রবীন্দ্রনাথের একটি বিখ্যাত গানের বাণী যা আমরা প্রায়ই হয়তো নিজের অজান্তেই গুনগুন করে গেয়ে থাকি-

‘যখন পড়বে না মোর পায়ের চিহ্ন এই বাটে,
তখন আমায় নাইবা মনে রাখলে...’

মনে এলো মোহাম্মদ নাসিম ভাইকে নিয়ে লিখতে বসে। বস্তুত, মানুষ যেন তার সশরীর আনাগোনার মধ্য দিয়ে, উপস্থিতির মধ্য দিয়ে, লেনাদেনার মধ্য দিয়েই স্মরিত হন। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথও তাকে মনে না রাখলে বিস্মিত হবেন না- এমন অনুভূতিই ব্যক্ত করেছেন তার গানের বাণীতে। কিন্তু তারপরও মায়া রয়ে যায়, ছায়া রয়ে যায়, রয়ে যায় মানুষের জন্য মানুষের কাজ বা কৃত্য। আর সেসবের মধ্য দিয়েই ফিরে ফিরে আসেন আমাদের প্রিয় মানুষেরা, আমাদের স্মরণে-মরমে। আমাদের প্রতিদিনের জীবনে। নানা কাজে নানা প্রসঙ্গে। মোহাম্মদ নাসিম তেমনই একজন।

স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঘনিষ্ঠ সহচর ক্যাপ্টেন এম. মনসুর আলীর সুযোগ্য রাজনৈতিক উত্তরাধিকারী আওয়ামী লীগ নেতা মোহাম্মদ নাসিমকে অনেক নামে ভূষিত করা যাবে। আমার কাছে তিনি শুধুই নাসিম ভাই। একজন আকণ্ঠ রাজনীতিবিদ মোহাম্মদ নাসিম কীভাবে আমার মতো একজন আকণ্ঠ সাংবাদিকের সহোদর ভাই হয়ে উঠেছিলেন, তা আজ সম্পূর্ণ স্মরণ করাও কঠিন। কিন্তু সত্য এটাই যে, আমরা পরস্পর পরস্পরের সহোদর হয়ে উঠেছিলাম। রাজনীতি ও সাংবাদিকতার পারস্পরিক স্বার্থসংশ্লিষ্টতার ঊর্ধ্বে উঠে গিয়েছিল আমাদের সম্পর্ক। কীভাবে তা আজ আর আমি বর্ণনাও করতে পারব না।

তিনি বেঁচে থাকতে প্রায় প্রতিদিনই আমার সঙ্গে তার কথা হতো। হয় আমি তাকে ফোন করতাম, না হয় তিনি আমাকে। প্রতিদিন রাতে যখন প্রেসে পরদিনের পত্রিকা ছাপার প্রিন্ট অর্ডার দিয়ে অবসর মিলত আমার, প্রায়ই সেই অবসরে ফোন করতেন নাসিম ভাই। খবর নিতেন, ফোনের অপর প্রান্ত থেকে ভেসে আসত তার গলা-

‘ভাই কেমন আছেন?’ ‘বড় ভাই কেমন আছেন?’ ‘মেজো ভাইয়ের খবর কী?’

আমি তার প্রতিটি প্রশ্নের উত্তর দিতাম- এটা ছিল আমাদের ফোনালাপের এক নির্মল আনন্দময় সংলাপ বিনিময়। ‘বড় ভাই’, ‘মেজো ভাই’ বলতে আমরা দুজনই দেশের দুজন বড় রাজনৈতিক নেতাকে বোঝাতাম,যারা দুজনই আমাদের দুজনের কাছে সমান শ্রদ্ধেয়, সমান সম্মানীয়। আমি তাকে কোনো রেফারেন্সে হয়তো বলতাম, ‘বড় ভাই, মেজো ভাইয়ের খবর তো আপনিই ভালো জানেন।’ তিনি উল্টো রেফারেন্সে আমাকে সে কথা ফিরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করতেন। এসব অম্ল-মধুর ফোনালাপ আর হয় না আমাদের-নাসিম ভাই চলে যাওয়ার পর।

একজন আকণ্ঠ রাজনীতিবিদ মোহাম্মদ নাসিম কীভাবে আমার মতো একজন আকণ্ঠ সাংবাদিকের সহোদর ভাই হয়ে উঠেছিলেন, তা আজ সম্পূর্ণ স্মরণ করাও কঠিন।

রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ কাজে সার্বক্ষণিক ব্যস্ততার মধ্যেও ফোন করলেই ফোন ধরতেন। কখনো ফোন ধরতে না পারলে কলব্যাক করতেন। কত স্মৃতি তার সঙ্গে!

’৯৭ সালে একবার নিয়ে গেলেন উত্তরা আবাসিক প্রকল্পের তৃতীয় ধাপের কাজ পরিদর্শনের সময়। দৈনিক জনকণ্ঠের ওবায়দুল কবির এবং সেই সময়ে ভোরের কাগজের প্রণব সাহা ও আমাকে নিয়ে গেলেন পূর্বাচল আবাসিক প্রকল্প এলাকায়। প্রকল্পটি তখনো পরিকল্পনার মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে। বনের মধ্যে, ঝোপ-জঙ্গল, অজগাঁয়ে জেগে উঠবে এক নতুন পরিকল্পিত উপশহর-যেন এক অবিশ্বাস্য স্বপ্নের রূপকথা! আমি, প্রণব সাহা, ওবায়দুল কবির গাজীপুর অংশের উঁচু টিলাগুলোকে রেখে নতুন শহর পরিকল্পনা করা যায় কি না, তা ভেবে দেখার কথা বললাম। নাসিম ভাই বললেন, ‘সেটা করা গেলে হয়তো ভালো হতো, কিন্তু নগর পরিকল্পনাবিদরাই ভালো বলতে পারবেন, তাদের ভাবনাই মেনে নিতে হবে-নতুন নগর পরিকল্পনায় হয়তোবা তারা এগুলোকে রেখেই তাদের পরিকল্পনার ডালি সাজাতে পারেন।’

তার সঙ্গে অনেক জায়গায় আমরা গিয়েছি। গাড়ি ও হেলিকপ্টারে। একবার বোধহয় সিরাজগঞ্জ থেকে ফেরার পথে ঝড়ের কবলে পড়লাম-তিনি বললেন, কী ভয় করছে? আমি বললাম, ভয় করছে না, আপনি ভয় পাইয়ে দিচ্ছেন। সে যাত্রায় আমরা নিরাপদেই ঢাকায় ফিরে এসেছিলাম।

তিনি ছিলেন ভীষণ অতিথিবৎসল। বীথি ভাবি (মিসেস নাসিম) ভালো কিছু রান্না করলেই খাওয়ার জন্য ডেকে নিয়ে গেছেন বহুবার। তার ছাদের বাগানে আড্ডা জমিয়েছি অসংখ্য দিন। নাসিম ভাই এবং আমার সম্পর্কের মধ্যে কোনো প্রটোকল ছিল না; এত অনায়াস ছিল সে সম্পর্ক যে আজ ভাবতেই অবাক লাগছে।

সন্দেহ নেই, পেশাগত দায়িত্বের সূত্র ধরেই সম্পর্কের সূচনা ঘটেছিল আমাদের, কিন্তু শেষ পর্যন্ত আমরা পরস্পরের সহোদর ভাই-ই হয়ে উঠেছিলাম। ফোনে তিনি ‘বড় ভাই’, ‘মেজো ভাই’-এর খবর জিজ্ঞেস করে নানা প্রসঙ্গে গড়িয়ে যেতে থাকলে আমি বলতে বাধ্য হতাম, ‘দেখেন আপনি হচ্ছেন সত্যিকার অর্থে আমার ‘সৎ’ ভাই। আর যাদের কথা বলছেন, তারা প্রায় সবাই আমার ‘আপন’ ভাই। তিনি হেসে মেনে নিতেন আমার দাবি। আসলে সম্পর্কের অনুভূতিটা ছিল আমাদের যেন প্রায় একই সমতলে, একই সম লয়েও। তার মন্ত্রিত্বের প্রটোকল, ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্সের প্রতিবন্ধকতা কখনো অনুভূত হয়নি আমার কাছে। জানি না কেন। কিন্তু হতে পারত, যদি গতানুগতিক আনুষ্ঠানিক হতো আমাদের সম্পর্কটি।

অগ্রজ রাজনীতিবিদদের প্রদর্শিত সেই পথে মোহাম্মদ নাসিমও হেঁটেছেন অকুতোভয়ে, আন্দোলনের রাজপথ ছেড়ে পিছু হটেননি এক পা-ও। স্বৈরাচারের পুলিশের লাঠিচার্জে মাথা ফেটে রক্তাক্ত হয়েছেন-পিছিয়ে আসেননি, পালিয়ে যাননি।

সর্বজন শ্রদ্ধেয় রাজনীতিবিদ আমির হোসেন আমু, তোফায়েল আহমেদ এবং আরও অনেকের সঙ্গে আমার সম্পর্ক অনেক আন্তরিকতাপূর্ণ এবং আনুষ্ঠানিকতার ঊর্ধ্বে। সাংবাদিক হিসেবে তাদের স্নেহ, ভালোবাসা আমার জীবনকে আশীর্বাদসিক্ত করেছে। এ দেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের অনেক টানাপোড়েনে, উত্থান-পতনের ধারাবাহিকতায় সে সম্পর্ক সুদৃঢ়ই হয়েছে। আমার সুদীর্ঘ সাংবাদিকতার জীবনে কাছে-দূরে, সুসময়-দুঃসময়ে থেকে তাদের দেখার সুযোগ হয়েছে। এদের অনেকেরই ত্যাগ তিতীক্ষা ও দেশপ্রেম তুলনাহীন। এরা যেমন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে দেশসেবার কাজ করেছেন, তেমনই তার সুযোগ্য কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সুদীর্ঘ রাজপথের আন্দোলন-সংগ্রামে থেকেছেন। থেকেছেন দেশ পরিচালনার কর্মেও। তাদের রাজনৈতিক প্রজ্ঞা থেকে শিখেছি এই সত্য যে, ‘জীবনের পথ কুসুমাস্তীর্ণ নয়।’ 

অগ্রজ রাজনীতিবিদদের প্রদর্শিত সেই পথে মোহাম্মদ নাসিমও হেঁটেছেন অকুতোভয়ে, আন্দোলনের রাজপথ ছেড়ে পিছু হটেননি এক পা-ও। স্বৈরাচারের পুলিশের লাঠিচার্জে মাথা ফেটে রক্তাক্ত হয়েছেন-পিছিয়ে আসেননি, পালিয়ে যাননি। পিতার মতোই ছিলেন আপসহীন-প্রতিক্রিয়াশীল শক্তিকে ভয় পাননি। সাংবাদিক হিসাবে তাকে অনড় আদর্শের অনমনীয় সৈনিক হিসাবে দেখেছি। দায়িত্ব পালন করেছেন ডাক ও টেলিযোগাযোগ, স্বরাষ্ট্র, পূর্ত ও স্বাস্থ্য-এমন গুরুত্বপূর্ণ ৪টি মন্ত্রণালয়ে। সর্বশেষ ছিলেন আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য।

সেই রাজপথের সাহসের সারথির চলে যাওয়ার ১ বছর হয়ে গেল। করোনা মহামারি তাকে নিয়ে গেছে। আমরাও করোনার ছোবলে আক্রান্ত হয়ে জীবন-মৃত্যুর দোলাচলে প্রতিদিন নতুন দিন ধরে জীবনযাপনে অভ্যস্ত হয়ে উঠছি। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা বাজেট অধিবেশনে সে কথাই ব্যক্ত করেছেন। আজ আছি, কাল না-ও থাকতে পারি-এমনই এক বাস্তবতায় আজ আমাদের অবস্থান।

এ অনিশ্চিত বাস্তবতায় বসে নাসিম ভাইয়ের সঙ্গে সাহচর্যের স্মৃতিগুলো যেন এক অত্যাশ্চর্য দ্যুতিময় অনুভূতি।

কীর্তিমান কর্মী পুরুষ কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের গানের বাণীর মতোই একদিন আমরা আর কেউই থাকব না। মিশে যাব মহাকালের স্রোতে; তারপরও হয়তো থেকে যাবে আমাদের কিছু কাজ, কিছু কথা, কিছু স্মৃতি। তেমনই স্মৃতির পাতা থেকে-গভীর কৃতজ্ঞচিত্তে নাসিম ভাইয়ের জন্য এই সামান্য কথা কটির নৈবেদ্য। তিনি বেঁচে থাকবেন, তার সমস্ত কাজের মাঝে। অনড় সাহসে। অকৃত্রিম আন্তরিকতায়। আমরা তাকে স্মরণ করি গভীর শ্রদ্ধা আর ভালোবাসায়।

সাইফুল আলম ।। সম্পাদক, দৈনিক যুগান্তর; সাবেক সভাপতি, জাতীয় প্রেসক্লাব