পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে বৈষম্য রন্ধ্রে রন্ধ্রে
বিশ্ববিদ্যালয় কি শুধু জ্ঞানার্জনের জায়গা? অবশ্যই নয়। জ্ঞানার্জনের পাশাপাশি মানবিকতা, উদার হওয়া, বৈষম্য না করা শেখানো হয় এখানে। যেই জায়গায় বৈষম্য দূরীকরণ শেখানো হয় সেই জায়গায় বিজ্ঞপ্তি দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়কে আলাদা করে বৈষম্য দেখানো হয়েছে। বলা হয়েছে, প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর পাস করলে সরাসরি পিএইচডির জন্য আবেদন করা যাবে না। তাদেরকে আগে এমফিল করতে হবে। বিষয়টা এমফিল করা না করা নিয়ে নয়। বিষয়টা বর্ণবাদী মানসিকতা নিয়ে। গায়ের রং কালো বলে আগে পশ্চিমা সাদারা যেমন আচরণ করত, পিএইচডি ভর্তি নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আচরণ অনেকটা সেরকমই।
কে কোথা থেকে পাস করেছে না দেখে কার মান কেমন সেটা দেখে তারপর পদক্ষেপ নেওয়া উচিত। সকলের জন্য একটি পিএইচডি মূল্যায়ন কমিটি থাকতে পারে। সেই মূল্যায়ন কমিটি দেখবে কে সরাসরি পিএইচডি করার যোগ্য আর কার জন্য পিএইচডির আগে এমফিল করা দরকার।
বিজ্ঞাপন
সবচেয়ে বড় কথা হলো, পিএইচডি করাবেন একজন শিক্ষক যিনি হবেন তার সুপারভাইজার। সেই মানুষটাই সবচেয়ে ভালো নির্ধারণ করতে পারবেন কাকে তিনি পিএইচডির তদারকি করবেন আর কাকে করবেন না। তারপর আছে বিভাগীয় একাডেমিক কমিটি, এরপর আছে অনুষদের মান নির্ণায়ক পিএইচডি কমিটি। এত কিছু থাকতে ঢালাওভাবে বলা হলো, প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করা শিক্ষার্থীরা সরাসরি পিএইচডি করতে পারবে না।
একটা নির্দিষ্ট গোষ্ঠীকে আগে এমফিল করতে হবে, কারণ তাদের মান ভালো না। আর এমফিল করলে সব ধুয়ে মুছে মান ভালো হয়ে যাবে এমন ভাবার কোনো কারণ নেই। আমাদের পিএইচডির মান নিয়েই তো কত শত গল্প আছে।
প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষার্থী আছে যাদের ভালো যোগ্যতা আছে। তাদের এমফিলের নামে দুটি বছর কেন জীবন থেকে নিয়ে নেওয়া হবে? আর আমাদের ৩+১ থেকে ৪+১ আসার পর থেকে এমফিল ডিগ্রি এমনিতেই অপ্রয়োজনীয় হয়ে গেছে। এটাকে আর কোনো গুরুত্বপূর্ণ ডিগ্রি হিসেবে ধরা হয় না।
স্নাতকোত্তর পাস করার পর চাকরি হচ্ছে না। ঘরে বসে না থেকে একটা সার্টিফিকেট নিয়ে নেওয়া অথবা সরকারি চাকরিতে বা কলেজে শিক্ষকতা করতে এমন অনেকেই এমফিল করত। কারণ এতে এক্সট্রা পয়েন্ট পেয়ে প্রমোশন পেতে সুবিধা হয়। এছাড়া এর তেমন কোনো গুরুত্ব নেই।
ইউরোপ, আমেরিকাতে পিএইচডিতে ভর্তি হয়েও দেখা যায় অনেকে পিএইচডি ডিগ্রি পাওয়ার মতো মানসম্পন্ন কাজ করেনি। তখন শিক্ষার্থীকে একটি স্নাতকোত্তর ডিগ্রি দিয়ে ছেড়ে দেওয়া হয়। আমরাও প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের পিএইচডিতে নিতে পারি। যদি দেখা যায় পারছে না, তখন হয় কোনো ডিগ্রি ছাড়া কিংবা একটা এমফিল ডিগ্রি দিয়ে ছেড়ে দেওয়া যায়।
একটা নির্দিষ্ট গোষ্ঠীকে আগে এমফিল করতে হবে, কারণ তাদের মান ভালো না। আর এমফিল করলে সব ধুয়ে মুছে মান ভালো হয়ে যাবে এমন ভাবার কোনো কারণ নেই। আমাদের পিএইচডির মান নিয়েই তো কত শত গল্প আছে। অনেক ক্ষেত্রে চৌর্যবৃত্তির অভিযোগ আছে, কখনো কখনো নীলক্ষেত থেকে থিসিস লেখানোর অভিযোগ পাই। নিজেদের মানই যেখানে প্রশ্নবিদ্ধ সেখানে অন্যদের এইরকম ঢালাওভাবে অযোগ্য বলে ঘোষণা দেওয়া কোনো অবস্থাতেই ঠিক নয়।
ধরুন হার্ভার্ড, এমআইটি কিংবা বিশ্বসেরা অনেক বিশ্ববিদ্যালয় বলে দিল বাংলাদেশ থেকে পাস করা গ্রাজুয়েটরা সরাসরি পিএইচডি প্রোগ্রামে ভর্তি হতে পারবে না। তাদেরকে আগে ওখানে স্নাতকোত্তর করে প্রমাণ দিতে হবে যে তারা পিএইচডির যোগ্য। কেমন হতো তখন?
তারা এইরকম কখনো করবে না। আমাদের এখান থেকে অনেকেই ৪ বছরের স্নাতক শেষ করে সরাসরি পিএইচডি করেছে। অনেকে এখান থেকে স্নাতকোত্তর করে পিএইচডি প্রোগ্রামে সরাসরি ভর্তি হয়েছে। অনেকে আবার এখানে স্নাতকোত্তর করেও ওখানে দ্বিতীয় আরেকটি স্নাতকোত্তর করে তারপর পিএইচডি করছে। এটা আগে থেকে কোনো দেশ বা কোনো প্রতিষ্ঠান নির্দিষ্ট করে দেয় না।
আমাদের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় কি কেবলই পিএইচডির ক্ষেত্রে এমন বৈষম্য দেখায়? তা কিন্তু নয়। আমরা শিক্ষক নিয়োগেও একইরকম বৈষম্য দেখাই। একরকম অলিখিত নিয়ম হয়ে গিয়েছে যে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে কেবল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর সম্পন্নরাই নিয়োগ পাবে। অর্থাৎ রাজশাহী, জাহাঙ্গীরনগর, চট্টগ্রাম কিংবা দেশের অন্য কোনো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক সম্পন্নদের ব্যতিক্রম ছাড়া সাধারণত নেওয়া হয় না বললেই চলে। বিশ্ববিদ্যালয় নামধারী হয়ে এইরকম ক্ষুদ্র মানসিকতা আমরা কীভাবে পোষণ করি, তা আমার বোধে আসে না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শ্রেষ্ঠ সময়টা কখন ছিল? যখন এখানে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করা অনেকেই শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পেয়েছিল।
আমরা শিক্ষক নিয়োগেও একইরকম বৈষম্য দেখাই। একরকম অলিখিত নিয়ম হয়ে গেছে যে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে কেবল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর সম্পন্নরাই নিয়োগ পাবেন।
যখন থেকে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় মোটা দাগে কেবল পাস করা নিজস্ব শিক্ষার্থীদের শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া শুরু করে তখন থেকেই এর মান নামতে শুরু করে। এই কথা সত্য বাংলাদেশের সকল পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে। এই বিষয়টা ইতিমধ্যেই প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে সংক্রমিত হওয়া শুরু করেছে। অথচ উন্নত দেশে বিশ্বমানের বিশ্ববিদ্যালয়ে তাদের নিজেদের গ্রাজুয়েটদের নিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়োগ দিতে নিরুৎসাহিত করা হয়। তারা চায় তাদের গ্র্যাজুয়েটরা অন্যত্র ছড়িয়ে পড়ুক।
কেবলই কি শিক্ষক নিয়োগে বৈষম্য? আমরা আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ভিসি-প্রোভিসি নিয়োগেও একই কাজ করি। অন্তত ৭৩ এর অধ্যাদেশে চালিত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে কেবল নিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরাই ভিসি-প্রোভিসি হন। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে একবার ব্যতিক্রম ঘটেছিল। সেখানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. আনোয়ার হোসেনকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল। অথচ বিশ্বেরসেরা বিশ্ববিদ্যালয়ে সাধারণত ওপেন সার্চ কমিটির মাধ্যমে ভিসি নিয়োগ দেওয়া হয়। সেখানে নিজের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের নিয়োগের কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। সত্যি বলতে কী, তারা চেষ্টা করে বাহির থেকে কাউকে নিতে। যেমন ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর ক্যামব্রিজের দায়িত্ব নেওয়ার আগে কানাডিয়ান প্রধানমন্ত্রীর একটি ফাউন্ডেশনের প্রধান, ব্রিটিশ কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রেসিডেন্ট ছিলেন। তারপর ২০১৭ সালে ২৬৪তম ভাইস চ্যান্সেলর হিসেবে ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেন।
একটা জিনিস মনে রাখতে হবে, এইসব বিশ্বসেরা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসিরা কিন্তু কেবলই প্রশাসনিক দায়িত্ব পালন করেন। শিক্ষক নিয়োগ বা প্রমোশনে তাদের তেমন কোনো ভূমিকা থাকে না। আমরা যদি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এই বিষয়টি চালু করতে পারতাম তাহলে বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্ধেক সমস্যার এমনিতেই সমাধান হয়ে যেত।
এছাড়া একটি শক্তিশালী পিএইচডি প্রোগ্রামই পারে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের মানকে উন্নত করতে। প্রশ্ন হলো, শক্তিশালী পিএইচডি প্রোগ্রাম বলতে কী বুঝি? পিএইচডি যারা করবে তারা ইতিমধ্যেই স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করে ফেলেছে। এই সময়ে বাবা মায়েরা আশা করে সন্তান চাকরি করবে। শিক্ষার্থী এই সময় বাবা মায়ের কাছ থেকে টাকা নিতে চায় না আর বাবা মায়েরাও দিতে পারে না। তাই ন্যূনতম একজন প্রভাষকের বেতনের সমান মানের একটা ফেলোশিপ তাদের দেওয়া যেতে পারে।
অনেকে আবার বিবাহিত হতে পারে। বিবাহিত হলে তাদের জন্য আবাসিক ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। বিবাহিত হলে স্ত্রী নিয়ে থাকার ব্যবস্থা রাখতে হবে। এছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের যে শিক্ষক সুপারভাইজার হবেন তার অধীনে একজন পোস্ট-ডক নিয়োগ দিলে পিএইচডি প্রোগ্রামটা ভালো হবে। এই পোস্ট-ডক ফেলোশিপের মানও আন্তর্জাতিক মানের হতে হবে।
পিএইচডির কাজের মূল্যায়নের জন্য আন্তর্জাতিক মানের এক্সটারনাল নিয়োগ দিতে হবে। তবেই কেবল একটি বিশ্ববিদ্যালয় সত্যিকারের বিশ্ববিদ্যালয় হবে। উপরোক্ত বিষয়গুলো যদি আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো আমলে নেয়, আমি বিশ্বাস করি আমাদের উচ্চশিক্ষার মান আরও বৃদ্ধি পাবে।
ড. কামরুল হাসান মামুন ।। অধ্যাপক, পদার্থবিজ্ঞান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়