বলিউড ট্র্যাজেডি কিং দিলীপ কুমার: সর্বকালের সেরা অভিনেতা
‘বলিউড ট্র্যাজেডি কিং’ নামে বহুল পরিচিত, কিংবদন্তি অভিনেতার অসাধারণ অভিনয় দক্ষতা, ক্যারিশম্যাটিক অনস্ক্রিন উপস্থিতি, ট্রসলেস চুল এবং ভালো চেহারা দ্বারা ভক্ত এবং অনুসারীদের মনোমুগ্ধ ও বাকরুদ্ধ রেখে দিয়েছেন গত কয়েকদশক। যা তাকে কোটি মানুষের স্বপ্নের হৃদয়ে অন্যতম বিখ্যাত অভিনেতা হিসেবে গড়ে তুলেছে।
দিলীপ কুমারের ক্যারিয়ার ছয় দশকেরও বেশি সময় ধরে তিনি দর্শকদের মনোরঞ্জন করেছেন। তিনি বলিউডের ‘প্রথম খান’ হিসেবেও পরিচিত ছিলেন। তিনি তার ক্যারিয়ারে ৬৫টিরও বেশি চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন এবং চলচ্চিত্রের চরিত্রগুলোর জন্য সর্বাধিক পরিচিতি রয়েছে, যার মধ্যে—দেবদাস (১৯৫৫), নয়া দৌড় (১৯৫৭), মোঘল-ই-আজম (১৯৬০), গঙ্গা যমুনা (১৯৬১), ক্রান্তি (১৯৮১) এবং কর্ম (১৯৮৬)।
বিজ্ঞাপন
সর্বশেষ তিনি ১৯৯৮ সালে উমেশ মেহরা পরিচালিত কিলা (১৯৯৮)’র সিনেমায় দ্বৈত চরিত্রে অভিনয়ের মাধ্যমে রূপালী পর্দাকে বিদায় জানিয়েছিলেন। দিলীপ কুমার প্রথম তারকা, যিনি ফিল্মফেয়ার অ্যাওয়ার্ডে সেরা অভিনেতার জন্য সফলভাবে ট্রফি অর্জন করেছিলেন। দিলীপ কুমার ১৯৯৪ সালে দাদাসাহেব ফালকে পুরস্কার এবং ২০১৫ সালে পদ্মবিভূষণে ভূষিত হয়েছেন। দেব আনন্দ ও রাজ কাপুরের সাথে তিনি ১৯৪০ সাল থেকে ১৯৬০ সাল পর্যন্ত ভারতীয় সিনেমার স্বর্ণযুগে আধিপত্য বিস্তারকারী তিনটি বড় নামের মধ্যে অন্যতম।
দেবদাস তারকা দিলীপ কুমার একবার সাইরা বানুর বিপরীতে কাজ করতে অস্বীকার করেছিলেন ঠিকই কিন্তু নিয়তির অন্য কিছু পরিকল্পনা তার জন্য অপেক্ষা করেছিল।
দিলীপ কুমার প্রথম তারকা, যিনি ফিল্মফেয়ার অ্যাওয়ার্ডে সেরা অভিনেতার জন্য সফলভাবে ট্রফি অর্জন করেছিলেন।
১৯৬৬ সালে দিলীপ কুমার তার চেয়ে ২২ বছর ছোট অভিনেত্রী সায়রা বানুকে বিয়ে করেছিলেন। পরে তিনি হায়দ্রাবাদের আসমা সাহিবাকে বিয়ে করেন এবং ১৯৮১ সালে তাকে দ্বিতীয় স্ত্রী হিসেবে গ্রহণ করেন। তার এই বিয়েটি বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। ১৯৮৩ সালের জানুয়ারিতে তাদের সম্পর্ক ভেঙে যায় এবং তিনি আসমার সাথে তার বিয়ের কথা স্মরণ করতে গিয়ে গণমাধ্যমকে বলেছিলেন, ‘জীবনে এমন কিছু আছে যা ভুলে যেতে চাই।’ পরবর্তীতে সায়রা বানু ও দিলীপ কুমার বান্দ্রায় থাকতে শুরু করেন। তাদের কোনো সন্তান হয়নি। দিলীপ কুমারের আত্মজীবনী Dilip Kumar: The Substance and the Shadow ২০১৪ সালে প্রকাশিত হয়। আত্মজীবনীতে তিনি লিখেছিলেন, সায়রা বানু ১৯৭২ সালে গর্ভধারণ করেছিলেন, তবে গর্ভাবস্থায় কিছু জটিলতা তৈরি হয়েছিল, যার ফলে শিশুটির মৃত্যু হয়েছিল পরে এটিকে অনুসরণ করে তারা ঈশ্বরের ইচ্ছা বলে বিশ্বাস করে আর সন্তান ধারণের চেষ্টা করেননি।
১৯২২ সালের ১১ ডিসেম্বর বর্তমান পাকিস্তানের পেশোয়ার শহরে বারো সদস্যের একটি পুশতন পরিবারে মোহাম্মদ ইউসুফ খান ওরফে দিলীপ কুমার জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তার পিতা ছিলেন ফল ব্যবসায়ী, যিনি তার পরিবারকে ১৯৩০ -এর দশকে আরও ভালো জীবনের আশায় ভারতের বিনোদন রাজধানীখ্যাত মুম্বাই শহরে নিয়ে গিয়ে বসবাস শুরু করেছিলেন।
১৯৪০ সালে কিশোর বয়সেই বাবার সাথে পুনেতে একটি স্যান্ডউইচের দোকানে কাজ শুরু করেন। সেখান থেকে হাতে পাঁচ হাজার টাকা পুঁজি করে ভাগ্য অন্বেষণে বোম্বে (মুম্বাই) শহরে চলে এসে বোম্বে টকিজের মালিক দেবিকা রানীর সাথে দেখা করেন। দেবিকা রানীর তাকে পছন্দ হওয়াতে বছরে ১২৫০ টাকা বেতনে চাকরিতে নিয়োগ দিয়ে দেন। দেবিকা রানী ১৯৪৪ সালে তার প্রথম সিনেমা ‘জোয়ার ভাটা’তে তাকে কাস্ট করেছিলেন এবং স্ক্রিনের নাম হিসেবে দিলীপ কুমার নামটি প্রস্তাব করেছিলেন। যদিও বোম্বে টকিজের প্রযোজনায় বাঙালি পরিচালক আমিয় চক্রবর্তী বলেছিলেন এই চলচ্চিত্রটি ফ্লপ হয়েছিল এবং তৎকালীন শীর্ষস্থানীয় ফিল্ম ম্যাগাজিনগুলো তার অভিনয়ের সমালোচনা করলেও দিলীপ কুমার ভেঙে পড়েননি।
প্রথমদিকের সেই সমালোচনাগুলো তিনি একধরণের শিক্ষা হিসেবে নিয়ে সমস্ত মেধা এবং পরিশ্রমকে পুঁজি করে সামনের দিকে এগিয়ে গেছেন যার ফসল হিসেবে শেষ পর্যন্ত ১৯৪৬ সালে নির্মিত মিলান চলচ্চিত্রটি রিলিজ হওয়ার পরে জীবনে এসেছিল সেই স্বপ্নের সফলতা এবং ক্রমেই ছবিটি সফলতার ধারাবাহিকতা ভেঙে দিয়েছিল। ছবিটি বাঙালি পরিচালক নিতিন বোস রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ১৯০৬ সালের লেখা নৌকাডুবি থেকে তৈরি করেছিলেন।
১৯৪৭ সালের তৎকালীন নামকরা তারকা নূরজাহানের সাথে অভিনীত শওকত আর্ট প্রোডাকশনের জুগনুর সফলতার পর আর তাকে পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। এরপরেই ১৯৬০ সালে কে আসিফের মুঘল সম্রাট আকবর ও তার পুত্র জাহাঙ্গীরের জীবন অবলম্বনে অন্যতম স্মরণীয় উপন্যাস ঐতিহাসিক এপিক সিনেমা ‘মুঘল-ই-আজম’-এর রাজ কাপুরের সাথে তার সবচেয়ে স্মরণীয় ভূমিকার অবদান এই প্রজন্মের মধ্যেও প্রতিধ্বনিত হয়। প্রায় ১৫ কোটি রুপি খরচে নির্মিত ১৯৬০ সালে মুক্তি পাওয়া সিনেমাটি নির্মাণে আট বছর সময় লেগেছিল। এটি বলিউডের সর্বকালের বৃহত্তম সর্বাধিক উপার্জনকারী সিনেমা হয়ে উঠছিল।
সেভেন পিলার্স অব উইসডম অবলম্বনে ডেভিড লিয়েনের ১৯৬২ সালের বিশ্বখ্যাত ক্লাসিক এপিক লরেন্স অফ আরব-এ শেরিফ আলির চরিত্রটি করার সুযোগ তিনি নিজেই প্রত্যাখ্যান করার পরে তিনি আন্তর্জাতিক খ্যাতি থেকে বাদ যান। চলচ্চিত্র বিশেষজ্ঞদের মতে, এটি ছিল তার ঐতিহাসিক একটি ভুল। পরে তার না করা এই চরিত্রটি ওমর শরীফ নামের একজন মিশরীয় অভিনেতা অভিনয় করেছেন যা আমরা সকলেই দেখেছি।
দিলীপ কুমার এমন একজন মেথড অভিনেতা যিনি প্রথম থেকেই তার সেরা অভিনয়ের চেয়ে কম কিছু নিয়ে কোনো সময় দর্শকদের সামনে উপস্থিত হননি। আসলে মেথড অভিনয় হলো এমন একটি কৌশল বা অভিনয়ের প্রবণতা যেখানে কোনো অভিনেতা চরিত্রের ভূমিকাকে পুরোপুরিভাবে স্থির করে আন্তরিক এবং সংবেদনশীল ভাব প্রকাশিত করে পারফরম্যান্সকে উত্সাহিত করতে আগ্রহী হয়। এটি ধ্রুপদী অভিনয়ের পরিবর্তে আবেগ-ভিত্তিক কৌশল যা মূলত অ্যাকশন-ভিত্তিক বিষয়গুলোকে সামনে নিয়ে আসে। আর এজন্য তিনি যেন নিজের কাছে নিজেই একটি প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছেন।
দেবিকা রানী ১৯৪৪ সালে তার প্রথম সিনেমা ‘জোয়ার ভাটা’তে তাকে কাস্ট করেছিলেন এবং স্ক্রিনের নাম হিসেবে দিলীপ কুমার নামটি প্রস্তাব করেছিলেন।
সত্যজিৎ রায় তার সম্পর্কে বলেছিলেন, ব্যক্তি এবং অভিনেতা হিসেবে তার দুর্দান্ত ইতিহাস আছে। এমনকি অনেকে তার অনস্ক্রিন ব্যক্তিত্বকে তার অফস্ক্রিন লাইফের এক্সটেনশন হিসেবে দেখেন। আর এই উঁচু স্থান থেকেই দিলীপ কুমার এখনো তার সুপারস্টার স্ট্যাটাসের নির্দেশনা দেন, যেটি অন্য কোনো ভারতীয় অভিনেতার পক্ষে পরিমাপ করা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়বে।
তার জীবনের শেষের দিকটা খুব একটা ভালো কাটেনি। অনেক রোগ ভোগের সমস্যা নিয়েই বেশ কয়েকটি দুর্বল চলচ্চিত্রের পরে ১৯৯৮ সালে তিনি রাজনীতিতে আরও সক্রিয় ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন। একই বছর, তিনি হিন্দু জাতীয়তাবাদীদের ক্ষুব্ধ করে পাকিস্তানের সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মান পেয়েছিলেন। দুই বছর পরে, তিনি বিরোধী কংগ্রেস দলের সংসদ সদস্যও হয়েছিলেন। তাই শিল্পী পরিচয়ের পাশাপাশি একজন রাজনৈতিক হিসেবেও তাকে কিছুদিন দেখা গিয়েছিল। যদিও সেটা অন্যান্য অনেক শিল্পীর মতো অতটা বিস্তৃত নয়। অভিনেতাই যেন তার জাত পরিচয় তাই তার শোকবার্তায় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী দিলীপ কুমারকে ‘চলচ্চিত্রের কিংবদন্তি’ বলে অভিহিত করেছেন যিনি ‘তার অতুলনীয় উজ্জ্বলতায় ধন্য’। মোদী আরও বলেছেন, তার মৃত্যু ‘বিশ্বের দরবারে আমাদের সাংস্কৃতিক ক্ষতি’।
বহু অভিনেতা যারা শত শত ছবিতে অভিনয় করেছিলেন তার বিপরীতে, বহুমুখী দিলীপ কুমার সাবধানতার সাথে ভারতীয় মানদণ্ডে ভালো দিকগুলো বেছে নিয়েছিলেন, সার্বিক সহযোগিতার হাত বাড়িয়েছেন সর্বদা তাদের দিকে যা কেবলমাত্র এই উত্তর আধুনিক মারাত্মক প্রতিযোগিতামূলক শিল্পে তার মর্যাদাকে আরও অনেক গুণ বাড়িয়ে তোলে। তাইতো তিনি ২০০৬ সালে, ভারতীয় চলচ্চিত্রের অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ ভারতের জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে আজীবন কৃতিত্বের পুরস্কার গ্রহণ করেছিলেন। তবুও তিনি স্বীকার করেছেন যে তিনি তার সাফল্যে হতবাক হয়েছিলেন। এতটা যোগ্য তিনি নন। তার এই বিনয়ভাব তাকে আরও মহৎ করে তুলেছে। তিনি হিন্দুস্তান টাইমসকে তার ৮৫তম জন্মদিন উপলক্ষে একটি সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন—‘সত্যই, আমি এখনো অবধি বুঝতে পারি না যে, ইউসুফ খান নামে একজন তীব্র লাজুক যুবক কীভাবে অভিনেতা দিলীপ কুমার হয়ে উঠল।’
নুরুল ইসলাম বাবুল ।। শিক্ষক, রাজনৈতিক বিশ্লেষক