আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী
বাহাত্তরে আওয়ামী লীগ : প্রত্যাশা ও প্রাপ্তি
বাংলাদেশ আর আওয়ামী লীগ যেন একে অপরের পরিপূরক। আওয়ামী লীগের হাত ধরেই বাংলাদেশ একটি আলাদা রাষ্ট্রের ধারণার উন্মেষ এবং আওয়ামী লীগের নেতৃত্বেই আসে স্বাধীনতা। শুধু বাংলাদেশ নয়, এ উপমহাদেশেরই অন্যতম প্রাচীন রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ।
ভারতের কংগ্রেস, পাকিস্তানের মুসলিম লীগ আর বাংলাদেশের আওয়ামী লীগ। এই তিনটি দলকে ঘিরে তিনটি দেশের বিকাশ। ২৩ বছরের মুক্তিসংগ্রাম, নয় মাসের মুক্তিযুদ্ধ আর ৩০ লাখ শহীদের রক্তের বিনিময়ে ধর্মরাষ্ট্র পাকিস্তান থেকে স্বাধীন হয়েছিল বাংলাদেশ। আর স্বাধীন হয়েছিল বলেই বাংলাদেশ আজ উদীয়মান অর্থনীতির রোল মডেল।
বিজ্ঞাপন
৫০ বছরে বাংলাদেশ আর পাকিস্তানের মধ্যে সামর্থ্যে-সক্ষমতায়-ইমেজে এখন আকাশ-পাতাল ফারাক। গড় মাথাপিছু আয়ে ছাড়িয়ে গেছে শক্তিশালী অর্থনীতির ভারতকেও। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ, বিজয় এবং আজকের অগ্রগতি- সব আওয়ামী লীগের হাত ধরেই। তাই বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটির সাথে আওয়ামী লীগের নিবিড় সম্পর্ক।
ধর্মরাষ্ট্র পাকিস্তান গঠনের দুই বছরের মাথায় তখনকার পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের আশাভঙ্গ ঘটে। তারা বুঝে যান ‘ইয়ে আজাদি ঝুটা হ্যায়’। পশ্চিম পাকিস্তানীরা আমাদের স্বদেশি না হয়ে প্রভু হয়ে যায়। তাই তো পাকিস্তান গঠনের দুই বছরের মাথায় গড়ে ওঠে আওয়ামী মুসলিম লীগ। ক্ষমতায় তখন মুসলিম লীগ। আর বিরোধী দল হলো জনগণের মানে আওয়ামী মুসলিম লীগ। তবে গঠনের মাত্র ছয় বছরের মাথায় ১৯৫৫ সালে সংগঠনের নাম থেকে ‘মুসলিম’ শব্দটি বাদ দিয়ে সব মানুষের গণসংগঠনে পরিণত হয় আওয়ামী লীগ। তারপর শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের হাত ধরে গড়ে ওঠে অসাম্প্রদায়িক একটি দেশের ধারণা। এই ধারণার উপর ভিত্তি করে ৭০-এর নির্বাচনে গণরায় পায় আওয়ামী লীগ। তবে রায় পেলেও ক্ষমতা পায়নি আওয়ামী লীগ। একাত্তর সালে নয় মাসের মুক্তিযুদ্ধে ৩০ লাখ শহীদের রক্তের বিনিময়ে আসে স্বাধীনতা।
ভারতের কংগ্রেস, পাকিস্তানের মুসলিম লীগ আর বাংলাদেশের আওয়ামী লীগ। এই তিনটি দলকে ঘিরে তিনটি দেশের বিকাশ।
বাংলাদেশ নামের স্বপ্নের দেশটি পেলেও তাকে সোনার বাংলায় পরিণত করার মতো সময় পাননি বঙ্গবন্ধু। যুদ্ধবিধ্বস্ত একটি দেশ পুনর্গঠনে লড়াই চালাতে চালাতেই ১৯৭৫ সালে সপরিবারের প্রাণ দিতে হয় বঙ্গবন্ধুকে। তারপর ২১ বছরের অন্ধকারের ইতিহাস। ১৯৯৬ সালে জনগণের রায় নিয়ে ক্ষমতায় আসেন বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা। তার মূল দায়িত্ব ছিল অন্ধকার থেকে বাংলাদেশকে আলোর পথে ফেরানো। বিচারহীনতার সংস্কৃতি থেকে বাংলাদেশকে মুক্ত করা। তিনি শুরু করেন বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারের প্রক্রিয়া। কিন্তু সে প্রক্রিয়া শেষ করার আগেই পালাবদল ঘটে যায় ক্ষমতার।
নানান চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে শেখ হাসিনা আবার ক্ষমতায় আসেন ২০০৯ সালে। তারপর থেকে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশের এগিয়ে যাওয়ার গল্প। বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার শেষ হয়েছে, চলছে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের কাজ। শুধু বিচারহীনতার সংস্কৃতি থেকে জাতিকে মুক্ত করা নয়, একই সঙ্গে দেশকে এগিয়ে নেওয়ার দায়িত্বও শেখ হাসিনার কাঁধেই।
এই যে শেখ হাসিনা বাংলাদেশকে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা হিসেবে গড়ে তোলার পথে এগিয়ে যাচ্ছেন, এই অগ্রযাত্রায় তার প্রধান শক্তি আওয়ামী লীগ, দেশজুড়ে তৃণমূলে ছড়িয়ে থাকা আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা। আওয়ামী লীগকে অনেকবারই ধ্বংস করার চেষ্টা হয়েছে।
ষাটের দশকে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ ঘুরে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু ৭৫-এ সপরিবারে বঙ্গবন্ধু হত্যার পর অনেকেই ভেবেছিলেন আওয়ামী লীগ বুঝি শেষ। কিন্তু আওয়ামী লীগকে বাঁচিয়ে রেখেছিল নিবেদিতপ্রাণ কর্মীরা। ১৯৮১ সালে দেশে ফিরে শেখ হাসিনা যে আওয়ামী লীগের দায়িত্ব নিতে পেরেছিলেন, সেটা এই তৃণমূলের কর্মীরা সংগঠনকে বাঁচিয়ে রেখেছিল বলেই।
শেখ হাসিনা সব সময় কর্মীদের এই ত্যাগের কথা স্বীকারও করেন, ‘আওয়ামী লীগের নেতারা ওলটপালট করলেও কর্মীরা সবসময় ঠিক থাকে।’ ওয়ান ইলেভেনের বিপদে বাঘা বাঘা নেতারা নানা মাইনাস তত্ত্বে মেতে উঠলেও কর্মীরাই শেখ হাসিনাকে রক্ষা করেছেন। বিভিন্ন সময় অনেক ঝড়-ঝাপটা সামাল দিলেও আওয়ামী লীগের সবচেয়ে বড় পরীক্ষা কাল চলছে এখনই।
ক্ষমতার প্রবল স্রোতে ভেসে আসা অনেক হাইব্রিড কচুরিপানা এখন আওয়ামী লীগের অগ্রযাত্রাকেই রুখে দিতে চাইছে। আওয়ামী লীগের পরীক্ষিত ত্যাগী নেতাকর্মীরা এখন ব্যাক বেঞ্চার।
টানা তৃতীয় দফায় ক্ষমতায় থাকাটাই যেন আওয়ামী লীগের সবচেয়ে বড় দুর্বলতা হয়ে দাঁড়িয়েছে। ক্ষমতার প্রবল স্রোতে ভেসে আসা অনেক হাইব্রিড কচুরিপানা এখন আওয়ামী লীগের অগ্রযাত্রাকেই রুখে দিতে চাইছে। আওয়ামী লীগের পরীক্ষিত ত্যাগী নেতাকর্মীরা এখন ব্যাক বেঞ্চার।
সবখানেই দাপট সুখ পাখিদের। শেখ হাসিনা অনেক কষ্টে দেশকে যতটুকু এগিয়ে নেন, এই নতুন আওয়ামী লীগারদের একেকটি অপকর্ম তাকে তারচেয়ে বেশি পিছিয়ে দেয়। সময় এসেছে দলে একটি কঠিন শুদ্ধি অভিযানের। সকল আগাছা দূর করে সংগঠনকে এগিয়ে নিতে পরীক্ষিত ও আদর্শিক নেতৃত্বকে সামনে আনতে হবে।
৭২ বছরে আওয়ামী লীগ দেশকে দিয়েছে অনেক। কিন্তু দেশকে আরও এগিয়ে নিতে পরিচ্ছন্ন আওয়ামী লীগ চাই। শেখ হাসিনা দেশকে উন্নয়নের অন্য স্তরে পৌঁছে দিয়েছেন। কিন্তু পরিসংখ্যানের উন্নতিতে আত্মতুষ্টিতে ভোগার অবকাশ নেই। এখন হতে হবে মানবিক উন্নয়ন, বৈষম্যহীন এবং অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের লক্ষ্যে গণতান্ত্রিক অগ্রযাত্রা। আর এটা করতে হলে আওয়ামী লীগকে হতে হবে পরিচ্ছন্ন, দুর্নীতিমুক্ত এবং আগের মতো সাহসী, অকুতোভয়।
প্রভাষ আমিন ।। বার্তা প্রধান, এটিএন নিউজ
probhash2000@gmail.com