শোক থেকে শক্তি হোক আমাদের ব্রত
আগস্ট বাঙালির কাছে শোকের মাস। ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্টে আমরা হারিয়েছি বাংলাদেশের স্বপ্নদ্রষ্টা, স্বাধীন বাংলাদেশের মহান স্থপতি, বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। এদিন ভোররাতে ঘাতকের বুলেটে প্রাণ বিসর্জন দেন জাতির পিতা।
জাতির পিতার সঙ্গে এসময় আরও হত্যা করা হয় বঙ্গবন্ধুর সহধর্মিণী বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুননেছা মুজিব, তাদের তিন পুত্র, দুই পুত্রবধূ এবং তাদের ঘনিষ্ঠ আত্মীয়-স্বজনকে। সেই সময়ে ইউরোপে থাকার সুবাদে সৌভাগ্যক্রমে প্রাণে বেঁচে যান বঙ্গবন্ধুর জ্যেষ্ঠ কন্যা শেখ হাসিনা এবং কনিষ্ঠ কন্যা শেখ রেহানা।
বিজ্ঞাপন
ঘাতকের দল হয়তো মনে করেছিল, বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মধ্য দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, বঙ্গবন্ধুর দেখানো স্বপ্ন এবং অসাম্প্রদায়িক সোনার বাংলা প্রতিষ্ঠা অতল গহ্বরে তলিয়ে যাবে। কিন্তু এটা ছিল সাময়িক। বাঙালি ঘুরে দাঁড়াতে পারে, সঠিক সিদ্ধান্তে ফিরে আসতে পারে। সেটা বঙ্গবন্ধুর জ্যেষ্ঠ কন্যা বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে অকুণ্ঠচিত্তে স্বাগত ও বরণ করার মধ্য দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে।
বাঙালি জাতি হিসেবে আমাদের সবচেয়ে বড় অর্জন আমাদের স্বাধীনতা ও নিজস্ব ভূখণ্ড। এটি বঙ্গবন্ধুর মাধ্যমে অর্জিত হয়েছে। এ কারণে বঙ্গবন্ধু, বাঙালি ও বাংলাদেশ একই সূত্রে গাঁথা এবং একটি অন্যটির পরিপূরক। তাই বঙ্গবন্ধু উত্তর বাঙালি শোককে শক্তিতে পরিণত করতে শিখেছে। বঙ্গবন্ধু জাতির কাছে অমর এবং চিরঞ্জীব।
জাতির পিতাকে হারানোর দুঃখের মধ্যে ১৯৮১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে প্রবাস জীবন কাটিয়ে বঙ্গবন্ধুর জ্যেষ্ঠ কন্যা শেখ হাসিনা আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব গ্রহণ করেন।
বাঙালি জাতি হিসেবে আমাদের সবচেয়ে বড় অর্জন আমাদের স্বাধীনতা ও নিজস্ব ভূখণ্ড। এটি বঙ্গবন্ধুর মাধ্যমে অর্জিত হয়েছে।
জাতির পিতার দু’টি স্বপ্নের মধ্যে ছিল, বাংলাদেশকে স্বাধীন করা এবং বাংলাদেশকে ক্ষুধামুক্ত, দারিদ্র্যমুক্ত সোনার বাংলা গড়ে তোলা। প্রথম স্বপ্নটি বঙ্গবন্ধু বাস্তবায়িত করেছিলেন। অপর স্বপ্নটি যখন বাস্তবায়নের পথে অগ্রসর হচ্ছিলেন, তখনই বুলেটের আঘাতে সপরিবারে তাকে হত্যা করা হয়। বর্তমানে শেখ হাসিনার বিচক্ষণ নেতৃত্বে জাতির পিতার দ্বিতীয় স্বপ্ন বাস্তবায়নের পথে অগ্রসরমান।
বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে দীর্ঘ ২১ বছর পর ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করে। শুরু হয় বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন পুনরায় বিনির্মাণের কাজ। ১৯৯৬ সালে সরকারে এসে মাঝখানে পাঁচ বছর বিরতি দিয়ে ২০০৯ থেকে টানা এগারো বছর সরকার পরিচালনা করে বারো বছর পার করতে চলেছেন শেখ হাসিনা।
আর্থ-সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও মানুষের যাপিত জীবনের প্রতিটির সূচকে বাংলাদেশের অগ্রযাত্রা আজ দৃশ্যমান। নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন যেমন বলেছেন, ‘সামাজিক-অর্থনৈতিক সব ক্ষেত্রে বাংলাদেশ পাকিস্তান থেকে এগিয়ে। এমনকি সামাজিক কোনো কোনো ক্ষেত্রে ভারত থেকেও এগিয়ে।’
বাংলাদেশ ইতিমধ্যে ‘নিম্নমধ্যম’ আয়ের দেশ থেকে ‘মধ্যম’ আয়ের দেশে হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। বর্তমান সরকার ২০৪১ সালের মধ্যে দেশকে উন্নত দেশের পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন করেছে। বলার অপেক্ষা রাখে না যে, বাংলাদেশের উন্নয়ন যাত্রায় বর্তমানে মহামারি করোনাভাইরাসকেও মোকাবিলা করতে হচ্ছে।
বাংলাদেশের মতো একটি উদীয়মান অর্থনীতির দেশের জন্য করোনার নানামুখী প্রভাব কাটিয়ে ওঠা কঠিন হলেও বর্তমান সরকার এ পরিস্থিতি ভালোভাবেই মোকাবিলা করছে। করোনায় কর্মহীন হয়ে পড়া এবং নিম্ম আয়ের মানুষের জন্য সরকারি খাদ্য এবং আর্থিক সহায়তার ফলে সামাজিক সুরক্ষার দিকটি মুখ থুবড়ে পড়েনি।
বিশেষভাবে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, বিশ্বব্যাপী মহামারি করোনার করোনার দ্বিতীয় ঢেউ চললেও বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দার মধ্যেও বাংলাদেশ ভালো করে পর্যবেক্ষকদের নজরে পড়েছে। উদীয়মান অর্থনৈতিক শক্তি হিসেবে পর্যবেক্ষকগণ বাংলাদেশের প্রশংসা করছেন।
১৯৭১ সালে পাকিস্তান থেকে স্বাধীনতা অর্জনের সময় বাংলাদেশকে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ হিসেবে উল্লেখ করেছিলেন। আজ বাংলাদেশ প্রায় ১৭ কোটি মানুষের আত্মবিশ্বাসী হাত-মুখ হেনরি কিসিঞ্জারের অভিমতকে ভুল প্রমাণ করে দিয়েছে।
অস্ট্রেলিয়ান ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির ন্যাশনাল সিকিউরিটি কলেজের সিনিয়র রিসার্চ ফেলো ডেভিড ব্রিউস্টার (David Brewster) গত ১০ জুন ‘A rising Bangladesh starts to exert its regional power’ শিরোনামে একটি নিবন্ধ প্রকাশ করেন। এতে তিনি বাংলাদেশের শ্রীলংকাকে ২০০ মিলিয়ন ডলার আর্থিক ঋণ দেওয়ার কথা উল্লেখ করার পাশাপাশি আফ্রিকার যুদ্ধ বিধ্বস্ত ও দারিদ্র্য পীড়িত দেশ সুদানকে এ বছরের জুনে বাংলাদেশি মুদ্রায় ৬৫ কোটি টাকা আর্থিক সহায়তা এবং আফ্রিকার অপর দেশ সোমালিয়ার দারিদ্র্য মুক্তির লক্ষ্যে বাংলাদেশ থেকে ৮ দশমিক ২১ কোটি টাকা আর্থিক সহায়তা দেওয়ার তথ্য তুলে ধরা হয়।
ভাবতে অবাক লাগে যে, দুই দশক আগেও বাংলাদেশের জাতীয় বাজেটের প্রায় ৯০ শতাংশ বৈদেশিক ঋণের ওপর নির্ভর করে প্রণয়ন করা হতো, আজ সেখানে বাংলাদেশ তার প্রতিবেশী আর্থিক সহায়তা দিচ্ছে। আঞ্চলিক আর্থিক প্রভাবশালী দেশ হওয়ার পথে এ মাইলফলক আমাদের গর্ব ও অহংকারের।
১৯৭১ সালে পাকিস্তান থেকে স্বাধীনতা অর্জনের সময় বাংলাদেশকে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ হিসেবে উল্লেখ করেছিলেন। আজ বাংলাদেশ প্রায় ১৭ কোটি মানুষের আত্মবিশ্বাসী হাত-মুখ হেনরি কিসিঞ্জারের অভিমতকে ভুল প্রমাণ করে দিয়েছে। বর্তমানে বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় ২ হাজার ২২৭ মার্কিন ডলার। যেখানে প্রতিবেশী ভারত হলো ১৯৪৭ ডলার এবং পাকিস্তানের ১৫৪৩ ডলার।
বাংলাদেশের বদলে যাওয়া অর্থনীতির এ যাত্রা শুরু হয় মূলত ২০১১ সাল থেকে। সেসময় বিশ্বখ্যাত মার্কিন দৈনিক পত্রিকা ‘দ্য ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল’এ বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের চিত্র তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকারের প্রশংসা করা হয়।
২০১২ সালে গ্রেট ব্রিটেন থেকে প্রকাশিত অর্থনীতি বিষয়ে বিশ্বের শীর্ষস্থানে অবস্থানকারী সাপ্তাহিক পত্রিকা ‘দ্য ইকোনমিস্ট’ও বাংলাদেশের অর্থনীতি উন্নয়নের বিভিন্ন সূচক তুলে ধরে বাংলাদেশের অব্যাহতভাবে অনুন্নয়ন ও দারিদ্র্য কাটিয়ে চিত্র উপস্থাপন করে।
২০১২ সালের ১৮ ডিসেম্বর ব্রিটেনের আরেকটি খ্যাতনামা দৈনিক পত্রিকা ‘দ্য গার্ডিয়ান’ করে যে, বাংলাদেশ অর্থনীতির সাফল্যের ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে পারলে ২০৫০ সালে বাংলাদেশের অর্থনীতি ইউরোপের প্রধান প্রধান কয়েকটি অর্থনীতিতে শক্তিশালী দেশকে ছাড়িয়ে যাবে।
দক্ষিণ এশিয়ার নব অর্থনৈতিক পরাশক্তি বাংলাদেশের নেতৃত্ব দিচ্ছেন বঙ্গবন্ধুর আদর্শের অনুসারী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি পঁচাত্তরের পনেরোই আগস্টের শোককে শক্তিতে পরিণত করেছেন।
আমাদের দায়িত্ব হচ্ছে, শারীরিক ও মানসিকভাবে সরকারের অংশীজন হওয়া। নিরলসভাবে কাজ করা এবং সরকারের ভালো কাজে সমর্থন দেওয়ার মাধ্যমে আমরা বাংলাদেশকে আমূল বদলে দেওয়ার ক্ষেত্রে অংশীজন হতে পারি।
শোক থেকে শক্তি হোক আমাদের ব্রত।
ড. আনোয়ার খসরু পারভেজ ।। গবেষক ও অধ্যাপক, মাইক্রোবায়োলজি বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়