ক্ষমতা গ্রহণের দিন থেকে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন দেশের অভ্যন্তরে বিভিন্ন রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং সামাজিক সমস্যার সম্মুখীন হয়েছে। এছাড়াও বিশ্বে কোভিড-১৯ মহামারি এবং বেইজিংয়ের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের দ্বন্দ্বের মতো ভূ-রাজনৈতিক সমস্যাও রয়েছে। প্রেসিডেন্ট বাইডেন তার কার্যালয়ে সবে মাত্র ছয় মাস অতিবাহিত করেছে। তার সমর্থন প্রথম তিন মাসের গড় ৫৬ শতাংশের চেয়ে কমে ৫৩ শতাংশে গিয়ে ঠেকেছে।

যুক্তরাষ্ট্রের প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের তুলনায় ৫০ শতাংশের আশে পাশে সমর্থন আদায় করা মোটেও খারাপ নয়। ট্রাম্প তার হোয়াইট হাউজের ওভাল অফিসে থাকাকালীন সময়ে কখনোই ৫০ শতাংশ সমর্থন আদায় করতে পারেনি। তাই অত্যধিক বিভক্ত দেশে ৫০ শতাংশের ঊর্ধ্বে থাকাই দেখিয়ে দেয় যুক্তরাষ্ট্র এখনো কতটা বিভক্ত রয়েছে। জো বাইডেন স্থানীয় পর্যায়ে একাধিক কার্যনির্বাহী কর্মপরিকল্পনা প্রণয়নের মাধ্যমে কোভিডের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছে এবং একইসাথে ভ্যাকসিন প্রদান ত্বরান্বিত করেছে।

বাইডেন, ট্রাম্পের সীমান্ত প্রাচীর অথবা মুসলিম দেশ থেকে জনগণ প্রবেশে নিষেধাজ্ঞার মতো নীতিগুলো যা ডেমোক্রেটদের মধ্যে অজনপ্রিয় তা সরিয়ে নিতে কাজ করছে। সে কিছুটা নিজের দলের পক্ষে কাজ করছে। এছাড়াও সে যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতিতে যারা মধ্যপন্থা অবলম্বন করে তাদের পক্ষেও কাজ করছে।

গত ছয় মাস ধরে প্রেসিডেন্ট বাইডেন স্পষ্ট করে জানিয়েছেন, চীনের সাথে ভারসাম্য এবং অবশ্যই বিশ্বব্যাপী যুক্তরাষ্ট্রের মিত্রদের সাথে সম্পর্ক জোরদার করা তার প্রধান পররাষ্ট্রনীতি।

ট্রাম্প কেবলমাত্র তার নীতি ও জনপ্রিয়তা অর্জনের দিকে ঝুঁকেছে যা বাইডেন করেনি। সে তার কিছু বৃহৎ পরিকল্পনা বাস্তবায়নে দৃষ্টিপাত করেছেন। কিন্তু, আপাতত প্রথম ছয় মাসে আমাদের চিন্তা-ভাবনার চেয়ে তাকে আরও বেশি সংস্কারবাদী মনে হয়েছে। সম্ভবত, তার সকল অর্জনের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিল তার দলকে তার পক্ষে রাখা ও একসাথে রাখতে পারা।

গত ছয় মাস ধরে প্রেসিডেন্ট বাইডেন স্পষ্ট করে জানিয়েছেন, চীনের সাথে ভারসাম্য এবং অবশ্যই বিশ্বব্যাপী যুক্তরাষ্ট্রের মিত্রদের সাথে সম্পর্ক জোরদার করা তার প্রধান পররাষ্ট্রনীতি। এর প্রতিক্রিয়ায় চীনা রাষ্ট্রপতি সি চিন পিং বিবৃতি দিয়েছেন যে, বিদেশি অত্যাচারীদের মাথায় আঘাত ও রক্তপাত করানো হবে। চীন সরকার গত শুক্রবার নতুন বিদেশ বিরোধী নিষেধাজ্ঞা আইনের অধীনে সাতজন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছেন। অপরদিকে আমরা দেখেছি যুক্তরাষ্ট্রের উপ-স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী ওয়েন্ডি শেরম্যান সপ্তাহ শেষেই চীন সফরে যাচ্ছেন। এই থেকে প্রতীয়মান হয় যে, কেউ জিজ্ঞাসা করতেই পারে কিসের বিস্তারে দুই দেশের মধ্যে দ্বন্দ্ব আরও তীব্রতর হচ্ছে? চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রী ওয়াং ইয়ের সাথে বৈঠকের উদ্দেশ্য কী ছিল?

সাম্প্রতিক বৈঠক থেকে আমরা দেখতে পাই যে, তারা এইখান থেকে বৃহৎ কিছু অর্জন করতে পারেনি। গত শীতে যুক্তরাষ্ট্রের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী ও প্রতিরক্ষা মন্ত্রীর সফরের মধ্য দিয়ে আমরা দেখেছি আলাস্কাতে কীভাবে সরাসরি এর বিরোধিতা করা হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের জনগণ ধীরে ধীরে এক প্রকার চীন বিরোধী হয়ে উঠছে এবং চীনও এখন একইভাবে জবাব দিচ্ছে।

যুক্তরাষ্ট্রের ৪৪ শতাংশ জনগণ বর্তমানে তাদেরকে স্বাবলম্বী হিসেবে বিবেচনা করছে যা, ২০২২ সালের মধ্যবর্তী নির্বাচনে অর্থনীতি বড় প্রভাবক হিসেবে কাজ করবে...

বাইডেনের পদ্ধতি একটু ভিন্নতর আর এটি অনেক বেশি বহুজাতিক। এটি তাদের মিত্রদের সাথে কাজ করছে। কিন্তু একইসাথে তা অনিশ্চিত। আর তার অন্যতম প্রধান কারণ হলো, যুক্তরাষ্ট্রের মিত্ররা বিশেষত ইউরোপ ও তার নেতারা এক প্রকার এই পরিস্থিতির ঠিক মাঝে অবস্থান করছে। তারা চীনের সাথে অর্থনৈতিক সুসম্পর্ক বজায় রাখতে চায়।

বাইডেন প্রশাসন উত্তর-পশ্চিম অঞ্চলে উইঘুর মুসলমানদের উপর চলমান নিপীড়নকে মানবাধিকার সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করতে চাইলেও ইউরোপের মিত্র দেশগুলো এখনো পুরোপুরি তা করতে পারেনি। তাই একটি চরম সংকটাপন্ন পরিস্থিতি তৈরি হচ্ছে এবং চীন-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ক ধীরে ধীরে নয়া স্নায়ু যুদ্ধে পরিণত হচ্ছে।

আমরা যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে দৃষ্টিপাত করলে দেখতে পাই, যুক্তরাষ্ট্রের ৪৪ শতাংশ জনগণ বর্তমানে তাদেরকে স্বাবলম্বী হিসেবে বিবেচনা করছে যা, ২০২২ সালের মধ্যবর্তী নির্বাচনে অর্থনীতি বড় প্রভাবক হিসেবে কাজ করবে। যদি যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতির চাকা সচল থাকে, যদি তাদের চাকরি থাকে, যদি তারা চাকরিতে নিরাপত্তা পায় তাহলে এটি সম্ভব।

যদি তারা দেখে তাদের অর্থনীতি উন্নতি করছে, তাদের বেতন ঠিকমতো পাচ্ছে তাহলে যেই সরকারে থাকুক, যেই শাসন করুক না কেন তারাই সম্ভবত বেশি ভোট পাবে। যদি বাইডেন অবকাঠামো এবং মানব অবকাঠামো খাতে তার নীতিগত প্রতিশ্রুতি অনুসরণ করতে পারে এবং ২০২২ সাল পর্যন্ত তা চালিয়ে যেতে পারে তাহলে ডেমোক্রেটরা মধ্যবর্তী নির্বাচনে ভালো ফল লাভ করতে পারে। কিন্তু এটি তাদের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ মধ্যবর্তী নির্বাচন কারণ এখানে রয়েছে ‘ট্রাম্প ফ্যাক্টর’। আমরা জানি না তার সাথে কি হতে চলেছে তবে পরবর্তী নির্বাচনে তার একটি বড় প্রভাব থাকবে।

পরিশেষে বলা যায়, যদি বাইডেন দ্বি-দলীয় পদ্ধতিতে সামরিক কাঠামোর বিল পেয়ে যায় তাহলে তা হবে তাদের জন্য বৃহৎ সমস্যা। কারণ হিসেবে বলা যায় এটি তাদের জন্য বৃহৎ কর্মসংস্থান সৃষ্টিকারী। আর যদি তারা তাদের পক্ষে ১০ জন রিপাবলিকানকে টানতে সক্ষম হয় তাহলে তারা কংগ্রেসের গত পাঁচ বছর বা এক দশকেরও বেশি সময় ধরে চলা অস্বাভাবিক পক্ষ অবলম্বনকে অবসান করবে। প্রকৃতপক্ষে এটি অনেক কঠোর হতে যাচ্ছে, কারণ যুক্তরাষ্ট্রের এই মুহূর্তে প্রচণ্ড দরকষাকষি চলছে।

অল্প কিছুদিনের মধ্যেই দ্বি-দলীয় সমর্থন নীতি যুক্তরাষ্ট্রে বিস্তার লাভ করবে। তারপর এটি কমে গিয়ে ৩.৫ ট্রিলিয়ন ডলারের মানব অবকাঠামো উন্নয়নের প্যাকেজ আসবে যা কর, স্বাস্থ্য সুরক্ষা, জলবায়ু নীতিকে অন্তর্ভুক্ত করবে। যদি প্রেসিডেন্ট বাইডেন এটি সমাপ্ত করতে পারে তাহলে বাইডেন সরকারের জন্য তা অত্যন্ত সফল অর্জন হবে। তারা সেটিকে বাজেট সমন্বয় সাধনের আর্থিক রাজস্ব ও যুক্তরাষ্ট্রের অর্থ ব্যয়ের মতো বিষয়গুলোর মাধ্যমে পরিচালনা করে। কংগ্রেসে তাদের অতিরিক্ত সংখ্যাধিক্য এবং রিপাবলিকানদের সমর্থনের প্রয়োজন নেই। কিন্তু বাইডেনের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে এই বিষয়ে নিজের দলকে একত্রে ধরে রাখা।

সামনে অগ্রসর হওয়ার ক্ষেত্রে সব ডেমোক্রেটদের কাছে এটি সর্বোত্তম উপায় নয়। কিন্তু, যদি বাইডেন এই ধরনের উদ্দীপনা পায় আর বিদেশে যুদ্ধ পরিহার করতে পারে তাহলে সামনের বছরগুলোতে বাইডেন ভালো অবস্থানে যেতে পারবে।

মো. শরীফ হাসান ।। শিক্ষক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়