শহর থেকে রাজা হারিয়ে গেছে। কেউ বলছে রাজা চম্পট দিয়েছে। কারো মতে, রাজা আছে আগের মতোই, বিপদ বুঝে অদৃশ্য রূপ নিয়েছে। রাজাদের চরিত্র এমনই, লাম্পট্য ছেড়ে চম্পট দেয়। দায় নিতে হয় রানীর। আদিকাল থেকেই সমাজ, রাষ্ট্র এমন করেই তৈরি হয়েছে। পুরুষ করবে ভোগ। নারী হবে ভোগ্য পণ্য। ভোগ করা শেষে মোড়ক ছুঁড়ে ফেলে দেওয়াই ভোক্তার অভ্যাস বা চরিত্র। রাজন্যগণ তাই করেন। আমাদের রাজারা একই কাজ করে যাচ্ছেন।

শহর, সমাজ, রাষ্ট্র এখন রাজা উৎপাদনের কারখানা। উৎপাদন সূচক ঈর্ষণীয়। এখানে রাজা হওয়াটা ইচ্ছে মাত্র। যেকোনো উপায়ে অফুরান অর্থযোগ মুশকিলের ব্যাপার নয়। অতিক্ষুদ্র কর্মচারী থেকে সর্বোচ্চ পদে থাকা ব্যক্তি একই ফর্মুলা মেনে অফুরান টাকার মালিক হয়ে যাচ্ছে কোনো সোনা-রূপার কাঠির পরশ ছাড়াই।

দুর্নীতি এখন সকলের একমাত্র গন্তব্য। যে যেই অবস্থানে আছে, চাকরি কিংবা ব্যবসা, সেখানে নৈতিকতা শব্দটি আলগোছে মুছে দিয়েছে। মৃত্যু পথযাত্রীকে নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে শুইয়ে রেখে, আন্দাজে ওষুধ দিয়ে বুঝে নিচ্ছে কড়কড়ে নোট। সন্তানের হাতে তুলে দেওয়া হচ্ছে ফাঁস করা প্রশ্ন। নির্মাণে-খাবারে দেওয়া হচ্ছে ভেজাল। বিনিময়ে মুঠোতে ভুট্টার মতো ফুটছে তারল্য।

শহর, সমাজ, রাষ্ট্র এখন রাজা উৎপাদনের কারখানা। অতিক্ষুদ্র কর্মচারী থেকে সর্বোচ্চ পদে থাকা ব্যক্তি একই ফর্মুলা মেনে অফুরান টাকার মালিক হয়ে যাচ্ছে কোনো সোনা-রূপার কাঠির পরশ ছাড়াই।

খুব সহজ, সরলভাবে তারল্য হাতে চলে আসায়, বেসামাল হয়ে পড়ছে নাগরিকেরা। বাড়তি তারল্য তাদের ভোগের উপযোগ বাড়াচ্ছে। কী করে বাড়তি টাকা ভোগ-উপভোগ করা যায়, সেই ফন্দি খুঁজে বেড়ায় তারা।

আদিমকাল থেকেই নারীকে ভোগের চোখে দেখার যে রোগ, সেই রোগ চক্ষু বিজ্ঞান সারিয়ে তুলতে পারেনি। তাই তারা ভোগ- উপভোগের মাধ্যম হিসেবে নারীর দিকেই চোখ ফেলে। ভোগের বড়শিতে আটকাতে চায় নারীকে।

লোভের বড়শিতে, টোপের ফাঁদে ধরা দিচ্ছে কে, শুধুই কি নারী? মোটেও নয়। এখানে নারী-পুরুষে ভেদাভেদ নেই। যখন মানুষ তার যোগ্যতার সামর্থ্য দিয়ে কাঙ্ক্ষিত গন্তব্যে পৌঁছতে পারে না, পথের প্রতিবন্ধকতা ডিঙাতে সহজ পথ খুঁজে কিংবা যার সামর্থ্যেই ঘাটতি আছে, সেই লোভের নকশা তৈরি করে বা নকশার ফাঁদে আটকে যায়। এখানে লেনদেন বা বিনিময় প্রথার রেওয়াজ আছে। সেই বিনিময়ের মুদ্রা হিসেবে ব্যবহার করা হয় নারীকে। পুরুষও যে ব্যবহৃত হচ্ছে না, তা নয়। যদি যৌনতার কথা বলি, সেখানে নারী-পুরুষ উভয়ই এখন পণ্য।

ভোগের আস্ফালন, রোজগারের আফালে ব্যক্তিগত সম্পর্কের মাঝে বিচ্ছিন্নতা তৈরি হয়েছে। ব্যক্তি, সমাজ, পরিবার হয়ে পড়েছে অবসাদগ্রস্ত। সেই অবসাদ থেকে মুক্তি খুঁজতেই হাত বাড়াচ্ছে মাদক ও যৌনতার দিকে।

বেসামাল আয় ও ভোগের আফালও মানুষকে সুখ দিতে পারছে না। এই অসন্তুষ্টি আরও অস্থির করে তুলছে সমাজকে। যার পরিণতি অপরাধ।

সমাজের অলিগলি ডুবে যাচ্ছে অপরাধের অন্ধকারে। সেখানে নারীকে সামনে রেখে লাল আলো জ্বালিয়ে রাখার চেষ্টা করা হয়। সেখানে পুরুষের কোনো অবয়ব চোখে পড়ে না। অথচ সেই বাতিগুলোর সুইচ পুরুষের হাতে। তাদের ইচ্ছেতেই আলো নিভে জ্বলে। কিন্তু দেখা যায় নগর, রাষ্ট্র যখন আড়মোড়া দিয়ে ক্ষণিকের জন্য জেগে ওঠে, তখন সেই অদৃশ্য ছায়াগুলোও হারিয়ে যায়।

বেসামাল আয় ও ভোগের আফালও মানুষকে সুখ দিতে পারছে না। এই অসন্তুষ্টি আরও অস্থির করে তুলছে সমাজকে। যার পরিণতি অপরাধ। সমাজের অলিগলি ডুবে যাচ্ছে অপরাধের অন্ধকারে।

রাষ্ট্রের জানা আছে সেই ছায়াপথ, কিন্তু সেই পথে ভুল করেও হেঁটে যেতে দেখা হয় না কখনো। কারণ সেই পথে দেখা হয়ে যেতে পারে আত্মপ্রতিকৃতির সঙ্গে। তাই ঐ ছায়াপথকে যত্ন করে আড়াল করেই রাখা হয়।

ভোগের বাজারে ‘তারকা’ মোড়কের কাটতি বেশি। সোনালি-রুপালি, ছোট-বড় পর্দায় কোনো ভাবে উঁকি দিতে পারলেই হলো। নক্ষত্রের মতো জ্বলজ্বল করতে থাকে। এই নক্ষত্রদের ভোগের বাজারে বিনিময় মুদ্রা হিসেবে সহজে আদান প্রদান করা যায়। তাই এই জগতের ঝলসানো আলোর লোভ দেখিয়েও, অনেককে এখানে এনে আলোর পোকা বানানো হয়। সব পোকা টিকতে পারে না আলোর তীব্রতায়। পুড়ে ছাই হয়ে যায়।

আমরা বিভিন্ন সময়ে একেকটি এমন পোকা নিয়ে মেতে ওঠার উৎসবের দর্শক হয়ে উঠি। বিনোদিত হই। তাদের পতনে আর্দ্র হয় মন। একের পর এক নাম শহরকে জাগিয়ে তোলে। সেই নামের সুতো যার তর্জনীতে বাঁধা তাকে জানি, দেখি কিন্তু তার নাম উচ্চারণের সাহস হয়ে উঠে না আমাদের।

একের পর এক নক্ষত্রের পতন দেখি, একের পর এক ভোগের মোড়ক খসে পড়ে, কিন্তু কারখানার মালিক, নির্মাতারা হয়ে থাকেন অদৃশ্য রাজা। সময় এসেছে দড়ি ধরে টান দেওয়ার। অপেক্ষায়, তাদের খান খান অবয়ব দেখার।

তুষার আবদুল্লাহ ।। গণমাধ্যমকর্মী