করোনা প্রতিরোধে লকডাউন নয় ভ্যাকসিনই একমাত্র সমাধান
অবাক হওয়ার মতো ঘটনা। লকডাউনের সময় করোনার বিস্তার ঘটেছে প্রায় তিনগুণ। লকডাউন দেশের অর্থনীতি ও জনগণের বিপরীতে কাজ করছে। লকডাউনের আগের এক সপ্তাহে দেশে করোনা আক্রান্ত হয়েছেন ৫২,১০৮ জন। মারা গেছেন ৮০১ জন।
লকডাউনের প্রথম সপ্তাহে আক্রান্ত হয়েছেন ২,২১,৯১৩ জন। যা পূর্বের এক সপ্তাহের তুলনায় ১,৬৯,৮০৫ জন বেশি। মারা গেছেন ১০৭২ জন। এই সংখ্যা আগের সপ্তাহের তুলনায় ২৭১ জন বেশি।
বিজ্ঞাপন
করোনা ভাইরাস বাহিত একটি রোগ। এটা সাধারণ ডাক্তার বা বিশেষজ্ঞদের চিন্তার বাইরে। এ নিয়ে কত কথা যে শুনেছি তার হিসাব নেই। কেউ বলেছেন, করোনা ডিম থেকে জন্মাচ্ছে, কেউ বলেছেন করোনা শীতে বাড়ে, করোনা গ্রীষ্ম প্রধান দেশে অকার্যকর ইত্যাদি ইত্যাদি। সময়ের ব্যবধানে প্রমাণিত হয়েছে যা শুনেছি তার সবই কল্পনা ছাড়া কিছুই না।
করোনা প্রতিরোধে জেলা উপজেলায় ‘লকডাউন’ গেমের প্র্যাকটিস অনেক আগেই শুরু হয়েছে। এ ব্যাপারে বেশি উৎসাহী সেই কান ধরানো এসিল্যান্ড, ছাগলকে জরিমানা করা ইউএনও এবং পুকুরওয়ালা সেই ডিসির মতো অতি উৎসাহী ক্ষুদে আমলারা।
‘লকডাউন’ তাদের জন্য ‘পোয়াবারো’ কারণ, কথিত লকডাউন কার্যকর করার জন্য আছে সরকারি বরাদ্দ। সেই বরাদ্দের টাকা হজম করতে হলে লকডাউন খুবই দরকারি।
এতে কাজের কাজ কি হয়েছে, সে পরিসংখ্যান তারা দেখেছে কি না জানি না। তবে দেশব্যাপী জারি করা ‘লকডাউন’ যে করোনা আক্রান্তের হার ও মৃত্যু কমাতে পারেনি এটা নিশ্চিত।
লকডাউনের কারণে উৎপাদন মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এর প্রভাব পড়ছে জাতীয় অর্থনীতির উপর। ব্যক্তি পর্যায়ের ক্ষতি তো উদ্বেগজনকভাবে দৃশ্যমান।
এই দাবি প্রমাণ করতে হলে দেখতে হবে এবারের লকডাউন শুরুর আগের ও পরের সাত দিনের পরিসংখ্যান। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের প্রেস বিজ্ঞপ্তি থেকে জানা গেছে, ১ জুলাই করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন ৩২,০৫৫ জন। মারা গেছেন ১৪৩ জন। ২ জুলাই আক্রান্ত ৩০,০১২ মৃত্যু ১৩২ জন; ৩ জুলাই আক্রান্ত ২২,৬৮৭, মৃত্যু ১৩৪ জন; ৪ জুলাই আক্রান্ত ২৯,৮৭৯, মৃত্যু ১৫৩ জন; ৫ জুলাই আক্রান্ত ৩৫,০০২, মৃত্যু ১৬৪ জন; ৬ জুলাই আক্রান্ত ৩৬,৬৩৯, মৃত্যু ১৬৩ জন; ৭ জুলাই আক্রান্ত ৩৫,৬৩৯, মৃত্যু ২০১ জন। অর্থাৎ সাত দিনে ২,২১,৯১৩ জন আক্রান্ত হয়েছেন। মারা গেছেন ১০৭২ জন।
লকডাউন ঘোষণার এক সপ্তাহ আগে ২৩ জুন ৫,৭২৭ জন আক্রান্ত হয়েছেন। ৮৫ জন মারা গেছেন। ২৪ জুন আক্রান্ত ৬,০৫৮ জন। ৮১ জন মারা গেছেন। ২৫ জুন আক্রান্ত ৫,৮৬৯ জন। ১০৮ জন মারা গেছেন। ২৬ জুন আক্রান্ত ৪,৩৩৪ জন। ৭৭ জন মারা গেছেন। ২৭ জুন আক্রান্ত ৫,২৬৮ জন। ১১৯ জন মারা গেছেন। ২৮ জুন আক্রান্ত ৮,৩৬৪ জন। ১০৪ জন মারা গেছেন। ২৯ জুন আক্রান্ত ৭,৬৬৬ জন। ১১২ জন মারা গেছেন। ৩০ জুন আক্রান্ত ৮,১২২ জন। ১১৫ জন মারা গেছেন। অর্থাৎ লকডাউনের আগের সাতদিনে ৫২১০৮ জন আক্রান্ত হয়েছেন হয়েছেন। মারা গেছেন ৮০১ জন।
লকডাউনের ৭ দিনে আক্রান্ত ২,২১,৯১৩ জন। যা পূর্বের আক্রান্ত হার থেকে ১,৬৯,৮০৫ জন বেশি। আগে মারা গেছেন ৮০১ জন। পরে ১০৭২ জন। যা আগের তুলনায় ২৭১ জন বেশি।
এই সরকারি পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করলে দেখা যাচ্ছে, লকডাউনের সময় আক্রান্ত যেমন বেশি মৃত্যুও তেমনই বেশি। তাই এটা জোর দিয়ে বলা যায় যে, লকডাউন কর্মসূচি কার্যকর কোনো সুফল বয়ে আনতে পারেনি।
পক্ষান্তরে লকডাউন কার্যকর করতে খরচ হচ্ছে কোটি কোটি টাকা। লকডাউনের নামে ঝুঁকি ভাতা টিএ ডিএসহ নানা অজুহাতে হরিলুট হয়ে যাচ্ছে সরকারি টাকা। অপরদিকে লকডাউনের কারণে উৎপাদন মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এর প্রভাব পড়ছে জাতীয় অর্থনীতির উপর। ব্যক্তি পর্যায়ের ক্ষতি তো উদ্বেগজনকভাবে দৃশ্যমান।
ভ্যাকসিন পাওয়ার জন্য কূটনৈতিক তৎপরতা চালু রাখা এই মূহুর্তে অতীব জরুরি।
রাজধানী ঢাকা অনেকটা খোলামেলা ভাবেই চলছে। তারপরও দাবি করে বলা যায় ঢাকায় করোনার প্রাদুর্ভাব নেই। এর কারণ হলো এই যে, ঢাকার বেশিরভাগ চল্লিশোর্ধ্ব লোক ভ্যাকসিনেটেড। তাই এখানে করোনা থাকলেও মৃত্যুহার বাড়েনি।
করোনা আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর হার বেড়েছে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিম ও উত্তরাঞ্চলের ভারত সংলগ্ন জেলা সমূহে। এর অন্যতম কারণ হলো এসব অঞ্চলে ভ্যাকসিনেশন তেমন হয়নি। তারা মনে করেছিলেন গ্রামাঞ্চলে করোনা হবে না। তাই বেশিরভাগ মানুষ ভ্যাকসিন নেয়নি। যার ফলে করোনা আক্রান্ত ও মৃত্যু হার বেড়েছে।
কুষ্টিয়া শহরের সাংবাদিক সোহেল রানা জানালেন, তার পরিবারের কয়েকজন আক্রান্ত হয়েছেন। এর মধ্যে তিনিও আছেন। টেস্টে তার করোনা পজিটিভ দেখালেও কোনো উপসর্গ নেই। তার মানে হলো এই যে তিনি ভ্যাকসিন নিয়েছেন তাই করোনা তাকে শয্যাশায়ী করতে পারেনি।
শুধু এখানেই নয় আমেরিকার প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ঘোষণা দিয়েছেন, ৪ জুলাইয়ের মধ্যে ৭০ শতাংশ মানুশকে টিকার আওতায় আনা হবে। যারা ভ্যাকসিনেটেড তাদের মাস্ক পরার বাধ্যবাধকতা নেই। দেশের ৬০ শতাংশেরও বেশি লোক টিকা নিয়েছেন। আর এটা সম্ভব হয়েছে বলেই সেখানে এমন ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। এখানেই শেষ নয় উন্নত বিশ্বের অধিকাংশ দেশ ভ্যাকসিনেশন শেষ করতে উঠে পড়ে লেগেছে। বাংলাদেশেও ভ্যাকসিন দারুণভাবে কাজ করছে।
তাই লকডাউনের নামে অর্থনৈতিক ক্ষতি না করে কঠোর বিধিনিষেধ আরোপ করা জরুরি। সামাজিক শারীরিক দূরত্ব বজায় রেখে চলা ও মাস্ক ব্যবহার বাধ্যতামূলক করা প্রয়োজন। সেই সাথে ভ্যাকসিন পাওয়ার জন্য কূটনৈতিক তৎপরতা চালু রাখা এই মূহুর্তে অতীব জরুরি।
এসব না করে আর বাংলাদেশের বিশেষজ্ঞ কমিটি লকডাউন দিয়ে করোনা নিয়ন্ত্রণ করার অপচেষ্টায় মত্ত। আবারও লকডাউনের মেয়াদ বাড়ানো হলে বলতেই হবে ‘জুতা আবিষ্কার’র সেই কবিতা ‘এমনি সব গাধা ধুলারে মারি করিয়া দিল কাদা!’
এরপরও ইচ্ছা হলেই লকডাউন, ইচ্ছা হলেই ধরপাকড়, ইচ্ছে হলেই জেল জরিমানা করা ঠিক হবে না। তারপরও যদি লকডাউনের নামে জুলুম নির্যাতন বন্ধ না হয় তাহলে, আদরিনী গল্পের জয়রাম মুক্তারের মতো করে বলবো, ‘আমার স্ত্রীর যতটুকু আইন জ্ঞান আছে, হুজুরের দেখছি তাও নেই।’ এরপর যদি আড়াই টাকা জরিমানা হয় তা মওকুফের জন্য হাইকোর্ট অব্দি লড়ব।
পরিশেষে বলা যায়, করোনা প্রতিরোধে লকডাউন নয়, দেশের সকল জনগণকে ভ্যাকসিনের আওতায় আনাই হলো একমাত্র সমাধান।
আব্দুল বারী ।। সিনিয়র সাংবাদিক