশীয় ও আন্তর্জাতিক শক্তির যৌথ ষড়যন্ত্রের ফলে বঙ্গবন্ধু হত্যার পর বাঙালি জাতীয়তাবাদের পরিবর্তে ভিন্ন ধরনের এক জাতীয়তাবাদের আমদানি করা হয় যা স্পষ্টত ধর্মভিত্তিক দ্বি-জাতি তত্ত্বে প্রত্যাবর্তনের বিপজ্জনক ইঙ্গিত দেয়। সংবিধান পরিবর্তনের ফলে বাংলাদেশের বাঙালিদের পরিচিতির ক্ষেত্রেও পরিবর্তনের সূচনা হয়।
১৯৭৬ সালের নভেম্বরে জিয়াউর রহমান বাংলাদেশের সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনী করে। এর দ্বারা সংবিধানের ১২ নং অনুচ্ছেদ অপসারণ করা হয়। এই অনুচ্ছেদ দ্বারা সকল ধরনের সাম্প্রদায়িকতা, ধর্মীয় পক্ষপাতিত্ব অথবা রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ধর্ম বৈষম্য ও ধর্মের অপব্যবহার বিলোপ সাধন করে ধর্মনিরপেক্ষতা বাস্তবায়নের পথ সুগম করার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। সংবিধানের শুরুতে মুখবন্ধের আগে ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম’ সংযুক্ত করা হয়।
১৯৭৭ সালের মে মাসে, সংবিধানের ৩৮ নম্বর অনুচ্ছেদ প্রত্যাহার করা হয়। এর ফলে, ধর্মের ভিত্তিতে রাজনৈতিক দল গঠন করার পথ সুগম হয়। সংবিধানের ২৫ নং অনুচ্ছেদ-এর সাথে একটি নতুন উপ-অনুচ্ছেদ যুক্ত করা হয়। যেখানে ‘ইসলামী সংহতির ভিত্তিতে মুসলিম রাষ্ট্রগুলোর সাথে ভ্রাতৃত্বের সম্পর্ক স্থাপনের কথা বলা হয়।’ পরবর্তীকালে, ১৯৮৮ সালের ৭/৯ জুন এরশাদের শাসনামলে ‘ইসলাম’-কে রাষ্ট্রধর্ম ঘোষণা করা হয়।
আমরা দেখতে পাচ্ছি জমি ও বসতবাড়ি থেকে সংখ্যালঘুদের উচ্ছেদের জন্য যখন তখন আক্রমণ করা হয়। দেশে যখনই কোনো রাজনৈতিক সংকট শুরু হয়, তখন হামলা-নিপীড়নের টার্গেট করা হয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়...
২০১০ সালের সংবিধান সংশোধনীর মাধ্যমে ধর্মীয় রাজনৈতিক দলগুলোর উপর বিধি-নিষেধ আরোপ করা হয়। কিন্তু ২০১১ সালের জুন-জুলাই’তে জাতীয় সংসদে পাসকৃত পঞ্চদশ সংশোধনী দ্বারা এটিকে পুনরায় ফিরিয়ে আনা হয়। এছাড়া, রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে ‘ইসলাম’-কে বহাল রাখা হয়, যদিও সংবিধানে ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ পুনরায় সংযোজিত হয়েছে।
সাম্প্রদায়িক শক্তির উত্থান:
বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর থেকে সংবিধান পরিবর্তন করে বাংলাদেশকে ধর্মীয় রাষ্ট্রে পরিণত করা হয়। এই উদ্দেশ্যে সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় মূলনীতি থেকে ধর্মনিরপেক্ষতা বাদ দেওয়া হয়েছিল এবং সংবিধানের শুরুতে ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম’ সংযোজিত করেছিল।
আর অষ্টম সংশোধনীর মাধ্যমে সংযোজিত করেছিল ‘ইসলাম’কে রাষ্ট্রধর্ম। সেই সঙ্গে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার থামানো এবং একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ ও মানবতা বিরোধী অপরাধের দায়ে অভিযুক্ত জামায়াতে ইসলামী রাজনীতি করার সুযোগ পায় সামরিক শাসক জিয়াউর রহমানের বদান্যতায়। যা দ্বিতীয় সামরিক শাসক এইচ এম এরশাদ অব্যাহত রেখেছিল।
১৯৯০ সালের স্বৈরতন্ত্র বিরোধী আন্দোলনের পর ১৯৯৬ সাল থেকে ২০০১ এবং ২০০৯ থেকে অদ্যাবধি রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বে থাকা অবস্থায় বঙ্গবন্ধু কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা অনুযায়ী দেশ পরিচালনার ক্ষেত্রে অনেক মৌলিক পরিবর্তন সাধিত হয়েছে।
খুনিদের করা ইনডেমনিটি আইন বাতিল করে বঙ্গবন্ধুর খুনিদের বিচার হয়েছে। একাত্তরের গণহত্যা ও মানবতা বিরোধীদের বিচারের জন্য আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠিত হওয়ার পর বিচারকার্য চলমান আছে। অবকাঠামো ও আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের দিক দিয়ে বাংলাদেশ দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে। দারিদ্র্য হ্রাস পাচ্ছে।
সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে ১৯৭২ এর সংবিধানে দেশ ফিরে আসার কারণে হিন্দু, বৌদ্ধ ও খ্রিষ্টান ধর্মীয় সম্প্রদায় তথা ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘুদের মনে কিছুটা আস্থা ফিরে আসার পরিস্থিতির উদ্ভব হলেও সংখ্যাগরিষ্ঠ ধর্মাবলম্বীদের ধর্মকে রাষ্ট্র ধর্ম হিসেবে সংবিধানে অব্যাহতভাবে সংযোজিত থাকার কারণে তা অস্বস্তি বাড়িয়েছে এই কারণে যে এর ফলে সাম্প্রদায়িক শক্তি উসকানি পাচ্ছে।
আমরা দেখতে পাচ্ছি জমি ও বসতবাড়ি থেকে সংখ্যালঘুদের উচ্ছেদের জন্য যখন তখন আক্রমণ করা হয়। দেশে যখনই কোনো রাজনৈতিক সংকট শুরু হয়, তখন হামলা-নিপীড়নের টার্গেট করা হয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায় এবং বিশেষভাবে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের।
১৯৯০ সালের শেষ দিকে সেনা শাসক এইচ এম এরশাদকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দিতে প্রবল গণআন্দোলন শুরু হয়। সে সময়ে ভারতের বাবরি মসজিদ কাণ্ডকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশের অসংখ্য মন্দির ও মঠ আক্রান্ত হয়। সংখ্যালঘুরা শারীরিকভাবে হামলার শিকার হয়।
অনেককে দেশত্যাগে বাধ্য করার মতো অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতির সৃষ্টি করা হয়। একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটে ১৯৯২ সালে। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর যাবতীয় দুষ্কর্মের সহযোগী দল জামায়াতে ইসলামীর সমর্থনে ক্ষমতায় আসীন বেগম খালেদা জিয়ার দল বিএনপির শাসনামলে।
২০০১ সালের অক্টোবরের নির্বাচনের আগে ও পরে তারা আরও নারকীয় বর্বরতায় মেতে ওঠে সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে। রাষ্ট্রীয় ও রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতায় সংগঠিত অপরাধ ফের মাত্রা ছাড়ায়। ১৯৭১ সালের মতো হাজারে হাজারে প্রাণে মেরে ফেলার ঘটনা ঘটেনি, কিন্তু নির্যাতন, ধর্ষণ ও লুটপাট চলতেই থাকে।
ভয়-ভীতি প্রদর্শন করে ভিটেমাটি থেকে উচ্ছেদের নতুন ব্লু-প্রিন্ট বাস্তবায়ন শুরু হয়। ২০১২, ২০১৩ ও ২০১৪ সালের পর এবং সাম্প্রতিককালে দেশের বিভিন্ন স্থানে এরই ভয়ঙ্কর রূপ আমরা প্রত্যক্ষ করি।
১৯৭১ সালের যুদ্ধাপরাধ ও মানবতা বিরোধী অপরাধের বিচার কাজের প্রতিক্রিয়াতেও আমরা দেখি ব্যাপকভাবে সাম্প্রদায়িক সহিংসতার উসকানি প্রদানের ঘটনা। সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর প্রতি অতীতের অন্যায় আচরণের সঙ্গে সাম্প্রতিক সময়ে সংঘটিত ঘটনাবলীতে পার্থক্য লক্ষণীয়—এখন রাষ্ট্র থেকে সাম্প্রদায়িকতাকে প্রশ্রয় দেওয়া হয় না। কিন্তু ষাটের দশকে এ ভূখণ্ডের রাজনৈতিক ও সামাজিক শক্তি আইয়ুব-মোনায়েমের সাম্প্রদায়িক ভেদ বুদ্ধির নীতি ও অপকৌশলের বিরুদ্ধে যেভাবে রুখে দাঁড়িয়েছিল, এখন তা যেন কেবলই অতীতের বিষয়।
বঙ্গবন্ধু হত্যা পরবর্তীকালে বেসামরিক ও সামরিক শাসকগণ অগণতান্ত্রিকভাবে অধ্যাদেশের মাধ্যমে সংবিধান থেকে ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্র বাদ দেয়।
প্রশাসন, রাষ্ট্র এবং অনেক ক্ষেত্রে সমাজের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি ও গোষ্ঠী সাম্প্রদায়িক অপরাধ ও অন্যায় প্রতিকারে আন্তরিক প্রচেষ্টা গ্রহণে উদ্যোগী হয় না। প্রধান প্রধান রাজনৈতিক শক্তি সাম্প্রদায়িকতাকে গণতান্ত্রিক চেতনার পরিপন্থী মনে করে শুধু বক্তৃতা বিবৃতির মধ্যে সীমিত না থেকে সাম্প্রদায়িক আক্রমণ প্রতিরোধে সক্রিয় ভূমিকা পালন আমরা আশা করি।
জঙ্গিবাদের উত্থান:
১৯৭১ সালে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ধর্মভিত্তিক এই দলটি পাকিস্তানের পক্ষে সক্রিয় থেকে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করে বাঙালিদের হত্যা করেছে এবং হত্যার সহযোগিতা করাসহ বিভিন্ন মানবতাবিরোধী কর্মকাণ্ডে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেছে। আর একটি ইসলামী গোষ্ঠী হচ্ছে মাওলানা সাঈদুর রহমান কর্তৃক উৎসাহিত জেএমবি। এই মর্মে রিপোর্ট আছে যে, জেএমবি দিনাজপুরে সাতটি বোমা বিস্ফোরণের জন্য দায়ী।
তারা মাদ্রাসার মাধ্যমে কর্মকাণ্ড পরিচালনা করে থাকে। আর এইসব মাদ্রাসা থেকে সমাজের দরিদ্র শ্রেণি থেকে তারা তাদের দলে ভিড়িয়ে থাকে। এটি জানা যায় যে, বাংলাদেশসহ মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশগুলো থেকে জঙ্গিরা এবং তাদের সহযোগীরা ওসামা বিন লাদেন-এর সহযোগী ছিল।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে বিশ্বব্যাপী জঙ্গি বিরোধী অভিযানে ৮০ জনেরও বেশি জঙ্গি ধরা পড়েছিল। এইসব দেশগুলোর মধ্যে আছে তাঞ্জানিয়া, কেনিয়া, সুদান এবং ইয়েমেন থেকে পাকিস্তান, বাংলাদেশ, মালয়েশিয়া এবং ফিলিপাইন। অতিসম্প্রতি পাকিস্তানের ক্রিকেটার শোয়েব আক্তার সামা টিভি-তে প্রচারিত এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ‘ইট ইজ রিটেন ইন আওয়ার স্ক্রিপচারস্ দ্যাট গাজওয়া-ই-হিন্দ উইল টেইক প্লেস।’
পর্যবেক্ষকগণ বলছেন, ‘দিজ রাইটিংস পোরট্রে সাউথ এশিয়া অ্যাজ দ্যা ব্যাটল ফিল্ড।’ গোয়েন্দা এজেন্সিগুলোর সূত্র উল্লেখ করে গণমাধ্যম কর্তৃক পরিবেশিত সংবাদ থেকে জানা যাচ্ছে, গাজওয়া-ই-হিন্দ এর লক্ষ্যে উপমহাদেশের জঙ্গিদের সাথে বাংলাদেশের জঙ্গিরাও একত্রে কাজ করছে।
জঙ্গিবাদের উত্থান বাংলাদেশের সাম্প্রদায়িক শক্তির সহায়ক একটি শক্তিশালী লক্ষণ। আফগানিস্তানের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় সম্প্রতি তালেবান অধিষ্ঠিত হওয়ার কারণে পরিস্থিতির আরও অবনতির আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের পরিস্থিতি:
সরকারি আদমশুমারি অনুসারে ১৯৪১ সালে মোট জনসংখ্যার শতকরা ২৮.৩ ভাগ ছিল ধর্মীয় সংখ্যালঘু। এর মধ্যে ১১.৮৮ মিলিয়ন হিন্দু এবং বৌদ্ধ, খ্রিস্টান ও এনিমিস্ট প্রভৃতি সংখ্যালঘু ধর্মীয় জনগোষ্ঠীর সংখ্যা ছিল ৫৮৮ হাজার জন।
১৯৯১ সালের আদমশুমারি অনুসারে বাংলাদেশে মুসলমানদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা বৃদ্ধি পেয়েছে শতকরা ২১৯.৫ ভাগ, যেখানে হিন্দু সম্প্রদায়ের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে শতকরা ৪.৫ ভাগ। যদি স্বাভাবিক প্রবৃদ্ধি বজায় থাকত তাহলে ১৯৯১ সালে হিন্দু জনসংখ্যা বেড়ে দাঁড়াত ৩২.৫ মিলিয়ন (৩ কোটি ২৫ লক্ষ), অথচ বাস্তবে এই সংখ্যাটি ১৯৯১ সালে ছিল ১২.৫ মিলিয়ন (এক কোটি পঁচিশ লক্ষ)। এর অর্থ হচ্ছে জনসংখ্যার মধ্য থেকে ২০ মিলিয়ন (দুই কোটি) হিন্দু হারিয়ে গিয়েছে।
২০০১ এর আদমশুমারি অনুযায়ী বাংলাদেশে মোট জনসংখ্যার শতকরা ৯.২ ভাগ হিন্দু, ০.৭ ভাগ বৌদ্ধ এবং ০.৩ ভাগ খ্রিস্টান। ২০১১ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী মোট জনসংখ্যার শতকরা ৮.৫ ভাগ হিন্দু, ০.৬ ভাগ বৌদ্ধ, ০.৩ ভাগ খ্রিস্টান, এবং ০.১ ভাগ অন্যান্য ধর্মাবলম্বী।
বর্তমান সরকার কর্তৃক গৃহীত বিভিন্ন পদক্ষেপের ফলে পরিস্থিতির সামান্য পরিবর্তন হলেও দেশের বিভিন্ন স্থানে হিন্দু, বৌদ্ধ ও খ্রিষ্টান তথা ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘুদের জীবন, সম্পত্তি ও স্বাধীনতার উপর আক্রমণ অব্যাহত আছে।
সংখ্যালঘুদের নিত্যদিনের এইসব সমস্যা অ্যাড্রেস করার জন্য প্রয়োজনীয় বিষয়গুলো হচ্ছে (১) সংখ্যালঘু বিষয়ক মন্ত্রণালয় প্রতিষ্ঠা; (২) সংখ্যালঘু কমিশন গঠন; (৩) সংখ্যালঘু সুরক্ষা আইন প্রণয়ন; (৪) ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘুদের জন্য বার্ষিক বাজেটে পৃথক ব্যবস্থা রাখা। (৫) সংখ্যালঘুদের জন্য জাতীয় সংসদসহ প্রজাতন্ত্রের সর্বস্তরের অফিসে আসন সংরক্ষণের ব্যবস্থা। (৭) বিদ্যালয়গুলোতে সংশ্লিষ্ট ধর্ম শিক্ষার জন্য নিজ নিজ ধর্ম থেকে শিক্ষক নিয়োগের ব্যবস্থা কড়াকড়িভাবে বজায় রাখা।
উপসংহার:
পাকিস্তানের আইয়ুব-ইয়াহিয়ার শাসনের মডেলের খুব কাছাকাছি সামরিক একনায়কতন্ত্রের অধীনে বাংলাদেশে ১৯৭৫ থেকে ১৯৯০ পর্যন্ত এবং পরবর্তী কালে ১৯৯১-১৯৯৬ এবং ২০০১-২০০৮ পর্যন্ত অতিবাহিত করেছে। এসময় রাষ্ট্র সাম্প্রদায়িক শক্তিকে প্রত্যক্ষভাবে উৎসাহিত করেছে এবং আশ্রয় প্রশ্রয় দিয়েছে।
অনেক সংগ্রাম ও অন্যায় অত্যাচারের মুখোমুখি হয়ে নিজের জীবন বিপন্ন করে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ১৯৯৬ থেকে ২০০১ এবং ২০০৯ থেকে অদ্যাবধি নির্বাচিত সরকার প্রধান হিসেবে দেশ পরিচালনা করা কালীন অনেক তাৎপর্যপূর্ণ পরিবর্তন সাধিত হয়েছে। রাষ্ট্র এখন আর সাম্প্রদায়িক শক্তিকে প্রশ্রয় দেয় না। তথাপি সাম্প্রদায়িক শক্তি দেশের বিভিন্ন স্থানে এবং সমাজের বিভিন্ন স্তরে সক্রিয়।
বঙ্গবন্ধু হত্যা পরবর্তীকালে বেসামরিক ও সামরিক শাসকগণ অগণতান্ত্রিকভাবে অধ্যাদেশের মাধ্যমে সংবিধান থেকে ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্র বাদ দেয়। সংবিধানের শুরুতে ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম’ যুক্ত করে। বঙ্গবন্ধুর খুনিদের বিচার বন্ধ করতে ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জারি করেছে। ধর্মভিত্তিক রাজনীতি চালু করে। পরবর্তীকালে এগুলো পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধানে সংযোজিত করে দেয়।
রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে ‘ইসলামকে’ স্বীকৃতি দেওয়া হয়। যদিও পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে ১৯৭২ এর সংবিধানে দেশ ফিরে এসেছে কিন্তু এখনো সংবিধানের সাম্প্রদায়িক রূপ বলবৎ আছে। হিন্দু বৌদ্ধ ও খ্রিষ্টান ধর্মাবলম্বী সংখ্যালঘুদের জন্য বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ অনুযায়ী প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ এখন সময়ের দাবিতে পরিণত হয়েছে।
অধ্যাপক ড. অরুণ কুমার গোস্বামী ।। ডিন, সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়