চলচ্চিত্র স্রষ্টা বুদ্ধদেব দাশগুপ্তের পরপারে চলে যাওয়ার মধ্যে দিয়ে বাংলা চলচ্চিত্রের আরেকটি অধ্যায়ের সমাপ্তি ঘটল। তিনি ১৯৪৪ সালে পুরুলিয়ায় জন্মগ্রহণ করেছিলেন এবং ছোটবেলা সেখানেই কেটেছিল। তার বাবা ভারতীয় রেলওয়ের একজন ডাক্তার ছিলেন।  তিনি কলকাতার স্কটিশ চার্চ কলেজ থেকে স্নাতক হয়ে অর্থনীতিতে প্রভাষক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেছিলেন। তারপর তিনি ফিল্ম-মেকিংয়ের দিকে ঝুঁকলেন এবং ১৯৬০ সালের শেষের দিকে ডকুমেন্টারি তৈরির মাধ্যমে এই জগতের যাত্রা শুরু করেছিলেন।

তার প্রথম ফিচার ফিল্মটি ছিল দূরত্ব (১৯৭৮)। তারপর একে একে তিনি তৈরি করেছেন ফেরা (১৯৮৮), বাঘ বাহাদুর (১৯৮৯), তাহাদির কথা (১৯৯২), চরিত্র (১৯৯৪), লাল দরজা (১৯৯৭), উত্তরা (২০০০), মন্দ মেয়ের উপাখ্যান (২০০২), কালপুরুষ (২০০৫) এবং টোপ (২০১৬) মতো চলচ্চিত্র।

এরমধ্যে পাঁচটিই জাতীয় পুরস্কারে ভূষিত হয়েছিল। তিনি নিজের জীবনকে চলচ্চিত্র নির্মাণে উৎসর্গ করেছিলেন এবং জীবনকে জীবনের মতো দেখতে বিশ্বাসী ছিলেন তাই তিনি কখনোই সস্তা জনপ্রিয়তা বা বাজার শক্তির চাপের কাছে হার মানেননি, তিনি প্রকৃত অর্থে কবি ছিলেন।

ততোধিক জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পুরস্কারপ্রাপ্ত চলচ্চিত্র নির্মাতা বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত নিজেকে ভারতের অন্যতম সেরা অফবিট চলচ্চিত্র নির্মাতা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছেন যার সিনেমাটিক ভাষাটি ভারতীয় চলচ্চিত্রকে সবচেয়ে উত্তেজনাপূর্ণ এবং শৈল্পিক সৃষ্টির সাথে ভূষিত করেছিল।

বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত নিজেকে ভারতের অন্যতম সেরা অফবিট চলচ্চিত্র নির্মাতা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছেন যার সিনেমাটিক ভাষাটি ভারতীয় চলচ্চিত্রকে সবচেয়ে উত্তেজনাপূর্ণ এবং শৈল্পিক সৃষ্টির সাথে ভূষিত করেছিল।

ভারতীয় সমান্তরাল সিনেমা আন্দোলনের অন্যতম অনুরাগী তিনি চলচ্চিত্র নির্মাণে পূর্ণকালীন ক্যারিয়ারের জন্য অর্থনীতিতে প্রভাষক হিসেবে চাকরি ছেড়ে দিয়েছিলেন। তার চলচ্চিত্রগুলোর মধ্যে একটি গীতিকল্পিত বাস্তবতা রয়েছে এবং তার আখ্যানের মাধ্যমে রাজনৈতিক যন্ত্রণা এবং বিমোচনের ধারাও তৈরি হতে দেখা যায়।

গৌতম ঘোষ এবং অপর্ণা সেনসহ বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত ১৯৮০ এবং ১৯৯০ এর দিকে বেশিরভাগ সময় বাংলায় সমান্তরাল সিনেমা আন্দোলনের পতাকাবাহক ছিলেন। পরিচালনাসহ একটি চলচ্চিত্র মূলধারার অভিনেতাদের জন্য সম্মানিত জাতীয় পুরস্কার জয়ের বিষয়টি নিশ্চিত করেছে। তার পূর্বের দূরত্ব (১৯৭৮), গৃহযুদ্ধ (১৯৮২) এবং অন্ধগলি (১৯৮৪) এর মতো চলচ্চিত্রগুলো বাংলায় নকশাল আন্দোলন এবং কীভাবে এটি বাঙালির সম্মিলিত চেতনাকে রূপদান করেছিল তার উপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করেছিল।

১৯৯৬ সালে আমি যখন কলকাতার রবীন্দ্র ভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র তখন লাল দরজা (১৯৯৭) ছবির সুবাদে তার সাথে আমার পরিচয়। আমার মনের মধ্যে চলচ্চিত্র পরিচালক হওয়ার স্বপ্ন জাগে তাকে দেখেই। চলচ্চিত্রটি সেই সময় ভারতসহ সারা পৃথিবীতেই আলোড়ন তুলেছিল এই জন্য চলচ্চিত্রটি আমার মনের মধ্যে যেন এক গভীর জায়গা দখল করে আছে। অভিনয় শিল্পী হিসেবে তখন  শুভেন্দু চ্যাটার্জি, বিপ্লব চ্যাটার্জি, ইন্দ্রানী হালদার, হারাধন বন্দ্যোপাধ্যায় ও বাংলাদেশের রাইসুল ইসলাম আসাদ আমার কাছে কেমন যেন আপন হয়ে উঠে।

সংগীতজ্ঞ হিসেবে চেনা বলিউডের বাইরে বাপ্পি লাহিড়ীও আমার কাছে আবিষ্কৃত হলো এক অন্য মাত্রায়। আমি দেখি চলচ্চিত্রের মাধ্যমে, বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত সেই অঞ্চলে প্রবেশ করেছেন যেখানে স্বপ্ন এবং স্মৃতির টেক্সচার প্রচলিত আখ্যান এবং চক্রান্তকে প্রতিপন্ন করে এবং পরিবর্তে একটি রোগী, মায়াবী এবং প্রতিবিম্ব সিনেমার মাধ্যমে অজ্ঞানতার মর্ম আলোকিত করার চেষ্টা করে যা কাব্যিক সরিকতার সীমানাকে অতিক্রম করে। তার চলচ্চিত্রের বাকি সমস্ত চিত্র এই ব্যক্তিগত পদ্ধতির সাথে কঠোরভাবে মেনে চলবে এবং তার পরবর্তী চলচ্চিত্রের মাধ্যমে পরিপক্বতা পরিপূর্ণতার শীর্ষে পৌঁছে যাবে।

এক সাক্ষাৎকারে অভিনেতা প্রসেনজিৎ বলেছেন, ‘বুদ্ধদাকে কেবল বাংলা ছবির পরিচালক বললে কম বলা হবে। ভারতীয় চলচ্চিত্রে তার অপরিসীম অবদান রয়েছে। একইসঙ্গে সারা বিশ্বে তিনি সমাদৃত...

চলচ্চিত্রটির মূল বিষয়টিতে, চিত্রনায়িকা নবীন দত্ত, যিনি তার চল্লিশের দশকের শেষের দিকে, কলকাতায় বসবাস করছেন এবং তার হাত-পা ধাতব রূপান্তরিত হচ্ছে এমন দুর্ঘটনার শিকার হয়ে গল্পটির বর্ণনা দিয়েছেন। স্ত্রী এবং ছেলের সাথে তার ব্যক্তিগত জীবনটি সমস্যাজনক এবং তিনি তিন মহিলার সাথে সুস্থ সম্পর্কের সাথে চালক দীনুর বর্বরতার দ্বারা প্রতারিত হয়ে পড়েছেন। তারও এমন একজন রোগী আছেন যিনি অপরাধী এবং যার সাথে তিনি ব্যর্থ হয়ে তার স্ত্রী হত্যার পরিকল্পনা করেন। এই সমস্ত বিশৃঙ্খলার মধ্যে এই অসন্তুষ্ট চিকিৎসক তার পূর্ববর্তী শৈশবকালের স্মৃতি এবং স্বপ্নগুলোতে সান্ত্বনা খুঁজে পান এবং লাল দরজা (১৯৯৭) জীবনের মানসিকতা থেকে তার মানসিক এবং কাল্পনিক মুক্তির প্রতীক। তার সহবর্তী মহানগরীর অস্তিত্বের মানবিক সম্পর্কের জটিলতাগুলোর জন্য নায়কের মানসিকতা এবং তদন্তগুলোতে অশান্তি প্রকাশ করতে চলচ্চিত্রটি প্রতীক এবং রূপক দিয়ে পূর্ণ।

চলচ্চিত্রটি নবীনের ব্যক্তিগত ইতিহাসের মধ্যে উদ্ভাসিত একটি স্বপ্ন-স্মৃতির মতো এবং সময়মতো খণ্ডিত ইতিহাসের মধ্যে একক, একীভূত স্মৃতি-চিত্র হিসেবে কাজ করে। আমার কাছে ওই অল্প বয়সে তখন এই বিষয়গুলো ছিল এক ভিন্ন অভিজ্ঞতা।

আনন্দবাজার পত্রিকায় এক সাক্ষাৎকারে অভিনেতা প্রসেনজিৎ বলেছেন, বুদ্ধদাকে কেবল বাংলা ছবির পরিচালক বললে কম বলা হবে। ভারতীয় চলচ্চিত্রে তার অপরিসীম অবদান রয়েছে। একইসঙ্গে সারা বিশ্বে তিনি সমাদৃত। ওনার সঙ্গে টরন্টোর মতো বিখ্যাত চলচ্চিত্র উৎসবগুলোতে গিয়ে দেখেছি, বাংলা ছবি বলতে তারা ‘বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত’-এর নাম উচ্চারণ করেন। তার ছবি নিয়ে দেশের বাইরে মানুষের প্রতিক্রিয়া দেখার সুযোগ পেয়েছি আমি।

বাস্তবতা এবং কল্পনার মধ্যে সম্পর্ক, আমাদের ক্রিয়ায় স্বপ্নের দর্শনের প্রতিচ্ছবি যেমন শিল্প প্রকৃতির একটি অনুকরণ। দাশগুপ্তের নির্মিত সিনেমা জগতের মধ্যে এটি এবং আরও অনেক কিছু অনুসন্ধান করা হয়। চলচ্চিত্র নির্মাতা তার সিনেমাটোগ্রাফিক তদন্তের বিষয়টির সাথে যে মায়াবী এবং বিকৃত সম্পর্কের বিকাশ ঘটায় তাতে দর্শকদের এমন নৈতিকতার সাথে অবিচ্ছেদ্যভাবে সংযুক্ত সচেতনতা সরবরাহ করা হয় যা সমাজের অদৃশ্য বাস্তবতাকে ভাষা দেওয়ার প্রয়াস পায়।

বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত সবসময়ই বলতেন আমাদের অবশ্যই দর্শকদের নিয়মিত ভালো ফিল্মগুলো দেখাতে হবে যাতে অন্তত ১০ বছরের মধ্যে আমরা চলচ্চিত্রের একটি মসৃণ উত্তরণ খুঁজে পেতে পারি।

নুরুল ইসলাম বাবুল ।। শিক্ষক, লেখক