শেখ কামালের শেষ ছোঁয়াটুকুও থাকবে না!
আবাহনী ক্লাবের পাশ দিয়ে গেলেই উঁকি মেরে দেখার চেষ্টা করি, পুরানো ভবনটা অক্ষত আছে কি না। সেদিনও দেখেছি, এখানে ঠাঁই দাঁড়িয়ে শেখ কামালের হাতে গড়া ছোট ভবনটি। শাবলের ঘা এখনো পড়েনি, গুঁড়িয়ে যায়নি শেখ কামালের শেষ ছোঁয়াটুকু।
এদেশের এক স্বপ্নবাজ সংগঠকের স্বপ্নের সারথির শেষ চিহ্ন ওই ঘরটুকু। মারা যাওয়ার আগে এর অর্ধেকটা তিনি করে যেতে পেরেছিলেন। পরে কলেবর বড় করে দোতালা হয়, যেখানে খেলোয়াড়রা থাকেন। নিচে অফিস আর রান্না ঘর। আর মাঠকে সামনে রেখে একটুখানি খোলা বারান্দা, যেখানে বসে কামালের পুরনো বন্ধুরা মাঝে-সাঝে চায়ে চুমুক দিতে দিতে ফেলে আসা স্মৃতি রোমন্থন করেন। স্মৃতিতে তিনি ধরা দেন নানা ভাবে, নানা ভূমিকায়।
বিজ্ঞাপন
মুক্তিযোদ্ধা, ক্রীড়া সংগঠক, গায়ক, সমাজ সংস্কারক এক ক্ষণজন্মা প্রতিভার ভাণ্ডারে সব গুণের সমাহার। তাই তো মাত্র ২৬ বছরের জীবন তার এত রং-মাধুরীতে ভরপুর, যা সতীর্থদের গল্পে হয়ে ওঠে অপরূপ।
কামাল একদিন তার বাবার কাছে যায় একটা প্রস্তাব নিয়ে। সে বলে, যাদের হাতে এই দেশ স্বাধীন হয়েছে তাদের সামলাতে না পারলে নতুন সমস্যা তৈরি হবে। যেভাবে হোক, তরুণদের পড়ার টেবিলে ফেরাতে হবে। খেলা ও সংস্কৃতির সঙ্গে তাদের সম্পৃক্ত করতে হবে।
আবাহনীর প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক হারুনুর রশীদের মুখেই গল্পটি শোনা। মুক্তিযুদ্ধের পর, তখন আবাহনী সমাজ কল্যাণ সমিতি তাদের ক্রীড়াচক্র শাখাটির ওপর বিশেষ জোর দিতে শুরু করে। যুদ্ধের পরও দেশজুড়ে একটা অস্থির অবস্থা। অনেকের হাতে অস্ত্র ছিল এবং ছোটখাটো অঘটনও ঘটছিল।
হারুনুর রশিদ বললেন, ‘এই অবস্থা দেখে কামাল একদিন তার বাবার কাছে যায় একটা প্রস্তাব নিয়ে। সে বলে, যাদের হাতে এই দেশ স্বাধীন হয়েছে তাদের সামলাতে না পারলে নতুন সমস্যা তৈরি হবে। যেভাবে হোক, তরুণদের পড়ার টেবিলে ফেরাতে হবে। খেলা ও সংস্কৃতির সঙ্গে তাদের সম্পৃক্ত করতে হবে। তরুণদের কীভাবে পথে ফেরানো যায় তার ব্যবস্থা করতে হবে সরকারের তরফ থেকে। আমরা ক্লাবে ক্লাবে গিয়ে তরুণদের খেলায় উদ্বুদ্ধ করতে পারি। কিন্তু সরকারকে কিছু ইতিবাচক সার্কুলার দিতে হবে যেন যেকোনো খেলার জাতীয় দলের খেলোয়াড়রা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পারে। আরেকটা হলো, খেলোয়াড়রা চাকরি করলে তাদের অফিস করতে হবে না। বঙ্গবন্ধুও প্রস্তাবগুলোও খুব ইতিবাচকভাবে নিয়েছিলেন’।
শেখ কামালের মাথায় নতুন দেশ গড়ার চিন্তা কিন্তু তহবিল ফাঁকা আবাহনী ক্রীড়াচক্রের। খেলোয়াড়দের জন্য বাজার খরচের টাকাও নেই। ‘সবাই চাঁদা দিয়েই ক্লাব চালাতাম। আমার নিজের ব্যবসাও লাটে ওঠার পথে। ক্লাবের অবস্থাও ভাল নয়। তাই রাগ করে আমি কয়েকদিন আর ক্লাবমুখো হইনি। সেটা বুঝতে পেরে একদিন কামাল আমাদের বাড়ির সামনে এসে গান ধরে, ‘ডাক দিয়াছেন দয়াল আমারে ...।’ তারপর চিৎকার-চেঁচামেচি। তখন আর রাগ করে বসে থাকা যায় না। সে বয়সে আমার ছোট হলেও তার মধ্যে একটা অদ্ভুত সম্মোহনী ব্যাপার ছিল। তার সঙ্গে একবার যারা মিশেছে তারা আর সেই সঙ্গ ছাড়তে পারেনি’—সেই সম্মোহনে আবাহনীর হারুনুর রশিদের হয়েছে সাংগঠনিক উত্তরণ।
অর্থ সংকট থাকলেও কখনো নিজের ক্লাবের জন্য বঙ্গবন্ধুর দ্বারস্থ হননি শেখ কামাল। উল্টো বাবাকে বলে প্রতিদ্বন্দ্বী ক্লাবে সাহায্যের ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। বঙ্গবন্ধু স্বাক্ষরিত অনুদানের চেকটির ফটোকপি দীর্ঘদিন ছিল ব্রাদার্স ক্লাবে। অন্যদিকে, নিজের ক্লাবের আয়ের জন্য বের করতেন অভিনব সব উপায়।
সেই আমলে সার্কাসের খুব চল ছিল। শেখ কামালের ভূত চাপে একটা সার্কাস শো করতে হবে আবাহনীর তহবিল গঠনের জন্য। ১৯৭৫ সালে জুলাই মাসে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে হয় সেই শো। সেখান থেকে আয় হয়েছিল চার হাজার চুয়াল্লিশ টাকা যার হিসাব-নিকাশ এখনো ক্লাবে আছে!
কামালের মাথায় আসলেই নিত্যনতুন চিন্তা ঘুরপাক খেত। অথচ বিত্তশালীরা তার আশেপাশে ঘুরত টাকা নিয়ে। তিনি ‘হ্যাঁ’ বললেই ক্লাবের তহবিল ফুলে-ফেঁপে ওঠে। কিন্তু তাদের কখনো স্বাগত জানাননি কামাল। একবার এক ব্যবসায়ী জোর করে একটা চেক ধরিয়ে দিয়েছিলেন, সেকথা বাবার কাছে বলতেই বঙ্গবন্ধু ক্ষেপে যান। পরে তিনি সেই চেক ফেরত দিয়ে আসেন ব্যবসায়ীর কাছে।
অর্থ সংকট থাকলেও কখনো নিজের ক্লাবের জন্য বঙ্গবন্ধুর দ্বারস্থ হননি শেখ কামাল। উল্টো বাবাকে বলে প্রতিদ্বন্দ্বী ক্লাবে সাহায্যের ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। বঙ্গবন্ধু স্বাক্ষরিত অনুদানের চেকটির ফটোকপি দীর্ঘদিন ছিল ব্রাদার্স ক্লাবে।
এই ক্লাব নিয়ে তার স্বপ্ন ছিল অনেক বড়, একদম ইউরোপীয় কায়দায়। ২৩ বছরে বয়সে শেখ কামাল আবাহনীর প্রথম ফুটবল দল গড়েন। সেই স্মৃতি টেনে আবাহনীর প্রথম অধিনায়ক আবদুস সাদেক বলেন, ‘ক্লাব চালানোর ব্যাপারে তার দারুণ সব চিন্তা ছিল। এই ক্লাবের কয়েক হাজার সদস্য তৈরি করা হবে যারা বার্ষিক চাঁদা দেবে। পাশাপাশি ক্লাবের আয়েরও ব্যবস্থা হবে এবং সেই টাকা দিয়ে ভালোভাবে চলে যাবে। ওসব কথা মনে পড়লে আক্ষেপ হয়, কী অসম্ভব উদ্যোগী আর উদ্ভাবনী শক্তি ছিল এই তরুণের মধ্যে।’ এরকম ভাবনা সেই সত্তরের দশকে এক বাঙালি তরুণের মাথায় ছিল এটা বিস্ময়কর মনে হয়।
এই তরুণের বিদায়ের সঙ্গে সঙ্গে আবাহনীর উদ্যোগে ভাটা পড়ে। শেখ কামাল যতটুকু আধুনিক করে গিয়েছিলেন ততটুকুতেই থেমে গিয়েছিল উন্নয়ন।
এখন আবার শুরু হয়েছে ক্লাবের বিশাল কমপ্লেক্সের কাজ। তার বিশালত্বে নাকি জায়গা হবে না কামালের হাতে গড়া সেই অফিস ঘরটির। অথচ উন্নত বিশ্ব হলে এটিই হতো অমূল্য—ক্লাবের ঐতিহ্য, ক্লাবের জাদুঘর। কিন্তু এখানে কমপ্লেক্সের নকশায় সেই সুযোগ নেই। হায়রে কমপ্লেক্স! তার খবর শুনে এই ঘর যদি অস্ফুটে বলে ওঠে—
'বড় দালান হয়ে তুই আকাশ ছুঁবি।
তোর অঙ্গে আধুনিকতার রূপ হবে।
তাই বলে আমাকে ভুলে যাবি?
আমার কুঁড়েঘর থেকেই যে হবে তোর মহা দালান।
কিন্তু আমার স্রষ্টা যে শেখ কামাল।'
সনৎ বাবলা ।। সাংবাদিক