১৯৬৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে শুলামিথ ফায়ারস্টোন, ক্যাথি সারাচাইল্ড, প্যাট্রিসিয়া মেইনার্ডি, বারবারা লিওন, লুসিন্ডা সিজলার, আইরিন পেসলিকিস বা অ্যালিক্স কেটস শুলম্যানের মতো নামী নারীবাদীদের নেতৃত্বে ‘রেড স্টকিংস (লাল মোজা)’ আন্দোলন নামে একটি আন্দোলনের সূচনা হয়েছিল।

আন্দোলনের নাম কেন ‘লাল মোজা’ রাখা হয়েছিল? কারণ পশ্চিমা সভ্যতাতেও বাড়ির ভালো মেয়েরা বাইরে যাওয়ার সময় পরে ‘ব্লু স্টকিংস’ বা ‘নীল মোজা’। লাল মোজা পরে রেড লাইট এরিয়ার মেয়ে বা দেহ পসারিণী, কল গার্ল বা ভ্রাম্যমাণ যৌনকর্মীরা। শুলামিথ ফায়ারস্টোনরা আঘাত হানলেন সোজা সেই ধারণাতেই।

১৯৬৯ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি গর্ভপাত আইন বিষয়ক ‘নিউ ইয়র্ক স্টেট জয়েন্ট লেজিসলেটিভ কমিটি অন পাবলিক হেলথ’-এর একটি শুনানিতে গিয়ে এই ‘লাল মোজা’ গোষ্ঠীর মেয়েরা বললেন, ‘আপনাদের বিশেষজ্ঞ কমিটিতে কেন ১৪ জন পুরুষ এবং একজন মাত্র নারী, যিনি কি না আবার নান বা সন্ন্যাসিনী?’

আরও পড়ুন >>> ২০২২ সাল নারীর জন্যে কেমন ছিল? 

এক মাস পরে ওয়াশিংটন স্কয়ার মেথডিস্ট চার্চের সামনে ‘লাল মোজা’ গ্রুপের একটি সভায় বারো জন নারী গর্ভপাত বিষয়ে তাদের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার বয়ান করেন এবং বলেন, ‘আমরাই এই বিষয়ে প্রকৃত বিশেষজ্ঞ যাদের কি না গর্ভপাত হয়েছে।’ এই নারীরা গর্ভপাত আইনের সংস্কারের বদলে আইনটি পুরোপুরি বাতিল করার দাবি তোলেন। স্বয়ং গ্লোরিয়া স্টেইনেমের মতো নারীবাদী তাত্ত্বিকও ছিলেন এই আন্দোলনে।

স্কুলে যেতেই স্কুল পরিচালনা কমিটির সদস্য তথা শহরের সব নামীদামি, সম্ভ্রান্ত পুরুষেরা তো ঘৃণায় বাঁচেন না! বাইজির ছেলে স্কুলে পড়বে? কাজেই বিদ্রূপের সাথে কর্তারা প্রশ্ন করলেন যে, ছেলের বাবার নাম কী?

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দেখাদেখি ১৯৭৩-১৯৮০ সাল অবধি ডেনমার্কেও গর্ভপাত মুক্ত করা (১৯৭৩), সম মজুরি (১৯৭৬) এবং মাতৃত্ব ছুটির ক্ষেত্রে সুযোগ বাড়ানো (১৯৮০) দাবিতে এই আন্দোলন চলেছিল।

কয়েকদিন ধরে বাংলাদেশে ফেসবুকে এদেশের তরুণ চিত্রনায়িকা পরীমণিকে ‘রাতের রানী’ নামে খুবই বাজে আখ্যা দেওয়ার প্রতিবাদ হিসেবে সমাজের নানা পেশার ও স্তরের সম্ভাবনাময় থেকে প্রতিষ্ঠিত নারীরা নিজেদের প্রোফাইল পিকচারে ‘রাতের রানী’ ফ্রেমওয়ার্ক যুক্ত করছেন।

আরও পড়ুন >>> মেয়েতো কালো

সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘সেই সময়’ উপন্যাসে ১৮৪০-১৮৭০ সালের যে বিকাশমান কলকাতা নগরীর আখ্যান পাওয়া যায়, সেখানে জমিদার বাবুদের মনোরঞ্জনের মাধ্যমে যথেষ্ট অর্থ উপার্জন করা এক বাইজির একবার অভিলাষ হয়েছিল তার ছেলেকে স্কুলে ভর্তি করানোর। কিন্তু নামী সেই স্কুলে যেতেই স্কুল পরিচালনা কমিটির সদস্য তথা শহরের সব নামীদামি, সম্ভ্রান্ত পুরুষেরা তো ঘৃণায় বাঁচেন না! বাইজির ছেলে স্কুলে পড়বে? কাজেই বিদ্রূপের সাথে কর্তারা প্রশ্ন করলেন যে, ছেলের বাবার নাম কী?

পিতৃ পরিচয় ছাড়া তো স্কুলে ভর্তি হওয়া যায় না। সেই নারীটি তখন একটুও ঘাবড়ে না গিয়ে কমিটির সব সদস্যের মুখের দিকে তাকিয়ে বিদ্রূপ ভরে হেসে বললেন যে, সত্যিই কি তিনি বলবেন যে তার ছেলের বাবার নাম কী? তখন তো স্কুল কমিটির কর্তারা উল্টো ভয়েই বাঁচেন না। কারণ এত নামী মানুষদের ভেতরে কার নাম না বলে বসে এই কাণ্ডজ্ঞানহীন বাইজি!

অবাক করা বিষয় হচ্ছে যে, আজ প্রায় দেড়শ বছর পরে বাংলার আর এক বড় শহরে প্রায় সমধর্মী ঘটনা ঘটছে। ব্যক্তিগতভাবে নায়িকা পরীমণির ঘরে প্রচুর পরিমাণ মদ ও কিছু মাদকদ্রব্য পাওয়া গেছে বা বোট ক্লাবের পরিচালক নাসির উদ্দিন মাহমুদ আসলেই তাকে ধর্ষণ করার চেষ্টা করেছে এসব প্রশ্নের উত্তরে খুব সন্তষ্ট নই।

তাই বলে পরীমণিকে ‘রাতের রানী’ বলে তার বাসায় কারা যেতেন সেই পুরুষদের তালিকা প্রদান করা হবে না বলে যখন জানা যায়, তখন এই নগরীকে সেই ১৮৪০-১৮৭০-এর কলকাতারই আর একটি নতুন সংস্করণ বলে মনে হয়!

আরও পড়ুন >>> বাল্যবিবাহ উপসর্গ মাত্র, মূল ব্যাধি পিতৃতন্ত্র

বৃহত্তর বরিশালের অল্প বয়সেই অনাথ এক কন্যা শিশু শামসুন্নাহার স্মৃতি তার মাতামহের কাছে পালিত হন। মাধ্যমিকে ট্যালেন্ট পুল বৃত্তি পাওয়া মেয়েটিকে জোর করে বিয়ে দেওয়া হয়েছিল এবং সেই বিয়ে যৌতুকের দাবিতে ভেঙ্গে যায় অথবা মেয়েটি স্বেচ্ছায় এক ফুটবলারকে বিয়ে করেছিল এবং পরে সেই স্বামী ও সে ঘরের সন্তানকে ছেড়ে চলচ্চিত্র মাধ্যমে নাম লেখান এবং নানা ঘটনা-দুর্ঘটনার জীবনে জড়ান এসব নিয়ে নানা প্রতিবেদন বা বিরুদ্ধ প্রতিবেদন পাওয়া যাচ্ছে।

জামিনের আবেদন মঞ্জুর না করে কাশিমপুর কারাগারে পাঠানোটা আমাদের সবার কাছেই খুবই বেদনাদায়ক বিষয় বলে মনে হচ্ছে এবং এখানেই সমাজে নারী-পুরুষের জন্য নির্ধারিত নৈতিকতার দুই রকম মাপকাঠির প্রশ্ন উঠছে...

এমনকি যে বোট ক্লাবের ঘটনার পর পরীমণি ফেসবুক লাইভ করে বা প্রধানমন্ত্রীকে বেশ কয়েকবার ‘মা’ সম্বোধন করে ফেসবুকে পোস্ট করে, সেই ঘটনার পর ঐ ক্লাব থেকে ঘটনার রাতের যে খুব সংক্ষিপ্ত হলেও ভিডিও চিত্রটি পাওয়া যায়, সেখানে অভিযুক্ত নাসির উদ্দিন অভিযোগকারীনীকে ধর্ষণ করার চেষ্টা করেছিল বলে মনে হয় না। কিন্তু ভিডিওটি সংক্ষিপ্ত বা একপেশে কি না এ জাতীয় নানা প্রশ্ন বাতাসে ভাসছে।

এ প্রসঙ্গে প্রখ্যাত জাপানি চলচ্চিত্র নির্মাতা আকিরা কুরোসাওয়ার ‘রশোমনে’-র কথা আমাদের সবার মনে পড়তে পারে। সত্য কি কখনো একটি রেখার মতো সরল হয় অথবা থাকে তার বহুতল নানা কৌণিকতা?

আরও পড়ুন >>> তুমি অকুণ্ঠিতা

যত যা-ই থাকুক, মদ বা মাদকদ্রব্য রাখার অপরাধে এত এত র‌্যাব পুলিশ দিয়ে গ্রেপ্তারও না হয় মানা গেল, দ্বিতীয় দফা রিমান্ডের পরও জামিনের আবেদন মঞ্জুর না করে কাশিমপুর কারাগারে পাঠানোটা আমাদের সবার কাছেই খুবই বেদনাদায়ক বিষয় বলে মনে হচ্ছে এবং এখানেই সমাজে নারী-পুরুষের জন্য নির্ধারিত নৈতিকতার দুই রকম মাপকাঠির প্রশ্ন উঠছে আমাদের মতো অতি রক্ষণশীল মূল্যবোধের দেশেও। আরও বিশেষত, যখন পরীমণির বিরুদ্ধে পর্নোগ্রাফিতে জড়িত থাকার অভিযোগ প্রমাণিত হয়নি।

একাধিক বিয়ে বা বোট ক্লাবের ঘটনার পর তদন্ত করতে আসা পুলিশ কর্মকর্তা সাকলায়েনের সাথে প্রেমে জড়িয়ে পড়ার ঘটনা বা এমনকি বহু পুরুষ সঙ্গ (যদি অর্থের বিনিময়েও হয়) যতটা অনৈতিক, ততটা বেআইনি নয়। কিংবা ধরা যাক, যদি বহু পুরুষ সঙ্গ (অর্থের বিনিময়েই) বেআইনি হয়, সেক্ষেত্রে পুরুষটি কেন দোষী হবে না? এই প্রশ্নের মীমাংসা বহু শতাব্দী ধরে সমাজবিজ্ঞানী থেকে ঔপন্যাসিকরা খুঁজে ফিরেছেন। কিন্তু উত্তর পাননি।

লেভ তলস্তয়ের ‘রেজারেকশন (পুনর্জন্ম)’ উপন্যাসে অভিজাত তরুণ নেখলিয়ুদভ তার বর্ষীয়সী আত্মীয়াদের বাসায় বেড়াতে গিয়ে বাড়ির তরুণী গভর্নেস কাতিউশার সাথে দৈহিক সম্পর্কে জড়িয়ে পুরুষ হিসেবে দায়-দায়িত্বহীন চলে যায়।

মেয়েটি অন্তসত্ত্বা হয়ে পড়ে। নেখলিয়ুদভ যথারীতি দায় নেয় না আর কাতিউশার আশ্রয় হয় গণিকালয়ে। পুরুষতান্ত্রিক সমাজের এটাই চিরায়ত চিত্র। এই চিরায়ত চিত্রের বিপরীতে যাওয়া জরুরি। সম্মুখে আনা জরুরি সেইসব পুরুষদের। না হয় সমাজে একপেশে মনোভাব বাড়বে। নারীর প্রতি ঘৃণা বাড়বে, যা অনুচিত।

অদিতি ফাল্গুনী ।। উন্নয়নকর্মী, কবি, কথাসাহিত্যিক ও অনুবাদক