সাম্প্রতিক সময়ে সবচেয়ে আলোচিত বিষয় করোনার ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট, যার প্রভাবে বিপর্যস্ত আমাদের প্রতিবেশি দেশ ভারত। ভারতের পরে এই ভ্যারিয়েন্টের সংক্রমণ এখন আমাদের দেশেও ব্যাপকভাবে দৃশ্যমান। 

সীমান্ত জেলাগুলোতে প্রথমে এই সংক্রমণ শনাক্ত হয়, যা খুব অল্প সময়ের মধ্যেই পার্শ্ববর্তী জেলাগুলোতে ছড়িয়ে পড়ে। ভারতে করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের পর থেকেই আমাদের দেশে এটি ছড়িয়ে পড়ার যে আশঙ্কা ছিল তা বাস্তব রূপ নিতে যাচ্ছে। সর্বশেষ ২৪ জুন দেশে করোনা শনাক্ত হয়েছে ৬ হাজার ৫৮ জনের শরীরে, যা ভয়াবহ পরিস্থিতির ইঙ্গিত দিচ্ছে।

করোনা সংক্রমণ রোধে গৃহীত ব্যবস্থাগুলো পুরোপুরি কার্যকরী না হওয়ায় সংক্রমণের এই উল্লম্ফন দৃশ্যমান। সংক্রমণ বিস্তার রোধে জনগণকে স্বাস্থ্যবিধি মানতে বাধ্য করা যায়নি। সংক্রমিত রোগীর সংস্পর্শে আসা মানুষদের যথাযথভাবে ট্রেসিং করে তাদের টেস্টের ব্যবস্থা করা হয়নি। এর ফলে মৃদু উপসর্গ নিয়ে মানুষ স্বাস্থ্যবিধি না মেনে যত্রতত্র ঘুরে সংক্রমণ ছড়াচ্ছে বলে অভিমত বিশেষজ্ঞদের। 

উন্নত দেশগুলোর অসহযোগিতা ও তাদের জনসংখ্যার তুলনায় অতিরিক্ত টিকা মজুদের অসম প্রতিযোগিতার ফলে বাংলাদেশের মতো অন্যান্য স্বল্পোন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলোতে টিকা সরবরাহ প্রায় বন্ধ হয়ে যায়। 

যে এলাকাগুলোতে লকডাউন বা কঠোর বিধি-নিষেধ আরোপ করা হয়েছে সেখানেও মানুষ মাস্ক না পরে বাইরে বের হচ্ছে। গণপরিবহন বন্ধ থাকলেও রিকশা, অটো রিকশা ও ব্যক্তিগত যানবাহনে মানুষ চলাচল করছে। যার ফলে লকডাউনের সুফল বেশিরভাগ এলাকাতেই দেখা যাচ্ছে না। 

আর করোনা মোকাবিলায় প্রধান হাতিয়ার, টিকা নিয়েও রয়েছে অনিশ্চয়তা। টিকা ব্যবস্থাপনা নিয়ে এর আগের একটি লেখাতেও আলোচনা করার চেষ্টা করেছি। সে বিষয়ের পুনরাবৃত্তি না করে শুধু এটুকু বলা যায় যে, শুরুতে সরকারের সময়োপযোগী ও কার্যকর পদক্ষেপের কারণে আমাদের দেশে দ্রুত টিকা কার্যক্রম শুরু হয়। কিন্তু বিশ্বের উন্নত দেশগুলোর অসহযোগিতা ও তাদের জনসংখ্যার তুলনায় অতিরিক্ত টিকা মজুদের অসম প্রতিযোগিতার ফলে বাংলাদেশের মতো অন্যান্য স্বল্পোন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলোতে টিকা সরবরাহ প্রায় বন্ধ হয়ে যায়। 

এই পরিস্থিতিতে সরকার অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার পাশাপাশি চীন ও রাশিয়ার সঙ্গে টিকা ক্রয়ের চুক্তি করেছে, যা অনেকটা আশার সঞ্চার করেছে। কিন্তু দেশে ক্রমবর্ধমান করোনা সংক্রমণ সকলকে রীতিমতো বিচলিত করে তুলেছে। 

অতি দ্রুত সংক্রমণের এই ঊর্ধ্বগতির রাশ টেনে ধরতে না পারলে বিপর্যয় অনিবার্য। সম্ভাব্য এই বিপর্যয় এড়াতে এবং সংক্রমণের হার কমাতে ইতিমধ্যে অধিক সংক্রমিত এলাকাগুলোতে লকডাউন বা কঠোর বিধি-নিষেধ আরোপ করা হয়েছে। ঢাকা থেকে সকল গণপরিবহণ যাতায়াত বন্ধ করা হয়েছে। 

নিকট অতীতের অভিজ্ঞতায়, এই সমস্ত বিধি-নিষেধ সংক্রমণ রোধে কতটা কার্যকর ভূমিকা রাখবে তা প্রশ্নাতীত নয়। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ অনুযায়ী এসব বিধি-নিষেধের পাশাপাশি আরও কিছু কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করলে এই সংক্রমণ হার নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব।

প্রথমত, ঢাকা শহরে আগমন এবং বহির্গমন নিয়ন্ত্রণ করতে সামরিক বা আধা-সামরিক বাহিনী মোতায়েন করা যেতে পারে। সকল ধরনের ব্যক্তিগত গাড়ি, অটো রিকশা ঢাকার বাইরে যাতায়াত বন্ধ রাখতে হবে। পণ্যবাহী যানে যাত্রী পরিবহন নিষিদ্ধ করতে হবে। প্রয়োজনে এসব স্থানে কারফিউ ঘোষণা করতে হবে। 

দ্বিতীয়ত, অধিক সংক্রমিত এলাকায় জনসাধারণের চলাচল নিয়ন্ত্রণ এবং জরুরি প্রয়োজনে বাইরে বের হলে অবশ্যই মাস্ক পরা বাধ্যতামূলক করতে হবে। 

বিধি-নিষেধের পাশাপাশি আরও কিছু কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করলে সংক্রমণ হার নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব।

তৃতীয়ত, সংক্রমিত এলাকাগুলোতে র‌্যাপিড অ্যান্টিজেন টেস্টের ব্যবস্থা করতে হবে এবং জনসাধারণকে এই টেস্টের আওতায় আনতে হবে। জনসাধারণকে উদ্বুদ্ধ করে করোনার নমুনা পরীক্ষা আরও বাড়াতে হবে। নমুনা পরীক্ষা বাড়ানো হলে তা সংক্রমণ হার কমাতে সাহায্য করবে। সংক্রমিত রোগীকে আইসোলেশনে রেখে প্রয়োজনীয় চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হবে।

চতুর্থত, সংক্রমণ প্রতিরোধে জনসচেতনতা তৈরির লক্ষ্যে স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, সমাজের গণ্যমান্য ব্যক্তি, শিক্ষকসহ অন্যান্য পেশাজীবীদের সমন্বয়ে টিম গঠন করে প্রচার প্রচারণা চালাতে হবে। স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে জনসাধারণকে অনুপ্রাণিত করতে হবে।

সর্বোপরি, দ্রুত টিকা প্রাপ্তি নিশ্চিত করতে টিকা কূটনীতি জোরদার করতে হবে এবং সরকারকে কৌশলী ভূমিকা নিয়ে প্রতিশ্রুত টিকা সংগ্রহ নিশ্চিত করতে হবে। স্বল্পোন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলোতে পর্যাপ্ত টিকা সরবরাহ নিশ্চিত করতে উন্নত দেশগুলোকে এগিয়ে আসতে হবে।

অধ্যাপক ড. ফিরোজ আহমেদ ।। চেয়ারম্যান, ফার্মেসি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়