করোনাকালে প্রত্যাশা
আমরা ভয়াবহ একটি দুঃসময় পার করছি। তার নাম করোনাকাল। আমি প্রার্থনা করি, এরকম খারাপ সময় যেন আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম কখনো না দেখে। সামান্য একটি জীবাণু কী ভয়ংকর মানবিক বিপর্যয় ডেকে আনল! কত মানুষ যে চলে গেলেন! কতজন নিঃস্ব হয়ে গেছেন! কত চুলোয় যে আগুন জ্বলছে না!
প্রশ্ন হচ্ছে, শুধু স্বাস্থ্যবিধি মেনে কোনোরকমে জীবন বাঁচানোই কি এখন আমাদের কাজ? নাকি সৃষ্টির সেরা জীব হিসেবে আমাদের উচিত এ জীবাণুর বিরুদ্ধে, তার জ্বালিয়ে দেওয়া সম্ভাবনাকে আবার জাগিয়ে তোলার জন্য লড়াই করা?
বিজ্ঞাপন
আমার মনে হয় যা হওয়ার হয়ে গেছে, এখন আমাদের লড়তে হবে করোনায় ক্ষতিগ্রস্ত মানুষ এবং তাদের অর্থনীতিকে আবার পূর্ণ শক্তিমান করার জন্য। লড়তে হবে মানবসভ্যতাকে টিকিয়ে রাখার জন্য। তার জন্য কী করতে হবে?
আমার মতে, কিছুটা আদিম যুগে ফিরে যেতে হবে, যখন জঙ্গলে যূথবদ্ধ মানুষ সমস্ত প্রতিকূলতার মধ্যে টিকে ছিল। যদি তারা না টিকতেন আমাদের ডাইনোসরের ভাগ্য বরণ করতে হতো। মানুষের ফসিল নিয়ে আজ অন্য কোনো বুদ্ধিমান প্রাণী গবেষণা করত, কিন্তু তা হয়নি, কারণ মানুষ যূথবদ্ধভাবে অস্তিত্বের লড়াই করেছিল। হাজার হাজার বছর পর অতি আধুনিক মানবসভ্যতাকে আজ আবার অস্তিত্ব রক্ষায় নামতে হয়েছে। প্রতিপক্ষের নাম করোনা।
অক্সিজেনের অভাবে ছটফট করা মানুষটির জন্য অক্সিজেন সিলিন্ডার নিয়ে দৌড়াতে হবে, কত জোরে দৌড়াচ্ছি তার উপর নির্ভর করছে ছটফট করা মানুষটির জীবন।
এ আধুনিক মানুষ, ছয় ইঞ্চি মনিটরে আঙুল টিপে যে দুনিয়া নিয়ন্ত্রণ করে, তাকে কিন্তু এ লড়াইয়ে টিকতে হলে আবার যূথবদ্ধ হতে হবে। যিনি অসুস্থ তার পাশে দাঁড়াতে হবে। অক্সিজেনের অভাবে ছটফট করা মানুষটির জন্য অক্সিজেন সিলিন্ডার নিয়ে দৌড়াতে হবে, কত জোরে দৌড়াচ্ছি তার উপর নির্ভর করছে ছটফট করা মানুষটির জীবন। যে মানুষটি চাকরি হারিয়েছেন, যার ব্যবসা করোনার আঘাতে উড়ে গেছে তার পাশে দাঁড়াতে হবে।
এখন আসলে ‘দুঃখ’ ভাগ করে নেওয়ার সময়। মনে আছে? ছোটবেলায় মধ্যবিত্ত পরিবারে আমরা বাড়িতে ‘ডিম’ ভাগ করে খেতাম? এখন দুঃখকেও ঠিক সেরকম করে ভাগ করে নিজ পাতে নিতে হবে। তাহলেই এ বিপন্ন মানুষগুলো বাঁচবেন। ব্যাপারটা শুনতে অবাক লাগছে? ভাবছেন এটা কীভাবে সম্ভব! অবশ্যই সম্ভব।
আমাদের দেশে গরিব মানুষ যেমন আছেন, উচ্চবিত্তও একদম কম নয়। আবার কোনো উচ্চবিত্তের দরিদ্র আত্মীয় বা বন্ধু নেই তা অবিশ্বাস্য। এ উচ্চবিত্ত মানুষ যাদের পরম করুণাময় না চাইতেই সোনার চামচ দিয়েছেন, এখন সময় সে চামচের দাম পরিশোধের। তারা তাদের বিশাল আর্থিক ক্ষমতার সামান্য অংশ যদি পরিচিত বিপন্ন মানুষের পেছনে খরচ করেন তবে এ অসহায়রা নতুন জীবন পাবেন।
তারা করোনা আক্রান্তদের চিকিৎসা করাতে পারেন। চাকুরিচ্যুতদের চাকরির ব্যবস্থা করতে পারেন। তাদের জন্য ছোটখাটো ব্যবসা দাঁড় করিয়ে দিতে পারেন। বিপন্ন পরিবারগুলোর বাচ্চাদের পড়াশোনার দায়িত্ব নিতে পারেন। প্রতিষ্ঠান থেকে কর্মী ছাঁটাই বন্ধ করতে পারেন।
এ দুঃসময়ে আমরা প্রচুর মানবিক মানুষের খোঁজ পেয়েছি, যার যা আছে তাই নিয়ে অন্যের সাহায্যে এগিয়ে এসেছেন, এমনকি টিউশনির জমানো টাকা ভেঙে ছাত্রছাত্রীদের আমরা বিপন্ন রোগীর জন্য ওষুধ কিনতে দেখেছি। এমনকি লিজা রহমানের মতো মহিলা বাইক রাইডাররা মোটর সাইকেলে সিলিন্ডার নিয়ে ছুটে যাচ্ছেন, কিন্তু সে তুলনায় উচ্চবিত্তদের এগোতে দেখিনি। তাদের অনেক প্রতিশ্রুতি শুনেছি, কিন্তু সেগুলোর বেলুন আকাশে উড়েনি!
নিজের নিরাপত্তা নিশ্চিত করায় ব্যস্ত ‘সৌভাগ্যবান’ মানুষগুলো ভাবছেন না, অন্ধ হলে প্রলয় বন্ধ থাকে না। করোনার কারণে যদি মানবিক বিপর্যয় হয় তারাও কিন্তু রক্ষা পাবেন না।
নিজের নিরাপত্তা নিশ্চিত করায় ব্যস্ত ‘সৌভাগ্যবান’ মানুষগুলো ভাবছেন না, অন্ধ হলে প্রলয় বন্ধ থাকে না। করোনার কারণে যদি মানবিক বিপর্যয় হয় তারাও কিন্তু রক্ষা পাবেন না। চার্টার্ড ফ্লাইট হয়তো তাদের উড়িয়ে অন্য জায়গায় নিয়ে যাবে, কিন্তু সমস্যা হলো মানবিক বিপর্যয়ের গতি এসব প্লেনের চাইতে অনেক বেশি। তাই যেখানে ফ্লাইট থামুক, বাইরে অপেক্ষা করবে ধ্বংস। অতএব নিজেকে রক্ষা নয়, সবাইকে রক্ষার কাজে তাদের নামতে হবে, নইলে তারাও বাঁচবেন না, হয়তো প্রাণে মরবেন না, কিন্তু বেঁচে থাকবেন তেলাপোকার মতো।
মানুষ থেকে তেলাপোকায় পরিণত হওয়ার চাইতে দুর্ভাগ্য আর কিছু হতে পারে না। অতএব এখন ধনী-গরিব সবাইকে এক কাতারে দাঁড়িয়ে টিকে থাকার লড়াই করতে হবে। উপাসনালয়ের মতো এক কাতার। করোনা যোদ্ধাদের মতো এক কাতার।
তাই এখন সময় আদিম যুগের যূথবদ্ধতায় ফিরে গিয়ে করোনায় মানবিক সাহায্যে সবার এগিয়ে আসা, নয়তো ভয়াবহ বিপর্যয় আসবেই। আগুন কিন্তু জ্বলছে এবং সাধারণ মানুষকে গ্রাস করতে করতে তা এগিয়ে আসছে দেবালয়ের দিকে। আমরা যার যার জায়গা থেকে মোকাবিলায় না নামলে নিজেদের দুর্গে আগুন লাগতে আর বেশি সময় নেই।
করোনার সময় আমার একটিই প্রত্যাশা, আসুন যূথবদ্ধভাবে এ দুঃসময়ের মোকাবিলা করি। করোনার মতো ভাইরাসের মানুষকে পরাজিত করার ক্ষমতা নেই। শুধু আমাদের সম্মিলিত শক্তি প্রদর্শনের অপেক্ষা মাত্র।
বাদল সৈয়দ ।। সমাজকর্মী ও কথাসাহিত্যিক
badalsyed@yahoo.com