এবারের উচ্চ মাধ্যমিকে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যে সর্বোচ্চ নম্বর পেয়েছেন রুমানা সুলতানা নামের এক ছাত্রী। রুমানা মুর্শিদাবাদ জেলার কান্দি রাজা মনীন্দ্রচন্দ্র উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ের ছাত্রী। আমার জানা মতে, পিছিয়ে পড়া গোত্র মুসলিম হিসেবে মাধ্যমিক বা উচ্চমাধ্যমিক স্তরে মুসলিম কোনো শিক্ষার্থী হিসেবে সর্বোচ্চ স্থান পাওয়ার ঘটনা এটাই প্রথম। তাই তাকে নিয়ে উচ্ছ্বাস চলছে কদিন ধরে। পাশাপাশিই শুরু হয়েছে বিতর্ক। বিতর্ক হলো, তার ফলাফল নিয়ে বলতে গিয়ে ‘মুসলিম’ বলে পরিচয় দেওয়া।

আনন্দবাজার পত্রিকা থেকে জানা যায়, উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার ফলাফল ঘোষণা করতে গিয়ে উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা সংসদের প্রধান মহুয়া দাস বলেছিলেন, ‘সর্বোচ্চ নম্বরের ভিত্তিতে একটা ইতিহাস সংসদে হয়েছে। সেটা একটু বলতে ইচ্ছে করছে। যিনি সর্বোচ্চ নম্বর পেয়েছেন একা।’ এর পরেই মহুয়া বলেন, ‘এককভাবে সর্বোচ্চ নম্বর পেয়েছেন এক মুসলিম কন্যা। তিনি ৫০০ এর মধ্যে এককভাবে ৪৯৯ সর্বোচ্চ নম্বর পেয়েছেন।’

পুরো ভারত তথা পশ্চিমবঙ্গে মুসলমানদের গণ্য করা হয় একটি পিছিয়ে পড়া জাতি বা গোত্র হিসেবে। ভারতে লেখাপড়ার সূত্রে অবস্থানের সময় অনেক কিছুর সাথে মুসলিমদের সম্পর্কে বারবার চারটি বিষয় ভাঙা রেকর্ডের মতো বিভিন্ন ব্যক্তি ও মাধ্যমের কাছ থেকে আমাকে শুনতে হয়েছে বহুবার।

নজরুল এ সমাজ থেকে শিক্ষা নিয়ে একথা মনে প্রাণে বিশ্বাস করতেন হিন্দু-মুসলমানের ঐতিহ্যকে সমান গুরুত্ব না দেওয়া পর্যন্ত বাংলার শিক্ষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতির প্রকৃত বিকাশ সম্ভবপর নয়।

এক, মুসলিমরা অশিক্ষিত। দুই, ওরা অনেকগুলো করে বিয়ে করে। তিন, ওরা অনেক বাচ্চা পয়দা করে। চার, মুসলমানরা নোংরা থাকে ইত্যাদি। তাই এই বাংলার সন্তান হিসেবে কাজী নজরুল ইসলাম এখানো প্রাসঙ্গিক। নজরুল এ সমাজ থেকে শিক্ষা নিয়ে একথা মনে প্রাণে বিশ্বাস করতেন হিন্দু-মুসলমানের ঐতিহ্যকে সমান গুরুত্ব না দেওয়া পর্যন্ত বাংলার শিক্ষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতির প্রকৃত বিকাশ সম্ভবপর নয়। তিনি তার জীবন পণ সর্বস্ব করে সারা জীবন ধরে হিন্দু-মুসলমানের মিলনের গান গেয়েছেন একান্ত আন্তরিকভাবেই। তাই তিনি লিখতে থামেননি—

‘হিন্দু না ওরা মুসলিম? ওই জিজ্ঞাসে কোন জন?
কান্ডারী! বল, ডুবিছে মানুষ, সন্তান মোর মার’

অথবা,

গাহি সাম্যের গান-
মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই, নাহি কিছু মহীয়ান,
নাই দেশকাল-পাত্রের ভেদ, অভেদ ধর্মজাতি,
সব দেশে, সব কালে, ঘরে ঘরে তিনি মানুষের জ্ঞাতি।’

ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক সরকার কর্তৃক ভারতের ১৮১১ সালের আদমশুমারিতে প্রথমবারের মতো সাম্প্রদায়িক (ধর্মীয়) অনুষঙ্গ অনুযায়ী জনসংখ্যা গণনার নীতি গ্রহণ করা হয়েছিল। এই আদমশুমারি ধর্মীয় ধর্মান্তরের বিতর্কিত ইস্যুতে দৃষ্টি নিবদ্ধ করেছিল, কারণ W. W. Hunter এর মতো ঐতিহাসিকরা পূর্ব ভারতের বাসভূমিতে মুসলিম জনগণের বিশাল উপস্থিতি ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছিলেন। এটাও বোঝার চেষ্টা হয়েছিল, যে মুসলমানরা হিন্দুদের সর্বনিম্ন স্তর থেকে ধর্মান্তরিত হয়ে একটি বাঙালি সমাজ গঠন করেছিল তার চরিত্র কীরূপ ছিল। সেই অনুযায়ী, বাংলার মুসলমানরা উচ্চ-শ্রেণির হলে আশরাফ এবং নিম্ন-শ্রেণির হলে আজলাফ বা আতরাফ গোত্রে বিভক্ত ছিল। এই বিভাগগুলো অনুমিত জাতিগত এবং ভাষাগত পার্থক্যের ভিত্তিতে ছিল।

বাঙালি হিন্দু ও মুসলিম সমাজের মধ্যে একটি প্রাথমিক পার্থক্য ছিল উচ্চ ও নিম্ন শ্রেণির মুসলমানদের মধ্যে সত্যিকারের যোগসূত্রের অভাব। ব্রিটিশ পৃষ্ঠপোষকতায় হিন্দু-বাঙালি বুদ্ধিজীবীদের উত্থান উচ্চ ও নিম্ন বর্ণের হিন্দু-বাঙালিদের মধ্যে স্থিতিশীল যোগসূত্র হিসেবে কাজ করেছিল। একটি আদিবাসী পেশাদার শ্রেণির উত্থান, যা ব্রিটিশ এবং বাঙালি হিন্দুদের মধ্যে সাংস্কৃতিক মধ্যস্থতা হিসেবে কাজ করেছিল।

গবেষক ড্যানিয়েল লার্নারের ভাষায়, তৎকালীন এই ধারাকে অব্যাহত রাখতে আরও কিছু সামাজিক, সাংস্কৃতিক সংগঠন প্রতিষ্ঠা এবং এতে সক্রিয় অংশগ্রহণের উৎসাহ প্ৰয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছিল তাই এই মধ্যস্থতা প্রক্রিয়াটিকে প্রাতিষ্ঠানিক করার চেষ্টা করা হয়েছিল। এরকমই একটি ব্যবস্থা ছিল ১৮১৬ সালের হিন্দু কলেজ প্রতিষ্ঠা। উদীয়মান কলকাতার অভিজাতদের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত এই প্রতিষ্ঠান, যার লক্ষ্য ছিল মনস্তাত্ত্বিক গতিশীলতার মধ্য দিয়ে নিজের জন্ম থেকে একজন ব্যক্তিকে মুক্তি দেওয়া যা নিজের জন্মের চেয়ে আলাদা একটি ব্যক্তিত্ব গঠনের সাহায্য করা সম্ভব হয়।

ভাষা, সংস্কৃতি এবং অঞ্চলকে কেন্দ্র করেও মুসলিম সম্প্রদায় পৃথক হয়। দক্ষিণ এশিয়ার অনেক দেশের মুসলমানরা মূলত ধর্মের ভিত্তিতে বৃহত্তম সংখ্যালঘু গোষ্ঠী গঠন করে।

হিন্দু কলেজের প্রতিষ্ঠার পেছনে ধারণাটি ছিল কলকাতা উচ্চবিত্তদের পাশ্চাত্য শিক্ষা দেওয়া এবং সাহিত্যে ধর্মনিরপেক্ষ শিক্ষাকে উৎসাহিত করা। হিন্দু কলেজ কলকাতার বাবু বা পেশাদার বুদ্ধিজীবী এবং ভদ্রলোকের হিন্দু সংস্কৃতিকে পুনরুজ্জীবিত করার সমাপ্তি স্কুল হিসেবেও কাজ করেছিল। ঐতিহাসিকদের মতে, এই রকম কিছু ক্রমিক ব্যবস্থার ফলে শিক্ষা, সাহিত্য, সংস্কৃতিসহ অর্থনীতিতেও বাঙালি মুসলমানেরা পিছিয়ে পড়েছিল। ব্রিটিশ সরকারের সাথে দূরত্ব, হিন্দুদের মতো কোনো বুদ্ধিদীপ্ত প্রতিষ্ঠান তৈরিতে অনীহা প্রভৃতি বিষয়গুলো তো ছিলই।

ভাষা, সংস্কৃতি এবং অঞ্চলকে কেন্দ্র করেও মুসলিম সম্প্রদায় পৃথক হয়। দক্ষিণ এশিয়ার অনেক দেশের মুসলমানরা মূলত ধর্মের ভিত্তিতে বৃহত্তম সংখ্যালঘু গোষ্ঠী গঠন করে। ভারতে, মুসলমান এবং অন্যান্য সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের অধিকারের জন্য সংবিধানে অনেকগুলো যথাযথ ধারাও হয়তো সরবরাহ করেছে এবং বৈষম্যর প্রতিরক্ষামূলক ব্যবস্থাও রক্ষা করেছে। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, এই পদক্ষেপগুলো সত্ত্বেও, মুসলমানদের বিরূপ অবস্থা এখনো অব্যাহত রয়েছে।

২০০৬ সালের সাচার কমিটি (Sachar Committee) এর প্রতিবেদনে এই সত্যটি তুলে ধরা হয়েছে যে, দলিত ও আদিবাসীদের পাশাপাশি মুসলমানরা অন্যান্য ধর্মীয় সম্প্রদায়ের তুলনায় আর্থ-সামাজিক ও শিক্ষাগতভাবে বেশি বঞ্চিত রয়েছে। ভারতের মুসলিম প্রসঙ্গে এখনো বলা যায় ‘বঞ্চিত জনগোষ্ঠী’ হিসেবে তাদের পরিচয়ের উপর নির্ভর করতে হয়।

আমরা যদি পশ্চিমবঙ্গে মুসলমানদের আর্থ-সামাজিক এবং শিক্ষাগত অবস্থার প্রতি মনোনিবেশ করি তবে তাদের এই অবাস্তব পরিস্থিতি তাদের ভারতীয় প্রতিরূপীদের দুর্দশার প্রতিফলন ঘটায়। ২০১৬ সালে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন, ‘পশ্চিমবঙ্গে মুসলমানদের বেঁচে থাকার বাস্তবতা’ স্পষ্টতই এই দাবিটিকে আরও জোরদার করেছে।

বর্তমান বিজেপি নেতৃত্বাধীন এনডিএ সরকারের শাসনামলে তিন তালকের বৈধতা এবং ইউসিসির প্রবর্তনের বিষয়ে বিতর্ক নিয়ে মুসলিম মহিলাদের প্রশ্ন আরও তীব্র হয়। এই দিকগুলো একপাশে রেখে, যদি আমরা মুসলিম মহিলাদের শিক্ষাগত পারফরম্যান্সের দিকে মনোনিবেশ করি তবে শিক্ষাগত পরিস্থিতিতে তাদের অংশগ্রহণ আকর্ষণীয়।

জয়া হাসান এবং রিতু মেনন পরিচালিত ২০০৪ সালের মুসলিম উইমেনস সার্ভেতে (MWS in 2004) মুসলিম মহিলাদের অসম নাগরিকত্বের দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। যদিও ২০১৬ সালের ‘পশ্চিমবঙ্গে মুসলমানদের বেঁচে থাকার বাস্তবতা’ প্রতিবেদনটি দেখায় যে, পশ্চিমবঙ্গের মুসলমানরা একটি উচ্চ শিক্ষামূলকভাবে বঞ্চিত সম্প্রদায়, এটি নারী এবং পুরুষ উভয় লিঙ্গর ক্ষেত্রেই বলা হয়েছে। এখানে বোঝতে অসুবিধা হয় না যে, যদি এটি সাধারণ চিত্র হয় তবে মুসলিম মহিলাদের শিক্ষাগত অবস্থা অনেক উদ্বেগের বিষয়। এই জাতীয় পরিস্থিতি আমাদেরকে মুসলিম মহিলাদের শিক্ষা এবং সম্প্রদায়ের নেতৃত্বাধীন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর ভূমিকা সম্পর্কে গভীরভাবে চিন্তা করতে প্ররোচিত করে।

ভারতের সংবিধানের দুটি সংবন্ধে ‘সংখ্যালঘুদের যথাযথ শিক্ষার বিকাশের জন্য’ স্পষ্টতই শিক্ষাগত অধিকার রক্ষা করেছে। ২৯ (২) ধারাটি সংখ্যালঘুদের শিক্ষার স্বার্থ রক্ষার জন্য; ৩০ (১) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ধর্ম বা ভাষার উপর ভিত্তি করে সকল সংখ্যালঘুদের তাদের পছন্দের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্থাপন ও পরিচালনার অধিকার থাকবে।

একুশ শতকে জনগোষ্ঠীকে শিক্ষিত করতে সরকারি পরিচালিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ভূমিকা বৃদ্ধি পেয়েছে। তবে এখনো গোটা ভারত এবং দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশগুলোতে বিশেষ সম্প্রদায় দ্বারা পরিচালিত ঐতিহ্যবাহী প্রতিষ্ঠান এখনো রয়েছে এবং এই ঐতিহ্যবাহী প্রতিষ্ঠানগুলো ভিন্নতা দ্বারা চিহ্নিত করে ইসলামের বিভিন্ন মতাদর্শিক পদ্ধতির উপর ভিত্তি করে পরিচালিত হয়।

আমাদের ভুলে গেলে চলবে না, চলতে থাকা ইতিহাসের ধারাবাহিকতার এই প্রজন্মের ফসল রুমানা সুলতানা। আমরা হয়তো ভুলে যাই বলেই রুমানার মামা মহম্মদ নুরুল হককে বলতে হয়, ‘মুসলিম মেয়ে প্রথম হয়েছে বলে যারা বারবার বলছেন, তাদের এত অবাক কেন হতে হচ্ছে? মুসলিম মেয়ে বলে কি কোনো অঘটন ঘটেছে? মেধা-বুদ্ধি-পরিশ্রমের সমন্বয়ে প্রথম হতে হয়। আমরা গর্বিত যে, রুমানা আমাদের পরিবারের সন্তান। সে একজন ছাত্রী। লেদের থেকে এগিয়ে চলেছে মেয়েরা এটাই লক্ষণীয় এবং আনন্দের ব্যাপার। মুসলিম বলে সম্বোধন করা ঠিক হয়নি।’

রুমানার স্কুলের এক শিক্ষিকাকে বলতে হয়, ‘আমরা গর্বিত। আমাদের স্কুল রাজ্যে প্রথম হয়েছে। এটাই বড় পরিচয়। মুসলিম বা হিন্দু— কোনো ধর্ম নিয়ে পরিচয় হোক, এটা বাস্তবে ঠিক নয়। এই বিতর্কের এ বার অবসান হোক।’

রাজনীতিকরা যাই বলুন না কেন। আসলে এখন সময় হয়ে গেছে যেখানে শিক্ষার প্রতি একচেটিয়া পরিচয় দায়ী না করে যা প্রয়োজন তা হলো বৈচিত্র্য। ভারত এ জাতীয় অনেক স্বীকৃত শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তুলেছে। রাষ্ট্র তার প্রসারকে আরও বাড়িয়ে তুলতে পারে এবং শিক্ষার প্রসারে এই জাতীয় সম্প্রদায়ের প্রচেষ্টায় স্থান দিতে পারে।

নুরুল ইসলাম বাবুল ।। শিক্ষক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক