১ ফেব্রুয়ারি সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা কুক্ষিগত করার পর মিয়ানমারের সামরিক জান্তা মিন অং লাইং এ পর্যন্ত আসিয়ান সম্মেলনে অংশ নিয়েছেন। পাশাপাশি ২১ জুন রাশিয়া সফর করেছেন।

আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা বিষয়ক মস্কো সম্মেলনে (২২-২৪জুন) অংশগ্রহণের পাশাপাশি তিনি রাশিয়ার নিরাপত্তা কাউন্সিলের প্রধান নিকোলাই পেত্রোশেভ, প্রতিরক্ষামন্ত্রী সার্গেই শুইগো এবং অস্ত্র রপ্তানিকারী প্রতিষ্ঠানের প্রধান আলেকজান্ডার মিকিভ এর সাথেও সাক্ষাৎ করেন। উক্ত সফরে তাকে রাশিয়ার ঐতিহ্যবাহী ‘লবণযুক্ত রুটির খাবার’ দিয়ে বরণ করা হয়নি এবং রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সাথে তিনি সাক্ষাৎ করতে পারেননি।

তাছাড়া রাশিয়ার সংবাদ সংস্থা ‘তাস’ তাকে রাষ্ট্রের প্রধান না বলে ‘সামরিক বাহিনীর প্রধান’ হিসেবে খবর প্রচার করে। বন্ধু প্রতিম রাষ্ট্র রাশিয়া সফরের এমন অসম্মানজনক পর্বই মিন অং লাইং’কে জান্তা প্রধান থেকে সরকার প্রধান হওয়ার জন্য উদ্বুদ্ধ করে থাকতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে।

আগস্টের ১ তারিখে মিয়ানমার জান্তা প্রধান মিন অং লাইং ক্ষমতাশালী ‘স্টেট অ্যাডমিনিস্ট্রেশন কাউন্সিল’কে ‘তত্ত্বাবধায়ক সরকার’-এ রূপান্তরিত করে নিজেকে ‘প্রধানমন্ত্রী’ পদে আখ্যায়িত করেন। তাছাড়া ১ ফেব্রুয়ারি ক্ষমতা দখলের কয়েক দিন পরে সামরিক জান্তা যে এক বছরের জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেছিলেন তা তারা আড়াই বছর পর্যন্ত বাড়িয়েছে। যদিও তাদেরই প্রণীত সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনের কোনো বিধান নেই। এটি আসলে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর কু-কর্মের ঐতিহাসিক পুনরাবৃত্তি যা ১৯৫৮ সালের ঘটনা মনে করিয়ে দেয় যখন তারা সবকিছু বাতিল করে নতুন সরকার গঠন করে।

কালক্ষেপণের মাধমে ক্ষমতা স্থানান্তরের একটি রোড ম্যাপ হিসেবে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী সামরিক পরিষদকে বেসামরিক প্রশাসন হিসেবে উন্নীত করল। তারা সাময়িক সময়ের জন্য ক্ষমতায় থাকার কথা বলে জনগণকে তাদের শাসনের অধীনে নতুন নিয়মের সাথে খাপ খাইয়ে নিতে চায়। এর মাধ্যমে তারা ধীরে ধীরে নিজেদেরকে বৈধ সরকার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করবে। তারা নিজেদেরকে বেসামরিক সরকারে পরিবর্তন করার আরেকটি কারণ হলো, আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি লাভ করা।

প্রায় ৮২ শতাংশ জনসমর্থন নিয়ে অং সান সু চির দল এনএলডি ২০২০ সালের জাতীয় নির্বাচনে বিশাল জয় পেলেও সামরিক বাহিনী ভোট কারচুপির অভিযোগ এনে সামরিক অভ্যুত্থান ঘটায় এবং পরবর্তীতে গণতন্ত্রপন্থী দলের নেতাদের আটকপূর্বক নির্বাচন অবৈধ ঘোষণা করে। এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে প্রতিরোধ গড়ে উঠলে গণআন্দোলনকারী প্রায় ৯৫০ জন সাধারণ নাগরিককে হত্যা করে সামরিক বাহিনী এবং সামরিক শাসন বিরোধী প্রায় ৬ হাজার নাগরিককে গ্রেপ্তার করে।

মিয়ানমারের সর্বস্তরের সাধারণ জনগণের তীব্র বিরোধিতা সত্ত্বেও হত্যা, হুমকি ও নির্যাতনের মাধ্যমে ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত করে রেখেছে পৃথিবীর সবচেয়ে নিষ্ঠুর ও জঘন্য সামরিক বাহিনী। রাশিয়া ও চীন ব্যতীত বিশ্বের অন্যান্য দেশসমূহ মিয়ানমারের সামরিক সরকারকে সরাসরি সমর্থন দেয়নি। তাই উল্লেখিত দেশ দুইটির প্রত্যক্ষ সহযোগিতা এবং প্রতিবেশী কিছু রাষ্ট্রের পরোক্ষ সমর্থন নিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন করে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি লাভের প্রচেষ্টা চালাবে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী।

১৮ জুন জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে মিয়ানমারে ‘অস্ত্র প্রবাহ রোধ’ বিষয়ক একটি প্রস্তাব গৃহীত হওয়ার পরপর মিয়ানমারের জান্তা প্রধানের রাশিয়া সফরটি ছিল খুবই অভূতপূর্ব ঘটনা। ওই প্রস্তাবে শুধু বেলারুশই রেজুলেশনের বিপক্ষে ভোট দিয়েছিল; অন্যদিকে চীন, রাশিয়া এবং অন্যান্য ৩৪টি দেশ ভোট দেওয়া থেকে বিরত ছিল।

রাশিয়ার সাথে মিয়ানমারের ঐতিহাসিক সামরিক সম্পর্ক সামরিক অভ্যুত্থানের পর আরও সুদৃঢ় হয় বলে মনে করা হচ্ছে। অভ্যুত্থান পরবর্তী মার্চ মাসে বিদেশি কোনো কর্মকর্তার প্রথম উচ্চ পর্যায়ের সফর হিসেবে রাশিয়ার উপ-প্রতিরক্ষা সচিব আলেকজান্ডার ফোমিনের মিয়ানমার সফর, জুন মাসে মিয়ানমার বিমান বাহিনীর প্রধান কমান্ডার মং মং কিউয়ের নেতৃত্বে একটি সামরিক প্রতিনিধিদলের মস্কো সফর, জুন মাসেই মিয়ানমারে রাশিয়ার রাষ্ট্রদূত ড. নিকোলাই লিস্টোপাদভ এবং মিয়ানমারের সামরিক সরকার নিযুক্ত শিল্প মন্ত্রী ড. চার্লি থান এর মধ্যে ওষুধ উৎপাদন এবং রাবার ও পোশাক উৎপাদনে সহযোগিতাসহ শান রাজ্যে একটি নিষ্ক্রিয় ইস্পাত কারখানায় পুনরায় কাজ শুরু করার বিষয়ে দ্বিপক্ষীয় অর্থনৈতিক সম্পর্ক নিয়ে আলোচনার মতো ঘটনাগুলো প্রমাণ করে কীভাবে রাশিয়া মিয়ানমারের সামরিক সরকারকে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে। যদিও রাশিয়া এবং মিয়ানমারের মধ্যে সামগ্রিক বাণিজ্য সর্বনিম্ন রয়ে গেছে, তারপরও দেশ দুইটি সম্প্রতি তাদের সামরিক সহযোগিতা গভীর করেছে এবং রাশিয়া এখন চীনের পরে মিয়ানমারে দুই নম্বর সামরিক রপ্তানিকারক দেশ।

২০ জুলাই রাশিয়ার বার্ষিক MAKS এয়ার শো’তে প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনকে আলেকজান্ডার মিকিভ বলেন যে, মিয়ানমার দক্ষিণ পূর্ব এশিয়াতে রোজোবোরোনেক্সপোর্টের (রাশিয়ার রাষ্ট্রীয় অস্ত্র উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান) অন্যতম প্রধান গ্রাহক এবং রাশিয়ার রাষ্ট্রীয় মহাকাশ ও প্রতিরক্ষা সংস্থা রোস্টেকের প্রধান অংশীদার।

স্টকহোম ইন্টারন্যাশনাল পিস রিসার্চ ইনস্টিটিউট (এসআইপিআরআই) এর তথ্যানুযায়ী, ১৯৯৯-২০১৮ সাল পর্যন্ত রাশিয়ার কাছ থেকে আনুমানিক দেড় বিলিয়ন ডলার মূল্যের সামরিক হার্ডওয়ার কিনেছে মিয়ানমার, যা দেশটির মোট অস্ত্র আমদানির ৩৯ শতাংশ।

সাম্প্রতিক বছরগুলোয় রাশিয়া জান্তাকে অস্ত্র বিক্রিসহ প্রতিরক্ষা সহযোগিতা, বিভিন্ন ধরনের সামরিক প্রশিক্ষণ দেওয়া এবং হাজার হাজার সৈন্যকে রাশিয়ান বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার জন্য বৃত্তি দেওয়া উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি করেছে।

মানবাধিকার সংগঠনগুলো রাশিয়ার প্রেসিডেন্টকে মিয়ানমারের সামরিক জান্তার কাছে অস্ত্র বিক্রির অনুমতি দেওয়ার জন্য নিন্দা জানিয়েছে কারণ আমদানিকৃত অস্ত্র সাধারণ জনগণের আন্দোলন দমাতেই বেশি ব্যবহার করা হচ্ছে।

রাশিয়া সফরে মিয়ানমার জান্তা প্রধানের বেশ খানিকটা তিক্ত অভিজ্ঞতা হলেও দেশ দুইটি এখন একে অন্যের পরিপূরক হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন বাধার কারণে রাশিয়ার উৎপাদিত অস্ত্র মিয়ানমারে বিক্রির মাধ্যমে নতুনভাবে অস্ত্র বাণিজ্যের ক্ষেত্র তৈরি, অন্যদিকে রাশিয়ার সমর্থন নিয়ে মিয়ানমার সামরিক বাহিনীর ক্ষমতা কুক্ষিগত করাই তাদের স্ব স্ব অপরিহার্য লক্ষ্য বলে মনে করা হয়।

রোহিঙ্গা গণহত্যা পরবর্তী মিয়ানমারের বিরুদ্ধে আনীত জাতিসংঘের সকল প্রস্তাবে রাশিয়ার ভেটোদানের মাধ্যমে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীকে সমর্থন করার কারণে মিয়ানমার চীনের মতো রাশিয়াকেও ঐশ্বরিক দেবতা মনে করে। তাই রাশিয়া সফরের ক্ষাণিকটা অপমানবোধ হয়তো মিন অং লাইং’কে সেই শিক্ষা দিয়েছিল যে রাষ্ট্র ও সরকার প্রধান হওয়ার মাধ্যমেই রাশিয়া ও মিয়ানমারের মধ্যে স্বার্থগত সম্পর্ক বজায় থাকবে এবং ভবিষ্যতেও বিশ্বের সর্বজায়গায় সম্পর্ক স্থাপনে সহায়ক হবে।

তন্ময় চৌধুরী ।। গবেষক