অবশেষে গ্রেপ্তার হয়েছেন হেলেনা জাহাঙ্গীর। বেশ কয়েক বছর ধরে তিনি এতোই আলোচিত যে, নাম বললে তার আর কোনো পরিচয় দেওয়া লাগে না। প্রায় সব মহলে তিনি শুধু নামেই পরিচিত।

শুধু নামেই যাদের পরিচয় তাদের একটা সুবিধা হলো, কিছু অনুসন্ধিৎসু মানুষ ছাড়া কেউই তাদের অতীতের খোঁজ নিতে আগ্রহী হন না, ভবিষ্যৎ সম্পর্কে তো ভাবেনই না। এই সুযোগে উচ্চাকাঙ্ক্ষী মানুষগুলো নানা স্তরে নিজেদের প্রভাব-প্রতিপত্তি বাড়িয়ে সমাজে প্রভাবশালী হয়ে ওঠে। গুরুত্ব বাড়াতে নিজেকে ক্ষমতাবানদের কাছের লোক প্রমাণে সব সময় তৎপর থাকে। কখন কে বা কোন দল রাষ্ট্রক্ষমতায় থাকলো—সেটা বিষয় নয়, সব সময়ই এরা সুবিধাবাদী ও সুবিধাভোগী।

আর ক্ষমতায় বা ক্ষমতাবলয়ের গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে থাকা ব্যক্তিদের কেউ কেউ, কখনোবা অধিকাংশই, মোসাহেব পরিবেষ্টিত হয়ে ক্ষমতা উপভোগ করতে গিয়ে বিচারবুদ্ধি হারিয়ে ফেলেন। এই সুযোগটাই কাজে লাগায় ওই সুবিধাবাদী ব্যক্তি বা গোষ্ঠী। দামি উপঢৌকন দিয়ে, বিশেষ পার্টির আয়োজন করে, তোষামোদি করে এরা ক্ষমতাসীনদের কাছের মানুষ হয়ে ওঠে। এরপর একজনের নাম ব্যবহার করে আরেকজনের কাছ থেকে এবং আরেকজনের নাম করে অন্যজনের কাছ থেকে সুবিধা গ্রহণ করে। এই প্রবণতার সাম্প্রতিক উদাহরণ হলো তথাকথিত রিজেন্ট গ্রুপের শাহেদ কিংবা হেলেনা জাহাঙ্গীর।

অবশ্য মহাপ্রতারক শাহেদ আর হেলেনা জাহাঙ্গীরের উত্থানের গল্পটা হুবহু এক নয়। বাবা ও স্বামীর সূত্রে আগে থেকেই বেশ সম্পদের মালিক ছিলেন হেলেনা জাহাঙ্গীর। তৈরি পোশাক খাতে ব্যাকওয়ার্ড লিঙ্কেজের ব্যবসা করে উদ্যোক্তা হিসেবেও মোটামুটি সফল। এসব নিয়ে থাকলেও মন্দ চলত না তার জীবনটা। কিন্তু এতে চলবে কেন, তিনি যে অতি উচ্চাকাঙ্ক্ষী! যত দ্রুত সম্ভব বড় হতে হবে, জায়গা করে নিতে হবে ক্ষমতার বলয়ে—এই উচ্চাকাঙ্ক্ষাই তাকে বেপরোয়া করে তোলে। নাম, যশ, ক্ষমতা লাভের জন্য কী করেননি তিনি?

হেলেনা জাহাঙ্গীর প্রথম নজর কাড়েন ঢাকা শহরের দেয়ালে দেয়ালে একটি পোস্টার সেঁটে। ‘সিস্টার হেলেন’ নাম দিয়ে নিজের বিশাল ছবি সম্বলিত সেই পোস্টারটিই তার সস্তা পরিচিতির আকাঙ্ক্ষার প্রথম প্রমাণ।

হেলেনা জাহাঙ্গীর প্রথম নজর কাড়েন ঢাকা শহরের দেয়ালে দেয়ালে একটি পোস্টার সেঁটে। ‘সিস্টার হেলেন’ নাম দিয়ে নিজের বিশাল ছবি সম্বলিত সেই পোস্টারটিই তার সস্তা পরিচিতির আকাঙ্ক্ষার প্রথম প্রমাণ। এরপর থেকে কীভাবে আলোচনায় আসা যায়, কত দ্রুত উপরে উঠা যায়—সেই চেষ্টাই চালিয়ে গেছেন হেলেনা জাহাঙ্গীর। এ কারণেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অসংলগ্ন, অশ্লীল ও অসামাজিক কথাবার্তা বলে মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণকারী সেফাতউল্লাহ ওরফে সেফুদার সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে তুলেছেন।

একটি বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলের মালিকের সঙ্গীত সাধনা নিয়ে দেশজুড়ে হাস্যরসের সৃষ্টি হলে হেলেনা জাহাঙ্গীর তার সাথে গান গাওয়ার আগ্রহ ব্যক্ত করেছেন। ফেসবুকে যখন তখন বিতর্কিত স্ট্যাটাস দিয়েছেন। নিজেকে সব সময় আলোচিত দেখার আকাঙ্ক্ষা থেকে তিনি হয়ে উঠেছিলেন বেপরোয়া। আরও বেশি আলোচনায় থাকতে, ক্ষমতার আরও কাছে পৌঁছতে খুলে বসেছেন অনলাইন টেলিভিশন চ্যানেল। সেই চ্যানেল ব্যবহার করে চাঁদাবাজি, নিয়োগ বাণিজ্যসহ নানা অপকর্মের মাধ্যমে সাংবাদিকতাকে কলুষিত করেছেন।

এত কিছুর পরও হেলেনা জাহাঙ্গীরের ক্ষমতার লোভ থামেনি। পদের নেশায় পেয়ে বসে তাকে। নানা সংগঠনে নানা পদ বাগিয়ে নিয়েছেন। হয়েছেন অন্তত এক ডজন অভিজাত ক্লাবের সদস্য। যেন সব জায়গায় তাকে থাকতেই হবে, সবকিছু তাকেই হতে হবে। এ হলো যশের নেশা, নামের জন্য উন্মাদনা।

যোগ্যতার অতিরিক্ত পেয়ে পেয়ে ইতিমধ্যে নিজের সম্পর্কে তার তৈরি হয়েছে উচ্চ ধারণা। আরও পদ, আরও ক্ষমতা এবং আরও দাপটের জন্য হয়ে উঠেছেন মরিয়া।

এসব করে হেলেনা জাহাঙ্গীর যে ব্যর্থ হয়েছেন, তা কিন্তু নয়। দেশের ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই’র পরিচালক পদে জায়গা করে নেওয়া তো আর সহজ কথা না! ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের উপ-কমিটিতে স্থান পাওয়া একেবারে সাধারণ বিষয় না। এরপরও হেলেনা জাহাঙ্গীর থামেননি। কারণ যোগ্যতার অতিরিক্ত পেয়ে পেয়ে ইতিমধ্যে নিজের সম্পর্কে তার তৈরি হয়েছে উচ্চ ধারণা। আরও পদ, আরও ক্ষমতা এবং আরও দাপটের জন্য হয়ে উঠেছেন মরিয়া। যোগ্যতা ছাড়াই কেউ যখন এফবিসিসিআই’র পরিচালক হয়ে যান, কোনোদিন রাজনীতি না করেই যখন আওয়ামী লীগের মতো দলের কেন্দ্রীয় উপ-কমিটিতে জায়গা পেয়ে যান, সারা জীবন দু’অক্ষর না লিখেই সাংবাদিকতার এক্রিডিটেশন কার্ড পেয়ে যান কিংবা চ্যানেলের মালিক বনে যান, তখন তো তিনি যে সংসদ সদস্য পদে মনোনয়ন চাইবেন- এ আর অবাক হওয়ার কী!

দ্রুত উপরে ওঠার জন্য উপ-কমিটি ধরে বসে থাকলেও তো তার চলবে না! হতে হবে ‘লীগ’ধারী কোনো দোকানের শীর্ষ নেত্রী! নিজের চ্যানেলে সাংবাদিক নিয়োগ বাণিজ্যের মাধ্যমে মোটা অংকের অর্থ হাতিয়ে নেওয়ার পর ‘চাকরিজীবী লীগ’-এর নানা পদে নিয়োগের ঘোষণাকেও চমক বলা যায় না। তবে এবার আর সামলাতে পারলেন না! সমালোচনার মুখে প্রথমে হারালেন পদ। এরপর হলেন আটক। যাদের তোষামোদ করে এতটা উপরে উঠেছেন, আর তাকে তোষামোদ করে যারা বাস্তবতা ভুলে গেছেন তাদের এখন আর খুঁজেও পাওয়া যাবে না। বারবার আড়ালেই থেকে যাবে হেলেনা জাহাঙ্গীর বা শাহেদদের উত্থানের নেপথ্য কারিগররা!

প্রশ্ন হলো, হেলেনা জাহাঙ্গীরের মতো মানুষেরা কেন হঠাৎ হঠাৎ এমন গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠেন? এর কারণ আর কিছুই না, ক্ষমতার বলয়ে থাকা কারো কারো বা অধিকাংশের মধ্যে যখন আদর্শের চর্চা থাকে না তখন তাদের মাধ্যমে ক্ষমতাবান হয়ে উঠে নষ্ট, ভ্রষ্ট, দুষ্টু লোকেরা।

ক্ষমতা হারানোর আতঙ্কে যোগ্য লোকদের দূরে ঠেলে অযোগ্য মোসাহেবদের গুরুত্বপূর্ণ করে তোলা হলে দেখা দেয় এমন অবস্থা। রাজনীতিতে নীতি-আদর্শের সঠিক চর্চা থাকলে, ক্ষমতায় থেকে জনগণের কল্যাণই একমাত্র কামনা হলে, রাষ্ট্র পরিচালনায় যোগ্যদের সঠিক মূল্যায়ন হলে নাম-যশের মোহে পাগল হয়ে ওঠা সুবিধাভোগীরা এমন গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে না।

হেলেনা জাহাঙ্গীরের উত্থান ও বিপর্যয় (এখনই পতন বলে দেওয়া যাবে কি না নিশ্চিত নই) থেকে ক্ষমতার কাছাকাছি থাকা ব্যক্তিরা কতটা শিক্ষা গ্রহণ করবেন তার উপর নির্ভর করছে ভবিষ্যতে এসব ঘটনার পুনরাবৃত্তি। আর নিজের সীমা না বুঝে যারা নাম-যশের মোহে মেতে আছেন, তাদের জন্যও শিক্ষা হতে পারে হেলেনা জাহাঙ্গীর। অবশ্য এ ধরনের মানুষগুলোর সে বোধশক্তি আছে কি না তা নিয়েই আছে সন্দেহ!

রাজু আহমেদ ।। সাংবাদিক