দেশে করোনা সংক্রমণ পরিস্থিতি এখন কিছুটা স্বস্তির ইঙ্গিত দিচ্ছে। এ বছর ২৮ জুলাই সর্বোচ্চ সংক্রমণ রেকর্ড করা হয় ১৬২৩৭ জনের। সংক্রমণ হার ছিল ৩০ শতাংশের উপরে। আশার কথা হলো, গত কয়েকদিন ধরে সংক্রমণ সংখ্যা এবং সংক্রমণ হার উভয়ই নিম্নমুখী। সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী সংক্রমণ হার ছিল ১৫ শতাংশ।

দেশে টিকা সরবারহ আশাব্যঞ্জক। বিভিন্ন উৎস থেকে টিকা প্রাপ্তি নিশ্চিত হচ্ছে নিয়মিত। এই প্রেক্ষিতে দীর্ঘদিন ধরে বন্ধ থাকা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো পর্যায়ক্রমে খুলে দেওয়ার পরিকল্পনা নেওয়া হচ্ছে। ফলে প্রায় স্থবির হয়ে পড়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা যে অনিশ্চয়তার মধ্য দিয়ে যাচ্ছিলেন, তাদের মধ্যে প্রাণের সঞ্চার হচ্ছে যা অত্যন্ত আশাপ্রদ।

সংক্রমণের এই নিম্নমুখী হার অব্যাহত রাখার জন্য জনগণকে স্বাস্থ্যবিধি মানতে বাধ্য করা এবং স্বল্প সময়ের মধ্যে একটি বড় জনগোষ্ঠীকে টিকার আওতায় নিয়ে আসা অত্যন্ত জরুরি। সেই কারণে যে বিষয়টি এখন সবচেয়ে বেশি আলোচিত হচ্ছে তা হলো, দেশে টিকা উৎপাদনের কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ। 

বাংলাদেশে টিকা উৎপাদনের প্রথম উদ্যোগ নেয় গ্লোব বায়োটেক লিমিটেড। নিজস্ব গবেষণাগারে তারা অত্যন্ত আধুনিক প্রযুক্তির টিকা উদ্ভাবনে সক্ষম হন যা প্রাণী দেহে (ইঁদুর) ব্যবহার করে কার্যকর প্রমাণিত হয়। টিকা আবিষ্কারের পরবর্তী ধাপে বানরের উপর এটি প্রয়োগ শুরু হয়েছে বলে জানা যাচ্ছে। এই পরীক্ষায় সফল হলে অর্থাৎ টিকাটি যদি কার্যকর ও নিরাপদ প্রমাণিত হয় তাহলে মানব দেহে এর ট্রায়াল শুরু হতে পারে। মানবদেহে ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল এর চারটি ধাপ রয়েছে, এর মধ্যে প্রথম তিনটি ধাপে সফল হলে তা ব্যাপকভাবে মানবদেহে ব্যবহারের অনুমোদন পেতে পারে। 

৭০-৮০ শতাংশ মানুষকে দ্রুত টিকার আওতায় আনতে পারলে ভবিষ্যতে করোনার ভয়াবহ ছোবল ও প্রাণহানি অনেকটাই কমে যাবে। 

প্রথম ধাপে অপেক্ষাকৃত কম সংখ্যক মানুষের (২০-৮০ জন) দেহে প্রয়োগ করে টিকাটি নিরাপদ কি না তা পরীক্ষা করা হয়। এছাড়াও টিকার মাত্রা এবং পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াও এ পর্যায়ে মূল্যায়ন করা হয়।

দ্বিতীয় ধাপে শতাধিক মানুষের দেহে টিকার মাত্রা নির্ধারণ ও কার্যকারিতা পরীক্ষা করা হয়। দ্বিতীয় ধাপ সফল হলে তৃতীয় ধাপের ট্রায়াল শুরু করা হয়, যেখানে ১-৩ হাজার মানুষের শরীরে টিকার কার্যকারিতা ও নিরাপত্তা বা সহনশীলতা পরীক্ষা করা হয়। তবে জরুরি অবস্থায় অনেক সময় ২য় ও ৩য় ধাপের ট্রায়াল একসঙ্গে করা যায়। 

এ বাস্তবতায় গ্লোব বায়োটেক উদ্ভাবিত টিকা ‘বঙ্গভ্যাক্স’ ব্যবহারের অনুমোদন পেতে আরও বেশকিছু সময় আমাদের অপেক্ষা করতে হবে। করোনার মতো মহামারি মোকাবিলায় দ্রুত টিকা সরবরাহ নিশ্চিত করার জন্য তাই বিকল্প হিসেবে বিদেশ থেকে টিকার ‘বাল্ক’ আমদানি করে দেশে ফিলিং করতে পারলে তা হবে সবচেয়ে কার্যকর।

উপরোক্ত বিষয়টি বিবেচনা করে সরকারের পক্ষ থেকে তাই বাস্তবসম্মত পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে যা অত্যন্ত আশাব্যঞ্জক। ইতিমধ্যেই চীনের সিনোফার্ম’র সঙ্গে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এবং ইনসেপ্টা ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেড’র মধ্যে একটি ত্রিপক্ষীয় চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। আশা করা হচ্ছে, আগামী ২/৩ মাসের মধ্যেই ইনসেপ্টা ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেড, সিনোফার্ম’র টিকা উৎপাদন শুরু করতে পারবে। সূত্রমতে, প্রতিমাসে প্রায় ২/৩ কোটি ডোজ টিকা সাশ্রয়ী মূল্যে উৎপাদনের সক্ষমতা রয়েছে ইনসেপ্টা ফার্মাসিউটক্যালস লিমিটেড’র। গুরুত্বপূর্ণ আরেকটি বিষয় হলো, উৎপাদিত সমস্ত টিকা বাংলাদেশ সরকার পাবে। 

দেশে দ্রুত টিকা তৈরিতে আরেকটি বাধা হতে পারে আমলাতান্ত্রিক জটিলতা। গ্লোব বায়োটেক উদ্ভাবিত টিকার ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের অনুমোদন যেন বিনা কারণে বিলম্বিত না হয় সেদিকে নজর রাখতে হবে।

তবে সিনোফার্ম’র টিকা ব্যাপকভাবে উৎপাদনের ক্ষেত্রে একটি বড় চ্যালেঞ্জ হলো সময়মতো টিকার ‘বাল্ক’ প্রাপ্তি। সমগ্র বিশ্বে ব্যাপক চাহিদার কারণে সিনোফার্ম’র ‘বাল্ক’ প্রাপ্তি আশানুরূপ নাও হতে পারে। এ কারণে উৎপাদন সক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও পর্যাপ্ত ‘বাল্ক’ সরবারহ না থাকলে টিকা উৎপাদন বাড়ানো যাবে না। এমতাবস্থায় রাশিয়ার তৈরি স্পুটনিক ভি একই প্রক্রিয়ায় উৎপাদনের চিন্তাভাবনা চলছে।

সূত্রমতে, পপুলার ফার্মাসিউটক্যালস লিমিটেড’র সঙ্গে রাশিয়ার চুক্তি সম্পাদন হলে উৎপাদিত টিকা রাশিয়ার কাছ থেকে সুলভ মূল্যে সরকার ক্রয় করতে পারবে। দ্রুত এ পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারলে দেশে টিকার কোনো সংকট থাকবে বলে মনে হয় না।


পর্যাপ্ত টিকা সরবরাহ থাকলে আগামী কয়েক মাসের মধ্যেই দেশের জনসংখ্যার একটি বড় অংশকে টিকার আওতায় আনা সম্ভব হবে। আর ৭০-৮০ শতাংশ মানুষকে দ্রুত টিকার আওতায় আনতে পারলে ভবিষ্যতে করোনার ভয়াবহ ছোবল ও প্রাণহানি অনেকটাই কমে যাবে। 

দেশে দ্রুত টিকা তৈরিতে আরেকটি বাধা হতে পারে আমলাতান্ত্রিক জটিলতা। গ্লোব বায়োটেক উদ্ভাবিত টিকার ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের অনুমোদন যেন বিনা কারণে বিলম্বিত না হয় সেদিকে নজর রাখতে হবে। এছাড়াও সিনোফার্ম’র ‘বাল্ক’ আমদানির অনুমোদন ও অন্যান্য পদক্ষেপে যেন অহেতুক কালক্ষেপণ না হয় সেদিকটাও খেয়াল রাখতে হবে। 

সর্বোপরি, করোনা মহামারি মোকাবিলায় জনগণের সচেতনতা যেমন স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা, যথা নিয়মে মাস্ক পরিধান করা, অহেতুক জনসমাগম এড়িয়ে চলা ইত্যাদি যেমন প্রয়োজন তেমনি প্রশাসন তথা সরকারের কঠোর নজরদারির মাধ্যমে জনগণকে স্বাস্থ্যবিধিসমূহ মানতে বাধ্য করাও সমভাবে প্রয়োজন। পাশাপাশি জনগণকে টিকার আওতায় আনার জন্য সুষ্ঠু পরিকল্পনা প্রণয়ন ও তা বাস্তবায়ন একান্ত জরুরি।

অধ্যাপক ড. ফিরোজ আহমেদ ।। চেয়ারম্যান, ফার্মেসি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়