অর্থপাচারকারী কারা?
সম্প্রতি জাতীয় সংসদে ২০২১-২২ অর্থ বছরের বাজেট আলোচনায় বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর দুইজন সাংসদ দেশ থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ বিদেশে পাচার হয় বলে মন্তব্য করেন। জবাবে মাননীয় অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বললেন, অর্থ পাচারকারী কারা, তারা যদি সেই তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করেন, তাহলে পাচারকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া সহজ হবে। অর্থমন্ত্রী আরও বলেন, ‘কারা অর্থ পাচার করে, সেই তালিকা আমার কাছে নেই। নামগুলো যদি আপনারা জানেন, আমাদের দিন।’
দেশ-বিদেশে বহুল আলোচিত সংসদ সদস্য পদ হারানো লক্ষ্মীপুর-২ আসনের কাজী মোহাম্মদ শহিদ ইসলাম পাপুল যিনি বর্তমানে কুয়েতের জেলে আছেন। পাপুলকে আমি প্রভাবশালী সেই সাথে ভাগ্যবানও বলব, সে শুধু একা না বরং স্ত্রী সেলিনা ইসলামেরও ইচ্ছা পূরণ করেছেন। টাকার প্রভবে স্ত্রী সেলিনা ইসলামকেও সংরক্ষিত নারী সংসদের পদটি আদায় করে নিয়েছেন। এর আগে আমাদের দেশে স্বামী-স্ত্রী দু’জনই সংসদ সদস্য এমন ঘটনা সম্ভবত আর ঘটেনি। পদ-পদবীর জন্যই আমাদের দেশের রাজনীতি। একটি পদ পাওয়ার জন্য বা দল থেকে মনোনীত হয়ে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধির পদে নির্বাচিত হয়ে কাঙ্ক্ষিত আসনটিতে বসা প্রায় সকল রাজনৈতিক নেতা-কর্মীরই আকাঙ্ক্ষা কিন্তু কালো টাকার প্রভাব ত্যাগী রাজনৈতিক নেতা-কর্মীদের সেই আকাঙ্ক্ষা পূরণে অনেকটাই অন্তরায়।
বিজ্ঞাপন
কুয়েতের অপরাধ তদন্ত সংস্থা, মানব পাচার এবং প্রায় ৫৩ মিলিয়ন কুয়েতি দিনার (প্রায় ১ হাজার ৪০০ কোটি টাকা) পাচারের দায়ে মোহাম্মদ শহিদ ইসলাম পাপুলের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনে এবং কুয়েতের ফৌজদারি আদালত তাকে চার বছরের কারাদণ্ড দেন। অথচ ২০১৮ সালের নির্বাচনে পাপুল ও তার স্ত্রী টাকার জোরে সংসদ সদস্যের পদ বাগিয়ে নিয়েছেন তার বিভিন্ন তথ্য তৎকালীন সময়ে বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশ পেলেও আমাদের রাষ্ট্রের কর্তাব্যক্তিরা পাপুল ও তার স্ত্রী’র বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে ব্যর্থ হয়েছেন।
রাষ্ট্র মালিকানাধীন বেসিক ব্যাংকের ৩০০ কোটি টাকা আত্মসাৎ করে কানাডায় জাহাজ ব্যবসায়ী গাজী বেলায়েত হোসেন মিঠু (জিবি হোসেন), স্ত্রী নাহিদ আক্তার ও সন্তানদের নিয়ে আয়েশি জীবনযাপন করছেন কানাডায়। আনুমানিক ১৬ মিলিয়ন ডলার বা বাংলাদেশি টাকায় ১০৪ কোটি টাকার বাড়িতে বসবাস করছে।
একজন গৃহবধূ ১৪ লাখ ৫৬ হাজার কানাডীয় ডলার ব্যয় করে কানাডার অভিজাত এলাকায় একটি বাড়ি কেনেন কীভাবে?
কয়েক শত কোটি টাকা খরচ করে নিজের ও স্ত্রীর নামে বিভিন্ন ব্যবসা খুলে রাজকীয় জীবন পাড় করছেন মিঠু-নাহিদ দম্পতি। দুই ছেলে রাজকীয়ভাবে লেখাপড়া চালিয়ে যাচ্ছে আমেরিকায়। এর আগে আওয়ামী লীগের একজন প্রায়ত প্রভাবশালী নেতা ও মন্ত্রীর আমেরিকায় পড়তে যাওয়া পুত্রের নিউইয়র্ক শহরে এলাহী রিয়েল এস্টেট ব্যবসা নিয়ে সংবাদমাধ্যমে নানান প্রতিবেদন হলেও এর কোনোই প্রতিকার হয়নি। বরং এখন নাকি আরও বৃহৎ আকারে সেই ব্যবসা চলছে।
কয়েক দিন আগে বেসরকারি টেলিভিশনের অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে দেখতে পেলাম, কানাডার বেগম পাড়ায় নতুন বাড়ি নির্মাণ করেছেন বাংলাদেশি নাগরিক শামীমা সুলতানা ওরফে জান্নাতী। পাসপোর্টের তথ্য অনুযায়ী, শামীমা সুলতানা একজন গৃহবধূ। স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন আসে, একজন গৃহবধূ ১৪ লাখ ৫৬ হাজার কানাডীয় ডলার ব্যয় করে কানাডার অভিজাত এলাকায় একটি বাড়ি কেনেন কীভাবে? শামীমা সুলতানা আর কেউ নন, নাটোরের সংসদ সদস্য শফিকুল ইসলাম ওরফে শিমুলের স্ত্রী।
অর্থ কেলেঙ্কারিতে যুক্ত পিকে হালদার পরিচিত একটি নাম। দেশত্যাগের নিষেধাজ্ঞায় দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) চিঠি পৌঁছানোর আগেই বেনাপোল স্থলবন্দর দিয়ে পালিয়ে ভারত চলে গেছেন বলে আদালতে তথ্য দিয়েছিলেন এসবির ইমিগ্রেশন শাখা।
ফরিদপুরের রুবেল-বরকতের কথা কিন্তু আমরা ভুলতেই বসেছি। ফরিদপুর শহর আওয়ামী লীগের বহিষ্কৃত সাধারণ সম্পাদক সাজ্জাদ হোসেন ওরফে বরকত ও তার ভাই ফরিদপুর প্রেসক্লাবের বহিষ্কৃত সভাপতি ইমতিয়াজ হাসান রুবেলকে দুই হাজার কোটি টাকা পাচারের অভিযোগে গ্রেফতার করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।
একই অভিযোগে গ্রেফতার হয় ফরিদপুর জেলা ছাত্রলীগের তৎকালীন সভাপতি নিশান মাহামুদ শামীম। তৎকালীন সভাপতি নাজমুল ইসলাম খন্দকার লেবি ও জেলা শ্রমিক লীগের অর্থ সম্পাদক বেল্লাল হোসেন। এরপর কি আর কোনো উদাহরণ আছে?
২০১৮ সালে আন্তর্জাতিক ব্যবসা সাময়িকী ‘ফোর্বস’ সিঙ্গাপুরের শীর্ষ ধনীদের যে তালিকা প্রকাশ করেছে, তাতে ৩৪ নম্বরে ছিলেন বাংলাদেশের জনৈক ব্যবসায়ী। তখন আমার এক সিংগাপুরী ব্যবসায়ী বন্ধু আক্ষেপ করে বলেছিলেন, ঐ ব্যবসায়ী আশ্চর্য প্রদীপের বলে এই তালিকা দখল করেছেন!
গত ১৮ নভেম্বর ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি (ডিআরইউ) আয়োজিত মিট দ্য প্রেস অনুষ্ঠানে আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জনাব এ কে আব্দুল মোমেন বলেছিলেন, ‘রাজনীতিবিদরাই নন, বিদেশে বেশি অর্থ পাচার করেন সরকারি চাকরিজীবীরা। আমার ধারণা ছিল রাজনীতিবিদদের সংখ্যা বেশি হবে, কিন্তু আমার কাছে যে তথ্য এসেছে, যদিও এটি সামগ্রিক তথ্য নয়, সেটিতে আমি অবাক হয়েছি। সংখ্যার দিক থেকে আমাদের অনেক সরকারি কর্মচারীর বাড়িঘর সেখানে বেশি আছে এবং তাদের ছেলেমেয়েরা সেখানে থাকে। আমার কাছে ২৮টি কেস এসেছে এবং এর মধ্যে রাজনীতিবিদ হলেন চারজন। এছাড়া কিছু আছেন আমাদের তৈরি পোশাক শিল্পের ব্যবসায়ী। আমরা আরও তথ্য সংগ্রহ করছি। তবে পাচারে শুধু কানাডা নয়, মালয়েশিয়ারও একই অবস্থা। তবে তথ্য পাওয়া খুব কঠিন। বিভিন্ন মিডিয়ায় যে তথ্য বের হয়, হাজার হাজার কোটি টাকা পাচার হচ্ছে, আসলে সংখ্যাটি তত নয়।’
ফরিদপুর শহর আওয়ামী লীগের বহিষ্কৃত সাধারণ সম্পাদক সাজ্জাদ হোসেন ওরফে বরকত ও তার ভাই ফরিদপুর প্রেসক্লাবের বহিষ্কৃত সভাপতি ইমতিয়াজ হাসান রুবেলকে দুই হাজার কোটি টাকা পাচারের অভিযোগে গ্রেফতার করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।
তার এই বক্তব্যের পর মহামান্য আদালত একটু নড়েচড়ে বসেন। উচ্চ আদালত থেকে দুর্নীতি দমন কমিশনের কাছে বিদেশে টাকা পাচারকারীদের তথ্য চাওয়া হয়। গত ১৭ ডিসেম্বর দুর্নীতি দমন কমিশন আদালতে তথ্য উপস্থাপন করার চেষ্টা করলে মাননীয় বিচারক দুদকের আইনজীবীর কাছে ২২ নভেম্বরের পরে কী করেছেন তা জানতে চান। অবশ্য ২২ নভেম্বরের পর দুদক কী করছেন তা হয়তো আমাদের করোই আজ পর্যন্ত জানা হয়নি।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১৪ সালের ২৮ জুন জাতীয় সংসদে বলেছেন, তার সরকার বাংলাদেশি আমানতকারীদের তালিকা চেয়ে সুইজারল্যান্ড সরকারকে অনুরোধপত্র পাঠাবেন এবং পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনার ব্যবস্থা করবেন।
গত সাত বছরে কি এর কোনো অগ্রগতি আছে? সুইস ন্যাশনাল ব্যাংক (এসএনবি) প্রকাশিত গত বছরের প্রতিবেদনের তথ্যমতে, সুইজারল্যান্ডের বিভিন্ন ব্যাংকে (সুইস ব্যাংক) বাংলাদেশিদের সঞ্চয় বেড়েছে। ২০১৮ সালে বাংলাদেশিদের মোট সঞ্চয়ের পরিমাণ দাঁড়িয়েছিল ৬১ কোটি ৭৭ লাখ ফ্র্যাংক। বাংলাদেশি টাকায় প্রায় ৫ হাজার ৩৭৩ কোটি টাকা।
দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশিদের গচ্ছিত অর্থের পরিমাণ দ্বিতীয়। জমাকৃত এ টাকার পরিমাণ দেশের কমপক্ষে ১২টি বেসরকারি ব্যাংকের পরিশোধিত মূলধনের সমান। ২০১৭ সালে এর পরিমাণ ছিল ৪ হাজার ১৩৯ কোটি টাকা। সে হিসেবে আলোচ্য বছরে ১ হাজার ২৩৪ কোটি টাকা বেড়েছে। শতকরা হিসাবে যা প্রায় ২৯ শতাংশ। বাংলাদেশ থেকে পাচার হওয়া অর্থ ও পাচারকারীর সঠিক সংখ্যা কত তা বলা মুশকিল। তবে অর্থ পাচারকারী ও পাচারকৃত অর্থ ফেরত আনার প্রসঙ্গ এলেই সরকারের কর্তা ব্যক্তিদের মুখে শুধুমাত্র তারেক রহমান ও আরাফাত রহমানের নামই শোনা যায়।
টাকা পাচার রোধে বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ) এবং জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) কাজ করছে, তারপরও সাংসদ কাজী ফিরোজ রশিদ বিশ্বের যে সব দেশে আমাদের টাকা পাচার হয়ে দুর্নীতিবাজরা সেকেন্ড হোম তৈরি করছেন সেখানকার বাংলাদেশ দূতাবাসগুলোতে দুর্নীতি দমন কমিশনের বিশেষ সেল গঠন করার কথা বলেছেন। স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন আসে বিদেশে অবস্থানরত আমাদের দূতাবাসগুলোই বা কতটা দুর্নীতি মুক্ত? তারা কি তাদের দায়িত্ব কতটুকু পালন করতে পারছে?
মধ্যপ্রাচ্য, মালয়েশিয়া, সিংগাপুরসহ অনেক দেশের বাংলাদেশের দূতাবাসের কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে হুন্ডি, আদম ব্যবসাসহ অনেক অভিযোগই শুনে আসছি। সেখানে দুদকের বিশেষ সেল কি কর্মক্ষম হবে? এর আগে আমরা কানাডায় বসবাসরত বাংলাদেশিদের দেখেছি সেখানে বসবাসরত বাংলাদেশি দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে প্ল্যাকার্ড হাতে রাস্তায় দাঁড়াতে।
মাননীয় অর্থমন্ত্রী আমাদের দেশের শেয়ার বাজারের হাজার হাজার কোটি টাকা উধাও হয়ে গেছে। সেই জাদুকর কারা তা কিন্তু আপনারা জানার চেষ্টা করেননি বা জেনেও না জানার ভান করে আছেন। ব্যাংক লুট ও দুর্নীতির হাজার হাজার কোটি টাকা পাচার হয়ে যাচ্ছে এই পাচারকারী কারা তাও নাকি আপনাদের জানা নেই। তাই স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন জাগে, বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ) এবং জাতীয় রাজস্ব বোর্ডসহ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাজ কী? তারা কি তাহলে তাদের দায়িত্ব পালন করছেন না?
মাননীয় অর্থমন্ত্রী আপনি না জানলেও এই দেশের আমজনতা কিন্তু অবগত আছেন এই অর্থপাচারকারী কারা। যদিও কখনোই রাষ্ট্রীয়ভাবে হাতে গোনা দুয়েকজন ছাড়া কারো কিছুই হয়নি বা হবে না তবে সামাজিকভাবে আমাদের সাধারণ মানুষেরই দায়িত্ব এই অপরাধীদের কালো চেহারা উন্মোচন করা।
ওয়াসিম ফারুক ।। কলামিস্ট