পরীমণির অপরাধ কী?
পত্রিকাগুলোর রম্য ম্যাগাজিন এখন আর বেশি চোখে পড়ে না। একইভাবে চলচ্চিত্রের গল্পে কৌতুক বা হাসির সংলাপও এখন আর মন ভরাতে পারে না। সম্ভবত তাই সাম্প্রতিক ঘটনা থেকে কেউ কেউ খোরাক মিটচ্ছেন। ঘটনা যাই হোক, মতের অমিল, সৌন্দর্যের পার্থক্য অথবা জনপ্রিয়তায় ব্যবধান থাকলেই যাকে তাকে নিয়েই হাসি ঠাট্টার বন্যা বয়ে যায়।
অপরাধ, আইন, বিচার কোনো কিছুর বিবেচনা না করে কদিন যাবৎ চিত্রনায়িকা পরীমণিকে নিয়ে বিভিন্ন মাধ্যমে মানুষের মধ্যে যে ঝড় বয়ে যাচ্ছে তা আসলে কী বার্তা দিচ্ছে? তার অপরাধ নিয়ে আলোচনা হলে কোনো আপত্তি নেই কিন্তু একজন নারী, চিত্রনায়িকা বা অভিজাত জীবন ইঙ্গিত করে যদি সাইবার বুলিং হয় তবে সন্দেহ নেই সৌন্দর্য এবং জনপ্রিয়তা এর পেছনের কারণ। তাদের কাছে নায়িকার অপরাধ বড় নয়!
বিজ্ঞাপন
নায়িকার অপরাধ কী তার বিশ্লেষণ একেবারেই শূন্যের কোঠায়। এত বেশি খিস্তি খেউড়, যেন নায়িকা মানেই অপরাধ! চারদিনের রিমান্ড শেষে আদালতে তোলা হলে পরীমণি সাংবাদিকদের দেখে চিৎকার করে বলেছেন, ‘আপনারা মিডিয়ার লোকেরা কী করছেন? আমাকে মিথ্যা মামলা দিয়ে ফাঁসানো হচ্ছে।’ তার এই বক্তব্যের পর নতুন করে ভাবনায় আসতে পারে পরীমণির বিরুদ্ধে আসলে অভিযোগ কী?
গ্রেফতারের পর সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়েছে, পরীমণির একাধিক প্রেম এবং বিয়ে ছিল, তার বাড়িতে ডিজে পার্টি হতো, প্লেজার ট্রিপে যেত, সমাজের বিভিন্ন ব্যক্তির সঙ্গে তার যোগাযোগ ছিল। এগুলোর কোনটা অপরাধ? যদিও সবশেষে পরীমণিকে গ্রেফতার দেখানো হয়েছে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে।
এ বিষয়ে তার আইনজীবী মজিবুর রহমান শুনানিতে বলেন, ‘তাকে এই আইনে কেন রিমান্ডে নেবেন? যারা মাদক সেবন করেন তাদের শাস্তি দেওয়ার জন্য এ আইন না। তিনি যদি ব্যবসার সাথে জড়িত হন। তবে রিমান্ডের ব্যাপার আসতো।’
পরীমণির বাড়িতে তল্লাশির সময় কোনো মিডিয়াকে প্রবেশ করতে দেওয়া হয়নি। অথচ আইনে বলা আছে, ফৌজদারি কার্যবিধির ১০৩ ধারা (১) অনুযায়ী তল্লাশি চালানোর আগে, প্রস্তুত অফিসার বা অন্য কোনো ব্যক্তি যে স্থানে তল্লাশি চালাবেন সেই এলাকার দুই বা ততধিক সম্মানিত অধিবাসীকে তল্লাশিতে হাজির থাকা ও সাক্ষী হিসেবে আহ্বান জানাতে হবে।
গ্রেফতারের পর সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়েছে, পরীমণির একাধিক প্রেম এবং বিয়ে ছিল, তার বাড়িতে ডিজে পার্টি হতো, প্লেজার ট্রিপে যেত, সমাজের বিভিন্ন ব্যক্তির সঙ্গে তার যোগাযোগ ছিল। এগুলোর কোনটা অপরাধ?
১০৩-এর ধারা (২) অনুযায়ী সাক্ষীদের উপস্থিতিতে তল্লাশি চালাতে হবে। এ সময় উক্ত অফিসার বা অন্য কোনো ব্যক্তি তল্লাশির সময় জব্দকৃত সমস্ত জিনিস এবং যে জায়গায় ওই জিনিসগুলো পাওয়া গেছে, তার একটি তালিকা প্রস্তুত করবেন। সে তালিকায় উক্ত সাক্ষীরা স্বাক্ষর করবেন। যদি এই প্রক্রিয়া উপেক্ষা করা হয় তাহলে জব্দকৃত জিনিস এভিডেন্স হিসেবে আদালতে গ্রহণযোগ্যতা হারাবে।
কারো প্রেম, বিয়ে, সম্পর্ক নিয়ে ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনার (ডিএমপি) শফিকুল ইসলাম জানিয়েছেন, ‘সামাজিক বা ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে বড় অপরাধ হলেও দেশের আইনে আপত্তিকর অবস্থায় কাউকে পেলে মাত্র একশ টাকা জরিমানা করা ছাড়া আর কিছুই করার নেই। ১০ আগস্ট তার কার্যালয়ে সাংবাদিকদের সাথে পরীমণি ও অন্যান্য ইস্যুতে ব্রিফিংকালে তিনি সাংবাদিকদের এসব কথা বলেন।
সদস্যপদ প্রত্যাহারের আগে সমিতির উচিত ছিল, এই সময়ে পাশে থাকা, তার সঙ্গে দেখা করে কথা বলা। কোনো সহযোগিতা দরকার কি না জানার চেষ্টা করা। সংগঠনের দায়িত্বই হচ্ছে তার সদস্যের যেকোনো সংকটে পাশে দাঁড়ানো।
তাহলে পরীমণিকে নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এই ঝড় ওঠার কারণ কী? হুট করেই চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতি থেকেও তার সদস্যপদ স্থগিত হওয়ার হেতু কী?
পরীমণি বিষয়ে চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতির সিদ্ধান্ত ন্যক্কারজনক মনে করেন জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারপ্রাপ্ত পরিচালক আবু সাইয়ীদ। তিনি বলেন, ‘সদস্যপদ প্রত্যাহারের আগে সমিতির উচিত ছিল, এই সময়ে পাশে থাকা, তার সঙ্গে দেখা করে কথা বলা। কোনো সহযোগিতা দরকার কি না জানার চেষ্টা করা। সংগঠনের দায়িত্বই হচ্ছে তার সদস্যের যেকোনো সংকটে পাশে দাঁড়ানো।’ (১১ আগস্ট ২০২১, প্রথম আলো)
প্রখ্যাত চলচ্চিত্র ব্যক্তিত্ব কাজী হায়াৎ বলেছেন, ‘স্মৃতিকে যারা পরীমণি বানিয়েছেন, তারা আজ কোথায়? পরীমণির সৌন্দর্যই পরীমণির শত্রু। এ কারণেই বেশিরভাগ মানুষ তার সান্নিধ্যে গেছেন, যাওয়ার চেষ্টা করেছেন। কাছে যাওয়া এসব মানুষই তাকে বিপথে ঠেলে দিয়েছেন।’
এ অবস্থায় চারদিনের রিমান্ডের পর আরও দুইদিনের রিমান্ড মঞ্জুর করা হয়েছে। মাদক নিয়ে এই আইনি প্রক্রিয়া আর কত লম্বা হবে আমরা জানি না।
আমরা আস্থা রাখি, নিশ্চয়ই আসল সত্য তদন্তে বেরিয়ে আসবে। পরীমণি যদি বিপথগামীই হয়ে থাকেন তবে কারা তাকে এ পথে নিয়েছেন আমরা তাদের চেহারাও দেখতে চাই।
মদ খাওয়াই যদি অপরাধ হয় তবে তার সঙ্গে বসে যারা মদ খেয়েছেন তাদের দেখতে চাই। আইন তার নিজস্ব গতিতে চলবে এবং নায়িকা ন্যায় বিচার পাবে এটি আমরা প্রত্যাশা করি।
আনোয়ার বারী পিন্টু ।। সাংবাদিক