বর্তমানে করোনা আক্রান্ত হওয়া রোগীর হার স্থিতিশীল রয়েছে। যদিও ঈদের সময় অজস্র মানুষের বাড়ি যাওয়া-আসা মিলিয়ে একটা নতুন ঢেউয়ের আশঙ্কা থেকে যাওয়ায় লকডাউন বাড়িয়ে ৩০ মে অবধি করা হয়েছিল। একই সাথে এতদিন ধরে গণপরিবহন বন্ধ থাকার পরে সেটাও চালু হয়েছে। সবমিলিয়ে জীবন এবং জীবিকার এই সমন্বয় করাটা খুব সহজ বিষয় নয়।

লকডাউন সাময়িক সময়ের জন্য ভালো হলেও দীর্ঘমেয়াদি এটা চালানো অসম্ভব। তাই করোনা নিয়ন্ত্রণ, তার বিস্তার রোধ, আক্রান্ত এবং মৃত্যুর হার কমানোর জন্য আমাদের হাতে থাকে মাত্র দুটি উপায়। প্রথমটি হচ্ছে-স্বাস্থ্যবিধি মানা। অবশ্যই মাস্ক পরা এবং হাত স্যানিটাইজ করা বা সাবান দিয়ে হাত ধোয়া। দ্বিতীয়টি হচ্ছে-ভ্যাক্সিনেশন কাজকে এগিয়ে নেওয়া।

যে কোনভাবেই হোক এ দুটি কাজে আমরা বেশ পিছিয়ে পড়েছি। যদিও টিকার কাজটা আমরা বেশ ভালোভাবে শুরু করেও এখন অনিশ্চয়তায় পড়েছি বাস্তবতার নিরিখে। সেখান থেকে আমাদেরকে ঘুরে দাঁড়াতে হবে। স্বাস্থ্যবিধি মানার জন্য জনগণকে উৎসাহিত করতে হবে। প্রচার এবং প্রচারণার কাজটি করতে হবে নিরন্তরভাবে। একই সাথে যারা নিয়ম মানতে আগ্রহী নন তাদেরকে বাধ্য করতে হবে এটা মানতে। প্রয়োজনে তাদেরকে জরিমানা অথবা হাসপাতালে কিংবা ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণের কাজে সপ্তাহে ২ দিন ১০ ঘণ্টা করে স্বেচ্ছাসেবা দিতে নির্দেশনা দেওয়া যেতে পারে। এটা অভিযুক্ত ব্যক্তির সম্মতি নিয়েই করতে হবে। তিনি কোনটি চান? জরিমানা (কমপক্ষে ১০০০ টাকা) নাকি স্বেচ্ছাসেবা?

টিকা প্রদানের জন্য পরিসংখ্যানগত ইতিহাসের আলোকে ঝুঁকি বিবেচনায় নিয়ে ঢাকা, গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ, মুন্সিগঞ্জ, ঢাকা জেলার অন্যান্য এলাকা, চট্টগ্রাম সিটি এবং পাশের এলাকাকে প্রথমে অগ্রাধিকার দিতে হবে।

এখন আসল কথায় আসি। টিকা বা ভ্যাকসিন প্রসঙ্গে। প্রতিমাসে ৫০ লাখ ডোজ করে অ্যাস্ট্রাজেনেকার ভ্যাকসিন আসবে এমন চুক্তির পরে এ অবধি আমরা চুক্তি এবং উপহার মোট মিলিয়ে ১ কোটি ডোজের উপরে ভ্যাকসিন পেয়েছিলাম। কিন্তু আচমকা ভারতে করোনা পরিস্থিতি খারাপ হওয়া এবং আমেরিকা কর্তৃক টিকা উৎপাদনের কাঁচামাল সরবরাহে ঘাটতি তৈরি করায় সেরাম ইন্সটিটিউট আর এ সময়ে আমাদের দেশে প্রতিশ্রুত টিকা সরবরাহ করতে পারছে না বলে জানিয়েছে। এতে করে আমাদের এখানে কয়েক লক্ষ লোকের সময়মতো ২য় ডোজ নিয়ে একটা অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে। অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকার ২য় ডোজ সময়মতো না দিতে পারলে যারা ১ম ডোজ নিয়েছেন তাদের নেওয়া টিকা কতটা কাজ করবে তা নিয়ে সন্দেহ থেকেই যাচ্ছে।

যদিও সরকার এ অবস্থায় বসে নেই। তারা চীন এবং রাশিয়ার কাছ থেকে টিকা কেনার উদ্দেশ্যে চুক্তি করার জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। পত্রিকা থেকে যতদূর জেনেছি, এসব ভ্যাকসিন আসতে হয়তো কিছুটা সময় লাগবে। এ দুই দেশ থেকে ২ কোটি ডোজ টিকা কেনার তোড়জোড় চলছে। সামনে কোভ্যাক্স থেকেও আমরা টিকা পাব। অন্যদিকে, সেরামের সাথে আমাদের চুক্তি তো বহাল আছেই। ফলে ভারতে পরিস্থিতির উন্নতি হলে হয়তো আমরা আগামী দেড়/দুই মাসের মধ্যেই অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকাও পেতে শুরু করব। এ অবস্থায় তাই টিকা ব্যবস্থাপনা নতুন করে সাজানোর কথা চিন্তা করা যেতে পারে।

যেমন সম্প্রতি চীন থেকে পাওয়া ১০ লাখ ডোজ টিকা দেওয়ার গাইডলাইন তৈরি হয়েছে। আগামীতে প্রাপ্ত টিকা আমরা কোথায় এবং কীভাবে ব্যবহার করব সে ব্যাপারেও মনে হয় এখন থেকেই ভাবা যেতে পারে। এক্ষেত্রে আমার প্রস্তাবনা হচ্ছে-করোনায় আক্রান্তের হারের পরিসংখ্যান বিবেচনায় নিয়ে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে টিকা দেওয়ার স্থান নির্ধারণ করতে হবে। তাতে টিকাদানের কাজটি অধিকতর ফলপ্রসূ হয়ে উঠবে।

এজন্য টিকা প্রদানের জন্য পরিসংখ্যানগত ইতিহাসের আলোকে ঝুঁকি বিবেচনায় নিয়ে ঢাকা, গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ, মুন্সিগঞ্জ, ঢাকা জেলার অন্যান্য এলাকা, চট্টগ্রাম সিটি এবং পাশের এলাকাকে প্রথমে অগ্রাধিকার দিতে হবে। অন্যদিকে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান দীর্ঘসময় ধরে বন্ধ থাকায় শিক্ষার্থীদের যে ক্ষতি হচ্ছে, সেটা থেকে বের হয়ে আসার জন্য দেশব্যাপী ১৮ বছরের উপরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অধ্যয়নরত সকলকে টিকা দিয়ে দিতে হবে। শিক্ষা কাজের সাথে জড়িত শিক্ষকদের, স্টাফ, ছাত্র-ছাত্রীদের পরিবারের সদস্য (যারা এখনো টিকা নেননি) তাদেরকেও টিকার আওতায় আনতে হবে।

টিকা ক্রয় এবং ব্যবস্থাপনার টার্গেটটা এমন করে ঠিক করা উচিত যেন, আমরা আগামী বছরের শুরুর মাস দুয়েকের মধ্যে পুরো দেশব্যাপী টিকা দেওয়ার কাজটা শেষ করে ফেলতে পারি।

এর সাথে টিকার আধিক্য থাকলে খুলনা, রাজশাহী, সিলেট, ময়মনসিংহসহ সীমান্তবর্তী জেলাগুলোর মানুষকে টিকার আওতায় আনতে হবে। তারপরে টিকার আওতায় আনতে হবে জেলা শহরগুলো। এর পরে আসবে থানা ও গ্রাম এলাকা। তবে, এর ভেতরে কোনো এলাকায় যদি পরিসংখ্যানগতভাবে দেখা যায় যে, সেখানে করোনা আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা উদ্বেগজনক ছিল তাহলে সেই সকল এলাকাকেও প্রথম কাতারেই টিকার আওতায় আনতে হবে।

মোদ্দা কথা হচ্ছে, টিকা প্রাপ্তির সার্বিক অবস্থা বিবেচনায় নিয়ে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে পরিসংখ্যানগত যেখানে করোনা আক্রান্তের হার বেশি সেসব এলাকায় আগে টিকার কাজ শুরু এবং শেষ করা দরকার সবার আগে। তারপর কম আক্রান্ত এলাকা এবং তারপরে বাদ বাকি এলাকার কথা ভাবতে হবে। এতে করে করোনার বিস্তার, আক্রান্তের হার এবং মৃত্যুকে চ্যালেঞ্জ জানানো সম্ভবপর হবে। 

পরিশেষে বলব, টিকা ক্রয় এবং ব্যবস্থাপনার টার্গেটটা এমন করে ঠিক করা উচিত যেন, আমরা আগামী বছরের শুরুর মাস দুয়েকের মধ্যে পুরো দেশব্যাপী টিকা দেওয়ার কাজটা শেষ করে ফেলতে পারি। এজন্য আমরা প্রায় ৯ মাস সময় হাতে পাচ্ছি। এটা সম্ভবপর হলে স্বাভাবিক জীবনে হয়তো আমরা ফিরে আসতে পারব। পুরো বিশ্ব থেকে করোনা নির্মূল না হওয়া অবধি স্বাস্থ্যবিধি মানার ব্যাপারে কঠোর পরিস্থিতি বজায় রাখতেই হবে।

ডা. পলাশ বসু ।। সহযোগী অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান, ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগ, এনাম মেডিকেল কলেজ, সাভার।