শেখ হাসিনার কারামুক্তি দিবস
তবুও শেখ হাসিনার বিকল্প নেই
সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দুই বছরের শাসনামল বাংলাদেশের রাজনীতির ইতিহাসে এক অন্ধকার অধ্যায়। নির্বাচন নিয়ে দুই দলের অনড় অবস্থান এবং অস্থিতিশীলতার ফাঁক গলে ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি শুরু হয়েছিল বিশেষ এই সরকার ব্যবস্থার, যার শেষ হয়েছিল ২০০৯ সালের ২৯ ডিসেম্বর নির্বাচনের মাধ্যমে।
সহিংস রাজনীতিতে অতিষ্ঠ মানুষ শুরুতে ১/১১-এর সরকারকে স্বাগতই জানিয়েছিল। দুর্নীতির বিরুদ্ধে বেশ কিছু ব্যবস্থা নিয়ে তারা শুরুতে জনগণের প্রশংসাও পেয়েছিল। কিন্তু রাজনীতি ঠিক করতে আসা এই সরকারের মূল লক্ষ্য ছিল রাজনীতিকেই নির্বাসনে পাঠানোর। তাদের লক্ষ্য ছিল রাজনীতি থেকে দুই নেত্রীকে মাইনাস করার। সেই লক্ষ্যেই ২০০৭ সালের ১৬ জুলাই শেখ হাসিনাকে গ্রেফতার করা হয়। অথচ ১/১১ সরকারের আগে ক্ষমতায় ছিলেন বেগম খালেদা জিয়া। পরে খালেদা জিয়াকেও গ্রেপ্তার করা হয়। দুই নেত্রীকে এক পাল্লায় তুলে ষড়যন্ত্রমূলক মামলা দিয়ে রাজনীতি থেকে বিদায় করার প্রক্রিয়ার অংশ ছিল সেটি।
বিজ্ঞাপন
১১ মাস সংসদ ভবন চত্বরে স্থাপিত বিশেষ কারাগারে থাকার পর ১১ জুন মুক্তি পান শেখ হাসিনা। মুক্তির ৭ মাসের মাথায় অনুষ্ঠিত নির্বাচনে বিপুলসংখ্যক রায় নিয়ে প্রধানমন্ত্রী হন শেখ হাসিনা। তারপর থেকে বাংলাদেশ এগিয়ে চলেছে তার নেতৃত্বেই। এখন চলছে তার তৃতীয় মেয়াদ। শেখ হাসিনার গত ১১ বছরের শাসনামলের অনেক সমালোচনা আছে। আবার এই ১১ বছরই বাংলাদেশের সবচেয়ে উজ্জ্বল অধ্যায়ও বটে। উন্নয়নকে মাপকাঠি ধরলে বাংলাদেশ এখন বিশ্বের বিস্ময়।
শেখ হাসিনা আমার প্রিয় চরিত্র। তিনি একজন মানবিক মানুষ, ভালো-মন্দ মিলিয়েই তিনি। তাই তাকে ভালো যেমন বাসি, তেমনি অনেক সমালোচনাও আছে। আমি জানি, খোলা মনে সমালোচনা গ্রহণ করার ঔদার্য তার আছে। পরিবারের প্রায় সবাইকে হারিয়ে, ২১ বার হত্যার চেষ্টা থেকে বেঁচে যাওয়া শেখ হাসিনা আসলে সর্বংসহা। তবে নব্য আওয়ামী লীগাররা শেখ হাসিনার কোনো সমালোচনাকেই গ্রহণ করতে পারেন না। গত ১১ বছরে আমরা ভিন্নমতকে পায়ে দলিত করে অদ্ভুত এক ‘সহমত ভাই’য়ের সংস্কৃতি গড়ে তুলেছি।
১১ মাস সংসদ ভবন চত্বরে স্থাপিত বিশেষ কারাগারে থাকার পর ১১ জুন মুক্তি পান শেখ হাসিনা। মুক্তির ৭ মাসের মাথায় অনুষ্ঠিত নির্বাচনে বিপুলসংখ্যক রায় নিয়ে প্রধানমন্ত্রী হন শেখ হাসিনা।
১৯৭৫ এর ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার সময় দেশের বাইরে থাকায় বেঁচে যান বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা। এরপর দেশে নেমে আসে ঘোর অমানিশা। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিপরীতে দেশে শুরু হয় পাকিস্তানীকরণ। স্বাধীনতা বিরোধীরা প্রধানমন্ত্রী পর্যন্ত হয়ে যান। রাজনীতি ঢুকে পড়ে ক্যান্টনমেন্টে। এই সময় ১৯৮১ সালের ১৭ মে দেশে ফেরেন বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা। তখন তার বয়স মাত্র ৩৪ বছর।
আওয়ামী লীগের মতো বড়, কোন্দল কবলিত এবং বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পর সরকারি নিষ্পেষণে ধ্বংস প্রায় একটি দলের সভাপতির দায়িত্ব নেওয়াটা ছিল ঝুঁকিপূর্ণ। শেখ হাসিনা সেই দায়িত্ব কতটা পালন করতে পারবেন, তা নিয়ে সংশয় ছিল অনেকেরই। দলের ঐক্যের প্রতীক হিসেবেই শেখ হাসিনাকে ফিরিয়ে আনা হয়েছিল। যারা তাকে ফিরিয়ে এনেছেন, তাদেরও ধারণা ছিল, শেখ হাসিনাকে সামনে রেখে তারাই দল চালাবেন। কিন্তু শেখ হাসিনা সবাইকে চমকে দিয়েছেন। টানা ৪০ বছর ধরে আওয়ামী লীগের সভাপতির দায়িত্ব শুধু পালনই করেননি; আওয়ামী লীগকে তুলে এনেছেন অন্যরকম উচ্চতায়। এখন শুধু দল নয়, দেশেও শেখ হাসিনার কোনো বিকল্প নেই। এমনকি আন্তর্জাতিক রাজনীতিতেও অনেকের আগ্রহের কেন্দ্রে তিনি।
শেখ হাসিনার জীবনের অনেকগুলো অধ্যায় আছে। কিন্তু জাতির জনকের কন্যা, নিজেও দীর্ঘসময় ক্ষমতার কেন্দ্রে থাকার পরও তিনি এতটাই মাটির কাছাকাছি। আমার ধারণা এর কারণ তার ছেলেবেলা কেটেছে তখনকার অজপাড়াগাঁ টুঙ্গিপাড়ায়। উদার প্রকৃতি আর মধুমতি থেকে উড়ে আসা কোমল বাতাস তার হৃদয়ে এই বাংলার জন্য যে ভালোবাসার জন্ম দিয়েছে, তা ক্রমশ বেড়েছে, পরিণত হয়েছে এই দেশকে এগিয়ে নেওয়ার দায়িত্বে। সেই থেকেই প্রকৃতির প্রতি তার অপার ভালোবাসা, মানুষের জন্য অগাধ দরদ তার মনে।
সংসারের বড় সন্তান হিসেবে মায়ের পাশে থেকে দেখেছেন দেশের জন্য বঙ্গবন্ধুর আত্মত্যাগ, আর সংসারের জন্য মায়ের কষ্ট। একাত্তরে অবরুদ্ধ বাংলায় মা হয়েছেন। তারপর বছর তিনেকের ‘ভিআইপি’ জীবন। সে ভিআইপি জীবন কেমন? তা এখনও দেখা যায় ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘরে গেলে। রাষ্ট্রপতির বাসার ড্রইংরুম, বেডরুম, ডাইনিং রুমের সঙ্গে আর দশটা মধ্যবিত্ত বাঙালি পরিবারের কোনো তফাত নেই। ১৯৭৫ এর পর ৬ বছর উদ্বাস্তু জীবন। ১৯৮১ থেকে রাজনৈতিক জীবন। তার ৩৫ বছরের রাজনৈতিক জীবনেও রয়েছে নানা বাঁক।
১৯৮১ সালে দেশে ফিরে শেখ হাসিনা শুরু করেন দ্বিমুখী সংগ্রাম। প্রথমত, ধ্বংসস্তূপ থেকে আওয়ামী লীগকে দাঁড় করানো। দ্বিতীয়ত, দেশকে সামরিক ও স্বাধীনতা বিরোধীদের কবল থেকে মুক্ত করা। সমান তালে চলে তার কর্মযজ্ঞ। ১৯৯০ এ স্বৈরাচারের পতনের পর ১৯৯১ সালে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসবে, এমন ধারণাই প্রচলিত ছিল। কিন্তু সব ধারণা পাল্টে দিয়ে জন রায় পায় বিএনপি। পরাজয়ের দায়িত্ব কাঁধে নিয়ে পদত্যাগ করতে চেয়েছিলেন শেখ হাসিনা। কিন্তু দলীয় নেতাকর্মীদের ভালোবাসার তোড়ে ভেসে যায় সব অভিমান।
১৯৮১ সালে দেশে ফিরে শেখ হাসিনা শুরু করেন দ্বিমুখী সংগ্রাম। প্রথমত, ধ্বংসস্তূপ থেকে আওয়ামী লীগকে দাঁড় করানো। দ্বিতীয়ত, দেশকে সামরিক ও স্বাধীনতা বিরোধীদের কবল থেকে মুক্ত করা। সমান তালে চলে তার কর্মযজ্ঞ।
আওয়ামী লীগের জন্য অনেক করেছেন, তাই আওয়ামী লীগের সামান্য বিচ্যুতিও তাকে কষ্ট দেয়। সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে বিরক্ত হয়ে একবার তিনি ছাত্রলীগের সাংগঠনিক নেত্রীর পদ থেকে নিজেকে সরিয়ে নিয়েছিলেন। বারবার নিজের অবসরের আকাঙ্ক্ষার কথা বলেছেন। কিন্তু যতই বলুন, এখনও আওয়ামী লীগ তো বটেই, দেশের জন্যও তার বিকল্প নেই।
২১ বছর পর ১৯৯৬ সালে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ক্ষমতায় আসে আওয়ামী লীগ। এসেই কাঁধে তুলে নেন ২১ বছরের জঞ্জাল পরিষ্কারের দায়িত্ব। প্রথম কাজ, জাতির জনককে সপরিবারে হত্যার বিচারের প্রতিবন্ধকতা দূর করা এবং বিচার শুরু। পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তি ফিরিয়ে আনতে করেন শান্তিচুক্তি। ভারতের সঙ্গে করেন গঙ্গার পানিবন্টন চুক্তি। ২০০৯ সালে দ্বিতীয় দফায় ক্ষমতায় এসে শুরু শেখ হাসিনার নেতৃত্বের উৎকর্ষের চরম প্রকাশ। বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার রায় কার্যকর করেন। এরপর শুরু হয় যুদ্ধাপরাধীদের বিচার। এই দুটি বিচার করে তিনি গোটা জাতিকে কৃতজ্ঞতা পাশে আবদ্ধ করেছেন। বিচারহীনতার সংস্কৃতির গ্লানি থেকে মুক্তি দিয়েছেন আমাদের। এই দফায় ভারতের সঙ্গে ৬৮ বছরের সীমান্ত সমস্যা সমাধান করে ছিটমহলবাসীকে স্বাধীনতার স্বাদ দিয়েছেন তিনি। এই দফায় শেখ হাসিনার মূল লক্ষ্য উন্নয়ন।
মুক্তিযুদ্ধের সত্যিকারের চেতনা উন্নত ও সমৃদ্ধশালী বাংলাদেশ। সেই লক্ষ্যেই অবিরাম ছুটে চলা তার এবং এই ছুটে চলা গোয়ারের মতো। পদ্মা সেতু প্রকল্প নিয়ে বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে টানাপোড়েনের পর শেখ হাসিনা সিদ্ধান্ত দেন, নিজেদের টাকায় পদ্মা সেতু বানাবেন। তখন তার মন্ত্রিসভার অনেকেই বিশ্বাস করেননি এটা সম্ভব। কিন্তু পদ্মা সেতু এখন আর কম্পিউটার গ্রাফিক্স নয়, স্বপ্ন নয়; বাস্তবতা। বছরখানেকের মধ্যে পদ্মা সেতুতে যান চলাচল শুরু হবে। তার বক্তৃতায়, আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তার অবয়ব থেকে যে আত্মবিশ্বাস ঠিকরে পড়ে সেটাই এখন বাংলাদেশের চিত্র। তার নেতৃত্বে বাংলাদেশ এখন উন্নয়নের রোল মডেল। বাংলাদেশ এখন উন্নয়নশীল দেশের কাতারে। মাথাপিছু আয়ে পাকিস্তান অনেক আগে থেকেই পেছনে, এবার পেছনে পড়েছে ভারতও।
নেতৃত্বের, ব্যক্তিত্বের এই চরম উৎকর্ষের সময়েই শেখ হাসিনার ইমেজ নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে, শুধু নির্বাচন প্রসঙ্গে। ৭২ বছর জুড়ে গণতন্ত্রের জন্য সংগ্রাম করা আওয়ামী লীগের সময়ে গণতন্ত্রই এখন প্রশ্নবিদ্ধ। যেটা অনাকাঙ্ক্ষিত। বাংলাদেশে নির্বাচন ব্যবস্থাটাই এখন এক হাস্যকর প্রবণতা হয়ে দাঁড়িয়েছে। ‘গণতন্ত্রের মানসকন্যা’র সময়েই দেশে গণতান্ত্রিক স্পেসের সবচেয়ে বড় সঙ্কটের অভিযোগ। রাজনীতি, রাজপথ থেকে নির্বাসিত অনেক আগেই। মতপ্রকাশের স্বাধীনতা বিবেচনায়ও আমাদের অবস্থান তলানিতে। উন্নয়নের দোহাই দিয়ে মানবাধিকার-গণতন্ত্রকে আড়াল করা হচ্ছে। যতই উন্নয়নের গল্প শোনানো হোক গণতন্ত্রের কোনো বিকল্প নেই। গণতান্ত্রিক পন্থায় উন্নয়নই টেকসই উন্নয়ন।
দেশ অনেক এগিয়েছে, এগোচ্ছে। উন্নয়ন কাজ হচ্ছে অনেক। তবে উন্নয়নের পথে সবচেয়ে বড় বাধা দুর্নীতি আর সুশাসনের অভাব। এখন শেখ হাসিনাকে নিশ্চিত করতে হবে দুর্নীতিমুক্ত টেকসই উন্নয়ন। নিশ্চিত করতে হবে সুশাসন। দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকার কারণে আওয়ামী লীগের মন্ত্রী-এমপি-নেতাদের অনেকেই জনবিচ্ছিন্ন, কর্মী বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছেন। অনেক এমপি নিজ নিজ এলাকায় একচ্ছত্র আধিপত্য কায়েম করেছেন। ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধেও অনেক অভিযোগ। আওয়ামী লীগের অনেকেই বঙ্গবন্ধু বা শেখ হাসিনার সত্যিকারের চেতনা ধারণ করে না। দলের দরজা খুলে দেওয়ায় বিভিন্ন দল থেকে ক্ষমতালোভী ধান্দাবাজ হাইব্রিডদের ভিড় এখন আওয়ামী লীগে। এখানে শেখ হাসিনাকে শক্ত হতে হবে, নিয়ন্ত্রণ রাখতে হবে। এমপি-মন্ত্রীদের পাঠাতে হবে মাটির কাছে, মানুষের কাছে।
১/১১-এর পর শেখ হাসিনার নেতৃত্বে রাজনীতি ফিরেছে। তার হাত ধরেই দেশ এগিয়ে যাচ্ছে উন্নয়নের মহাসড়ক ধরে। এবার শেখ হাসিনার হাত ধরেই বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক ও মানবিক রাষ্ট্র হয়ে উঠুক।
প্রভাষ আমিন ।। বার্তা প্রধান, এটিএন নিউজ
probhash2000@gmail.com