তারুণ্যের বাজেট, সংকট ও সমাধান
প্রতি বছর জাতীয় বাজেট ঘোষণার পর থেকে এর সামষ্টিক অর্থনৈতিক বিশ্লেষণের পাশাপাশি বিভিন্ন গোষ্ঠী, বিভিন্ন বয়সের মানুষ, বিভিন্ন এলাকার উন্নয়ন-নানান দিক থেকে এই বাজেটের ভালো-মন্দ দিক আলোচিত হতে থাকে। এবারও তার ব্যতিক্রম নয়।
২০২১-২২ অর্থবছরের জাতীয় বাজেট ঘোষণার পর থেকেই সে ধরনের পর্যালোচনা চলছে এবং মূলত পর্যালোচনাগুলো এই বাজেটকে ব্যবসাবান্ধব বলেছে। আবার অনেকেই বলছে বাজেট ব্যবসাবান্ধব হলেও কর্মসংস্থানের জন্য তা কতটা উপকারী তা দেখার বিষয়। এছাড়াও শিল্প, কৃষি, স্বাস্থ্য বাজেট, সামাজিক নিরাপত্তা খাতের জন্য বরাদ্দ, উন্নয়ন বাজেট, রাজস্ব আদায়ের দক্ষতা, স্বচ্ছতা, জবাবদিহি, ইত্যাদি নানান বিষয়ে আলোচনায় উঠে এসেছে।
বিজ্ঞাপন
আলোচনায় তরুণ সমাজের জন্য এই বাজেটের বিভিন্ন বরাদ্দ তাদের কর্মক্ষমতাকে কাজে লাগিয়ে, তাদেরকে দক্ষ জনশক্তিতে রূপান্তরে বর্তমান বাস্তবতায় কী ভূমিকা রাখবে, সে বিষয়টি খুব চোখে পড়েনি। আর যতটুকুই আলোচনা হয়েছে সেটা মূলত এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলোর বরাদ্দ কত হলো, কম না বেশি, সে জায়গাতেই সীমাবদ্ধ রয়ে গেছে।
কিছু কিছু ক্ষেত্রে কর্মসংস্থান নিয়ে আলোচনাতে তরুণ বেকারদের বিষয়টি হয়তো এসেছে, কিন্তু কারোনাকালীন বাস্তবতায় তরুণ সমাজের জন্য জরুরি পরিকল্পনা ও পদক্ষেপ দরকার। আর বাজেট বরাদ্দ সেই পরিকল্পনাকে ঘিরেই হওয়া দরকার।
তরুণ সমাজের জন্য এই বাজেটের বিভিন্ন বরাদ্দ তাদের কর্মক্ষমতাকে কাজে লাগিয়ে, তাদেরকে দক্ষ জনশক্তিতে রূপান্তরে বর্তমান বাস্তবতায় কী ভূমিকা রাখবে, সে বিষয়টি খুব চোখে পড়েনি।
এই মুহূর্তে তরুণদের বড় বাস্তবতা হলো তাদের শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ কার্যক্রমে বড় ধরনের বিপর্যয় করোনার কারণে শিক্ষার পাশাপাশি বিভিন্ন দক্ষতা উন্নয়ন কর্মসূচিগুলো তাদের স্বাভাবিক কার্যক্রম চালাতে পারছে না। এর প্রভাব অতি নিকট ভবিষ্যতেই কিন্তু আমরা উপলব্ধি করব।
শিক্ষা অর্জনের শেষ ধাপে, অর্থাৎ স্নাতক-স্নাতকোত্তর এরকম পর্যায়ে যে তরুণরা আছে, তাদের শিক্ষা জীবনের এই পর্যায়ে যে স্পেশালাইজেশন হওয়ার কথা-সেটি কিন্তু সঠিকভাবে হচ্ছে না।
অনলাইন ক্লাসের মাধ্যমে হয়তো কিছুটা ক্ষতি কমানোর চেষ্টা করা হচ্ছে কিন্তু সেখানেও আমরা জানি যে ধনী-দরিদ্র পরিবারের তরুণদের মধ্যে একটা বড় রকমের পার্থক্য ঘটে যাচ্ছে। তাছাড়া শিক্ষা জীবনের এই পর্যায়ে জ্ঞানের একটা বড় উৎস হলো হাতে-কলমে শিক্ষা, বিভিন্ন মাঠ পর্যায়ের গবেষণা প্রভৃতির মাধ্যমে শিক্ষা। অথচ সেই কার্যক্রম এখন নেই বললেই চলে। তাছাড়া প্রশিক্ষণ কর্মসূচিগুলো থমকে থাকায় যে সকল তরুণ চাকরির বাজারে ঢুকতে যাচ্ছিলেন তারা অনেকেই দক্ষতা নিয়ে চাকরিতে ঢোকার ক্ষেত্রে পিছিয়ে আছেন।
করোনাকে ঘিরে তরুণ সমাজের শিক্ষা ও দক্ষতা উন্নয়ন কর্মসূচির জন্য নতুনভাবে বিস্তারিত পরিকল্পনা নেওয়া দরকার এবং বাজেট বরাদ্দ হওয়া উচিত সেই পরিকল্পনামাফিক। কারণ এখন স্বাভাবিক অবস্থায় যে ধরনের প্রশিক্ষণ কর্মসূচি চালানো হয় সেভাবে বাজেট বরাদ্দ দিয়ে খুব লাভ হবে না।
এই মুহূর্তে আমাদের বুঝতে হবে যে খুব সহসাই আমরা সম্পূর্ণরূপে করোনাভাইরাস মুক্ত হয়ে যেতে পারছি না। বিশেষ করে জনসংখ্যার একটা বড় অংশ টিকা না নেওয়া পর্যন্ত। কাজে যে তরুণ সমাজ সহসাই কর্মজীবনে প্রবেশ দ্বারপ্রান্তে রয়েছেন, কিংবা যারা ইতোমধ্যে নানারকম প্রশিক্ষণ নিয়ে দেশে-বিদেশে কর্মবাজারে প্রবেশের জন্য চেষ্টা করছিলেন, তাদেরকে ঘিরে দক্ষতা উন্নয়ন কর্মসূচি চালু রাখতে হবে। প্রয়োজনে মোবাইল, বাসে করে বিভিন্ন রকম হাতে-কলমে প্রশিক্ষণ সামগ্রী প্রত্যন্ত অঞ্চলের সম্ভাব্য প্রশিক্ষণার্থীদের কাছে নিয়ে যেতে হবে।
২০২০ সালে করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের কারণে যেহেতু নতুন তরুণরা চাকরির জন্য প্রবাসে বা বিদেশে যেতে পারেননি, আগামীতে যা আমাদের রেমিট্যান্স প্রবাহে প্রভাব ফেলতে পারে তাই এখন দক্ষতা বৃদ্ধির ট্রেনিং দিয়ে আমরা যদি আগামীতে দক্ষ জনশক্তি বিদেশে পাঠাতে পারি তাহলে তারা বেশি আয় করে এই ক্ষতি পুষিয়ে দিতে পারবেন।
আত্মনির্ভরশীল হয়ে গড়ে ওঠার জন্য ইন্টারনেটের ভালো সুবিধা প্রত্যন্ত অঞ্চলেও ছড়িয়ে দেওয়া দরকার, যাতে তরুণরা এর সুবিধা নিয়ে নানান রকম ই-কমার্স ভিত্তিক উদ্যোগে সম্পৃক্ত হতে পারে।
আমদানিকৃত স্মার্টফোনের উপরে এবারের বাজেটে কর বৃদ্ধি করা হয়েছে যার ফলে স্মার্টফোনের দাম বাড়বে। কিন্তু বর্তমানে অনলাইনভিত্তিক পড়াশোনা, প্রশিক্ষণ কর্মসূচি, নানান রকম ব্যবসা-বাণিজ্য ইত্যাদিতে স্মার্টফোনের যে প্রয়োজন তাতে এর মূল্য বৃদ্ধি তরুণদের জন্য ক্ষতিকর হবে।
বর্তমান বাজেটে বিশেষ করে তরুণ উদ্যোক্তাদের জন্য বরাদ্দের বিষয়টি স্পষ্ট নয়। স্টার্টআপ বাংলাদেশ কলেবর বৃদ্ধির মাধ্যমে এই ধরনের উদ্যোগী তরুণদেরকে নতুন ব্যবসা-বাণিজ্য শুরু করার ক্ষেত্রে সহযোগিতা আরও বাড়ানো দরকার ছিল।
কর বসানোর বিষয়টি ভবিষ্যতে বাংলাদেশের স্মার্টফোন তৈরির উদ্যোগে সহযোগিতা করলেও এই মুহূর্তে সেটি হবে না। এখন যে পরিমাণ স্মার্টফোনের চাহিদা, তা পূরণ করার সক্ষমতা আসতে সময় লাগবে। অথচ এখন একটি জরুরি অবস্থার ভেতর দিয়ে আমরা যাচ্ছি। তাই এখন স্মার্টফোনের ওপর কর বসিয়ে তার দাম বাড়ানো ঠিক হবে না।
অতি উচ্চ মূল্যের স্মার্টফোনের উপর কর বসানো যেতে পারে, কিন্তু কম দামের স্মার্টফোন যেগুলো সাধারণত স্বল্পআয়ের পরিবারের তরুণরা ব্যবহার করে থাকেন তার মূল্য বৃদ্ধি পেলে শিক্ষা, প্রশিক্ষণ উদ্যোগ ইত্যাদিতে ধনী-দরিদ্রের ব্যবধান আরও বাড়বে।
বর্তমান বাজেটে বিশেষ করে তরুণ উদ্যোক্তাদের জন্য বরাদ্দের বিষয়টি স্পষ্ট নয়। স্টার্টআপ বাংলাদেশ কলেবর বৃদ্ধির মাধ্যমে এই ধরনের উদ্যোগী তরুণদেরকে নতুন ব্যবসা-বাণিজ্য শুরু করার ক্ষেত্রে সহযোগিতা আরও বাড়ানো দরকার ছিল। তরুণদেরকে কর্ম বাজারে প্রবেশের জন্য সহযোগিতা দিতে সরকারকে করোনার বাস্তবতায় ভাবতে হবে। এক্ষেত্রে বাজেট বরাদ্দ সেই পরিকল্পনা অনুযায়ী হতে হবে।
তরুণ সমাজের মানসিক স্বাস্থ্যের বিষয়টিতেও নজর দিতে হবে। অনলাইন সহযোগিতা, সহজলভ্য পরামর্শ প্রভৃতিতে বাজেট বরাদ্দ থাকা দরকার। এক্ষেত্রে সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড ভূমিকা রাখতে পারে। অথচ এই বাজেটে সাংস্কৃতিক মন্ত্রণালয়ের কার্যক্রমের জন্য বাজেট বরাদ্দ অতি সামান্য।
অনলাইনভিত্তিক সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড, বিতর্ক প্রতিযোগিতা, রচনা লেখা, গান ও অন্যান্য প্রতিযোগিতার আয়োজনের মাধ্যমে তরুণ সমাজের মানসিক স্বাস্থ্য ঠিক রাখার উদ্যোগ দরকার। মনে রাখতে হবে সাংস্কৃতিক বিভিন্ন কার্যক্রম কেবলমাত্র বিনোদনের জন্য নয়, বরং এই বিনোদন মানসিক স্বাস্থ্য ঠিক রাখার একটি উপায়। তাছাড়া সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়ে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে মানুষের মধ্যে এক ধরনের যোগসূত্র তৈরি হয়। এখন যেহেতু সরাসরি অনেক কার্যক্রম করা যাচ্ছে না তাই অনলাইন প্লাটফর্ম এই ধরনের কার্যক্রমের জন্য বরাদ্দ বাড়াতে হবে।
সর্বোপরি মনে রাখতে হবে তরুণদেরকে ঘিরেই আমাদের আগামীর ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা জড়িয়ে আছে। আমরা জানি যে, বাংলাদেশ তারুণ্যের আধিক্যের দেশ। আর সেই তরুণদের যদি এখন কাজে লাগানো না যায় তাহলে আগামীতে যখন বাংলাদেশ প্রবীণ আধিক্যের দেশে পরিণত হবে, তখন অর্থনীতির উৎপাদনশীলতা বজায় রাখা মুশকিল হবে। তাই করোনা আমাদের তরুণ সমাজের সামনে যে বাধার পাহাড় তুলেছে তা ডিঙ্গাতে পরিকল্পনামাফিক আগাতে হবে।
নাজনীন আহমেদ ।। সিনিয়র রিসার্চ ফেলো, বাংলাদেশ ইন্সটিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ (বিআইডিএস)