বঙ্গবন্ধু ও আমার স্মৃতি
১৯৪৮ সাল। তখন আমি কলেজে পড়ি। জিন্নাহ ঘোষণা দিলেন রাষ্ট্র ভাষা হবে উর্দু। এ ঘোষণা শোনার পর আমার মধ্যে তখন চরম উত্তেজনা কাজ করছিল। এরই ধারাবাহিকতায় ঢাকায় মাতৃভাষা রক্ষার আন্দোলনে যোগ দিই। রাজনীতির প্রতি তীব্র আকর্ষণের কারণে পরবর্তী সময়ে রাজনীতির সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে পড়ি। ১৯৪৮ সালের পর ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনেও যুক্ত ছিলাম সক্রিয়ভাবে।
১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনী প্রচার প্রচারণা শুরু হয়। তখন শেখ মুজিবের এক ঝলক বক্তব্য শুনে আমি তার মতাদর্শের রাজনৈতিক সৈনিক হয়ে পড়ি। এমনকি ওই নির্বাচনী প্রচারণায় আমি সরাসরি কাজ করেছি। নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নির্বাচিত হয়ে মন্ত্রীর দায়িত্ব পান। ওই সময়ে আমি যুবক ছিলাম। দুরন্তপনায় যখন তখন পূর্ব পাকিস্তান ছাড়াও ভারত ও পশ্চিম পাকিস্তানের বিভিন্ন প্রদেশে ঘুরতে যেতাম। একবার পশ্চিম পাকিস্তানের লাহোরে ঘুরতে গিয়ে সেখানে সামনাসামনি শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে দেখা হয়ে যায়।
বিজ্ঞাপন
পরে ১৯৬৬ সালে ঢাকার পুরান পল্টন এলাকায় অবস্থিত একটি টিনের ঘরে আওয়ামী লীগের অফিসে আমার সাথে শেখ মুজিবুর রহমানের সাক্ষাৎ হয়। সেদিন অনেক লম্বা সময় ধরে কথা হয় এ রাজনৈতিক মহীরুহের সাথে। আমি সে সময় বেশ চঞ্চল ও উদ্যমী ছিলাম। আমার চঞ্চলতা দেখে তিনি আমাকে সারা দেশে ৬ দফা আন্দোলনের প্রচারপত্র বিলি করার দায়িত্ব দেন।
দেশের বিভিন্ন জেলায় ঘুরে ঘুরে ৬ দফার প্রচারপত্র বিলি করতে থাকি। ৬ দফা প্রচার করতে গিয়ে নারায়ণগঞ্জ জেলা সদরে মুসলিম লীগের লোকজন আমাকে পিটিয়ে আহত করে ময়লার ড্রেনে ফেলে রাখে। পরে শামসুজ্জোহা ও সাজেদ আলী সাহেব আমাকে উদ্ধার করে হাসপাতালে চিকিৎসা করান।
বঙ্গবন্ধু দেশের যেসব স্থানে সভা-সমাবেশ করতেন প্রায় প্রতিটিতে উপস্থিত থাকার চেষ্টা করতাম। তার মধ্যে পাবনা, রাজশাহী, মুন্সিগঞ্জ ও কক্সবাজার উল্লেখযোগ্য। একবার পাবনায় এক জনসভায় বঙ্গবন্ধুর সাথে গিয়েছিলাম। বঙ্গবন্ধু পাবনা কলেজ মাঠে বক্তব্য রাখছেন। আমি ট্রাকে করে ৬ দফার প্রচারপত্র নিয়ে গেছি। কিছু উচ্ছৃঙ্খল ছেলে এসে আমার প্রচারপত্রগুলো কেড়ে নিয়ে যায়। কিছুটা হট্টগোল হলে সে এলাকার ছাত্রলীগের ছেলেরা এগিয়ে এসে আমাকে জিজ্ঞেস করে এখানে কী হয়েছে? আমি তাদের বলি, তেমন কিছু হয়নি।
দেশের বিভিন্ন জেলায় ঘুরে ঘুরে ৬ দফার প্রচারপত্র বিলি করতে থাকি। ৬ দফা প্রচার করতে গিয়ে নারায়ণগঞ্জ জেলা সদরে মুসলিম লীগের লোকজন আমাকে পিটিয়ে আহত করে ময়লার ড্রেনে ফেলে রাখে।
সভা শেষে হোটেলের রুমে এসে বঙ্গবন্ধু আমার কাছে জানতে চান কিসের হট্টগোল হয়েছিল? আমি মূল ঘটনা তার কাছে খুলে বলি। তিনি আমার কথা শুনে বললেন, তুই এ কথা ছাত্রলীগের ছেলেদের তখন বলিসনি কেন? আমি বললাম তখন ওদেরকে বললে একটা গণ্ডগোল বেঁধে যেত তখন পুরো সভাটাই পণ্ড হয়ে যেত, তাই বলিনি। বঙ্গবন্ধু আমার একথা শুনে খুশি হলেন। বললেন, বাদশা তুই ঠিক বলেছিস।
পাবনার ওই সভায় যাওয়ার পথে একদিনে ৩ জায়গায় বঙ্গবন্ধু তার বহর নিয়ে নাস্তা করেছিলেন। তা না হলে স্থানীয় নেতাকর্মীরা রাগ করেন। এজন্য তিনি অনেকটা বাধ্য হয়েই সবাইকে নিয়ে ৩ জায়গায় নাস্তা করেছিলেন।
একবার রাজনৈতিক কর্মসূচিতে বঙ্গবন্ধুর সাথে কক্সবাজার গিয়েছিলাম তখন ওই সফরে বঙ্গবন্ধুর সফর সঙ্গী ছিলেন ২৭ জন। কক্সবাজারে হোটেলে খাওয়ার সময় আমি বঙ্গবন্ধুর পাশের চেয়ারে গিয়ে বসি। বঙ্গবন্ধু কিছুটা রাগত স্বরে বলেন, এই বাদশা তুই এখানে বসেছিস কেন? আমি হাসি মুখে বললাম আপনার সাথে বসলে বেশি খেতে পারব তাই এখানে বসেছি। তিনি আমার কথা শুনে হাসি দিয়ে বললেন, ও আচ্ছা ঠিক আছে, তাহলে বস। বঙ্গবন্ধুর সাথে এমন হাজারো স্মৃতি রয়েছে আমার।
৬ দফা ঘোষণার পর শেখ মুজিবুর রহমানের নামে তৎকালীন পাকিস্তান সরকার আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা দায়ের করেন। পরে এ মামলায় তিনি গ্রেফতার হন। তখন তার মুক্তির দাবিতে সারা দেশে আন্দোলন জোরদার হতে থাকে। আমিও সেই সকল আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে যোগ দিই।
১৯৬৮ সালের ৬ ডিসেম্বর মাওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে ঢাকার গুলিস্তানের মোড়ে রক্ষিত কামানের সামনে থেকে কেন্দ্রীয় জেলখানা পর্যন্ত শেখ মুজিবের মুক্তির দাবিতে দীর্ঘ একটি মিছিল বের হয়। পুরো বাঙালি জাতি তার মুক্তির জন্য ‘জেলের তালা ভাঙবো, শেখ মুজিবকে আনবো’- এ স্লোগানে রাজপথে নেমে আসে। ওই মিছিলের সম্মুখ সারিতে আমিও ছিলাম। পরে ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানের আন্দোলনেও উপস্থিত ছিলাম আমি।
বঙ্গবন্ধু কিছুটা রাগত স্বরে বলেন, এই বাদশা তুই এখানে বসেছিস কেন? আমি হাসি মুখে বললাম আপনার সাথে বসলে বেশি খেতে পারব তাই এখানে বসেছি। তিনি আমার কথা শুনে হাসি দিয়ে বললেন, ও আচ্ছা ঠিক আছে, তাহলে বস।
১৯৬৯ সালে আমি শেখ মুজিবুর রহমানকে সোনারগাঁওয়ে আসার জন্য আমন্ত্রণ জানাই। আমার আমন্ত্রণে তিনি ২৭ জুন সোনারগাঁওয়ের পানাম, দত্তপাড়া ও ফুলবাড়িয়ায় আসেন। সে সময় তাকে ফুল দিয়ে অভ্যর্থনা জানানো হয়। পাশাপাশি খাগুটিয়া গ্রামের চিত্রকর বাদলকে দিয়ে একটি অভ্যর্থনা পত্র ডিজাইন করে লিখিয়ে বঙ্গবন্ধুর হাতে আমি তুলে দিই। উক্ত অভ্যর্থনা পত্রে আমি ও আওয়ামী লীগ নেতা রউফ মোল্লা দুইজনে মিলে একটি কবিতা লিখেছিলাম। তাতে লেখা ছিল—
‘বীর বঙ্গের সন্তান
দেশ মাতৃকা দুয়ারে দাঁড়িয়ে
করেছো আহবান।
বঙ্গবন্ধু এসেছেন দ্বারে
মুক্তি মন্ত্র নিয়ে
চলরে সবাই, বাহির হইয়া যাই
তাঁরই অনুগামী হয়ে।’
পরে বঙ্গবন্ধু তার সফর সঙ্গীদের নিয়ে দুলালপুর গ্রামের আমার নিজ বাড়ির দোতালায় গিয়ে বসেন। এখানে তিনি সংক্ষিপ্তভাবে একটি সভাও করেন। সেদিন তিনি বলেছিলেন, যদি কোনোদিন সুযোগ আসে তাহলে সোনারগাঁওকে সোনার বাংলা হিসেবে গড়ে তুলব। আমি ও আমার পরিবার সেদিন বঙ্গবন্ধুকে ধন্যবাদ জানিয়েছিলাম। এরপর তাকে নিয়ে আমি সোনারগাঁওয়ের বিভিন্ন স্থানে গিয়েছিলাম। সর্বশেষ সাজেদ আলী সাহেবের বাড়ি থেকে রাতের বেলা যখন বঙ্গবন্ধু বিদায় নেন তখন আমি নিজে উপস্থিত থেকে তাকে বিদায় জানিয়েছিলাম।
১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচন শুরু হলে আমি বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে ওই নির্বাচনী কাজে নেমে পড়ি। সাজেদ আলী সাহেব সোনারগাঁও থেকে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়ে নৌকা প্রতীকে নির্বাচন করেন। আমি তার পক্ষে নির্বাচনী প্রচারণায় অংশ নিই। তিনি আমাকে সে সময় নির্বাচনী দায়িত্ব দেন। নিষ্ঠার সাথে দায়িত্ব পালন করি। নির্বাচনী খরচ দিয়েছিলেন ১৫০ টাকা। ওই নির্বাচনে সাজেদ আলী সাহেব সোনারগাঁও থেকে নৌকা প্রতীকে বিজয়ী হয়েছিলেন।
১৯৬৯ সালে আমি শেখ মুজিবুর রহমানকে সোনারগাঁওয়ে আসার জন্য আমন্ত্রণ জানাই। আমার আমন্ত্রণে তিনি ২৭ জুন সোনারগাঁওয়ের পানাম, দত্তপাড়া ও ফুলবাড়িয়ায় আসেন। সে সময় তাকে ফুল দিয়ে অভ্যর্থনা জানানো হয়।
পরে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী ১৯৭০ সালের নির্বাচনের ফলাফল মেনে নিতে পারেনি। এ নিয়ে শুরু হয় আবারও আন্দোলন। পরে এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৭১ সালের ৭ মার্চে ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধু বিশাল জনসভার ডাক দেন।
বঙ্গবন্ধুর দিক নির্দেশনামূলক বক্তব্য শোনার জন্য আমি ও আমার সতীর্থরা সেদিন পায়ে হেঁটে ওই জনসভায় অংশগ্রহণ করেছিলাম। ওই সভায় বঙ্গবন্ধু সারা দেশে সংগ্রাম পরিষদ গঠনের ঘোষণা দেন। সে অনুযায়ী সোনারগাঁওয়ের সনমান্দির মান্নানকে সভাপতি ও আমাকে সাধারণ সম্পাদক করে ৫১ সদস্য বিশিষ্ট সংগ্রাম পরিষদের কমিটি গঠন করা হয়।
এরপর সংগ্রাম পরিষদের উদ্যোগে বর্তমান বাংলাদেশ লোক ও কারুশিল্প ফাউন্ডেশনের প্রধান ফটকের সামনে (আমতলায়) সভা ডাকা হয়। ওই সভায় আমার সভাপতিত্বে কয়েকশ লোক জমায়েত হয়। তখন আমি ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর দেওয়া ভাষণের হুবহু পুনরাবৃত্তি করি। এখান থেকে পাক বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ প্রতিরোধ শুরু করি। তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত নিই, ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের লাঙ্গলবন্দ ব্রিজ ভাঙার।
এরপর ২৬ মার্চ সকাল ৮টায় কাঁচপুর থেকে আজিজুল্লাহ, সনমান্দি থেকে সিরাজ মাস্টার, আমিনপুর থেকে আব্দুর রউফ মোল্লা, গাজী আকরাম, আব্দুল আউয়ালসহ অনেকেই দুলালপুর আমার বাড়িতে আসেন। দীর্ঘক্ষণ আমাদের মধ্যে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে পরিকল্পনা হয়।
২৭ মার্চ বিকেলে মোগরাপাড়া ইউনিয়নের সোনারগাঁ ডিগ্রী কলেজ এলাকায় আজিজুল্লাহ, শাহাজাদা, সাদেক ও খালেককে নিয়ে বসি। আমরা ভারতে প্রশিক্ষণে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিই। এসময় আমরা শপথ গ্রহণ করি। পরিবারের সঙ্গে দেখা না করেই তখন রওনা হই। রামকৃষ্ণপুর চারগাছ হয়ে আমরা আগরতলা যাই। ভারতে প্রশিক্ষণ শেষে দেশে ফিরে মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অংশ নিই।
বঙ্গবন্ধুর ধানমন্ডির ৩২ নম্বরের বাড়িতে স্ত্রী ও ছেলে আসাদুজ্জামানকে নিয়ে যাই। তখন আমার ছেলে কোলের শিশু ছিল। বঙ্গবন্ধু আমার স্ত্রী ও ছেলেকে মাথায় হাত দিয়ে সেদিন দোয়া করেছিলেন।
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের দিন আমি ঢাকার বিমানবন্দরে উপস্থিত ছিলাম। বঙ্গবন্ধু সেদিন একটি খোলা ট্রাকে করে বিমানবন্দর থেকে রেসকোর্স ময়দানে আসেন। আমি ওই ট্রাকের সামনে ছিলাম। হঠাৎ দেখলাম রাস্তায় বড় একটি গর্ত। আমি ট্রাকের সামনে চিৎকার করে বলতে থাকি সামনে বড় গর্ত, ট্রাক থামান। আমি এটি বলার জন্য ট্রাকের সামনের দিকে উঠে যাই। পরে আমার কথা শুনে ট্রাকটি ঘুরিয়ে ভাল রাস্তায় নিয়ে যাওয়া হয়।
স্বাধীনতার পর আমরা সকল অস্ত্র জমা দিয়ে দিই। এরপর ১৯৭২ সালে আমি রিলিফ কমিটির চেয়ারম্যান হই। তারপর জনগণের ভোটে তৎকালীন আমিনপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হই। ১৯৭৩ সালে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আমার আত্মরক্ষার জন্য আমাকে একটি রিভলবার উপহার দেন।
স্বাধীনতার পর তিনি একদিন আমাকে বললেন, আমার স্ত্রী সন্তানকে তার কাছে নিয়ে যেতে তিনি তাদের দেখবেন। আমি বঙ্গবন্ধুর ধানমন্ডির ৩২ নম্বরের বাড়িতে স্ত্রী ও ছেলে আসাদুজ্জামানকে নিয়ে যাই। তখন আমার ছেলে কোলের শিশু ছিল। বঙ্গবন্ধু আমার স্ত্রী ও ছেলেকে মাথায় হাত দিয়ে সেদিন দোয়া করেছিলেন।
বঙ্গবন্ধু আমাকে অনেক স্নেহ করতেন। আমি স্বাধীনতার পর নিয়মিত আওয়ামী লীগের পার্টি অফিসে আসা-যাওয়া করতাম। সার্বক্ষণিক বঙ্গবন্ধুর সাথে যোগাযোগ হতো। আমি নিজের জীবনের চেয়ে বঙ্গবন্ধুকে বেশি ভালোবাসতাম। এটা বঙ্গবন্ধু ও তার স্ত্রী জানতেন।
উনি গাড়িতে উঠে গেলে আবারও অনুরোধ করে তাকে গাড়ি থেকে নামায়। তিনি আমাকে বলেন, কী হয়েছে আবার গাড়ি থেকে নামতে বলছিস কেন? আমি বললাম একটি বাচ্চা মেয়ে আপনাকে গলায় ফুল দিতে চায়...
১৯৭৪ সালের মার্চ মাসে বঙ্গবন্ধু একবার সড়ক পথে কুমিল্লা গিয়েছিলেন। তখন আমি নিজ উদ্যোগে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের উপর বঙ্গবন্ধুর সৌজন্যে একটি তোরণ নির্মাণ করেছিলাম। দেবদারু গাছের পাতা দিয়ে নির্মিত তোরণটি বেশ আকর্ষণীয় ছিল।
বঙ্গবন্ধু যখন মল্লিকপাড়া এলাকায় পৌঁছান তখন আমার অনুরোধে গাড়ি থেকে নেমে উপস্থিত জনতার উদ্দেশ্যে তিনি সংক্ষিপ্ত বক্তব্য রাখেন। উনি গাড়িতে উঠে গেলে আবারও অনুরোধ করে তাকে গাড়ি থেকে নামায়। তিনি আমাকে বলেন, কী হয়েছে আবার গাড়ি থেকে নামতে বলছিস কেন? আমি বললাম একটি বাচ্চা মেয়ে আপনাকে গলায় ফুল দিতে চায়। এটা শুনে তিনি গাড়ি থেকে নেমে ওই মেয়েকে কোলে তুলে নিয়ে তার হাতে গলায় মালা পরেছিলেন।
বঙ্গবন্ধুর পথসভার জন্য ১০/১২ দিন আগে থেকেই এলাকায় মাইকিং করিয়েছিলাম। যদিও উপজেলা আওয়ামী লীগের তৎকালীন একটি পক্ষ মাইকিং করার সময় আমার লোকজনকে মারধর ও মাইক ভাঙচুর করেছিল। এ ব্যাপারে পথসভার দিন বঙ্গবন্ধুর কাছে আমি মৌখিকভাবে নালিশও করেছিলাম। পরে অবশ্য তিনি বিষয়টি মিটমাট করে দেন।
আমি ১৯৭৫ সালে উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের প্রতিষ্ঠাতা কমান্ডার নির্বাচিত হই। ওই বছরের ১৫ আগস্ট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করা হয়।
আমি তখন ইউনিয়নের চেয়ারম্যান। বাসায় টিভি ছিল না, তাই বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের খবর জানতে পারি ইউনিয়ন পরিষদের টেলিভিশনের মাধ্যমে। খবরটি শোনার পরই রাগে, ক্ষোভে ফেটে পড়ি এবং টেলিভিশনটি ভেঙ্গে ফেলি। আমি পাগলের মতো হয়ে যাই। এ হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে সভা করতে লোকজন জড়ো করতে থাকি। এ খবর আমার শত্রুরা প্রশাসনের কাছে পৌঁছে দেয়। এরপর পুলিশ আমাকে গ্রেপ্তার করে থানায় নিয়ে যায়।
পুলিশ কন্ট্রোল রুমে নিয়ে ইন্টারোগেশনের নামে আমার উপর অমানুষিক নির্যাতন চালায়। তৎকালীন স্পেশাল ব্রাঞ্চের ডিআইজি ই, এ, চৌধুরী ও ডিসি রেজাউল হায়াত-এর সহযোগিতায় মাসাধিক জেলে থাকার পর মুক্তি পাই। ঐ সময় আমার রিভলবারটি জব্দ করা হয়।
মুক্তির পরও আমার উপর অত্যাচার-নির্যাতন অব্যাহত থাকে। রাজনীতির নানা পটপরিবর্তনে অনেক কিছুই বদলে যায়। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে আমি বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর সাথে দেখা করি ও আমার কাছে থাকা সব ডকুমেন্ট তার কাছে হস্তান্তর করি।
আমার ইচ্ছা ছিল বঙ্গবন্ধু কন্যার সাথে মৃত্যুর আগে আরও একবার দেখা করব। আমার সে ইচ্ছা পূরণ হয়েছে। ২০১৯ সালে আমার কনিষ্ঠ কন্যা অধ্যাপক ড. সেলিনা আক্তার আমাকে নিয়ে যায় বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার কাছে। সেদিন আমার মেয়েকে তার হাতে তুলে দিই এবং তিনি তার দায়িত্ব নেন।
আমার বয়স এখন ৯১ বছর চলছে। জীবনের এ শেষ সময়ে চাই লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে পাওয়া বাংলাদেশ যেন ক্ষুধা, দরিদ্র, দুর্নীতি ও সন্ত্রাস মুক্ত বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা হিসেবে গড়ে ওঠে।
সুলতান আহমদ মোল্লা (বাদশা) ।। মুক্তিযোদ্ধা ও ভাষাসৈনিক