বিশ্ব পরিবেশ দিবস
অভিজাত মলে নয়, পুরো পৃথিবীটাই হোক অক্সিজেন বার
হুক্কা বার, কফি বার, ওয়াইন বার এসব তো শুনেছেন। কিন্তু অক্সিজেন বার-এর নাম আপনারা শুনেছেন? আমেরিকা, জাপান, কানাডার শহরবাসী এখন এর সঙ্গে পরিচিত। দিল্লিতে ২০১৯ সালে প্রথমবারের মতো অভিনব অক্সিজেন থেরাপির ধারণা নিয়ে কাজ শুরু করেছেন ২৬ বছরের যুবক আর্যবীর কুমার।
দিল্লির বিষাক্ত বায়ু থেকে কিছুক্ষণের জন্য মুক্তি পেতে দক্ষিণ দিল্লির ‘সিলেক্ট সিটি ওয়াক মল সাকেট’-এ বসানো হয়েছে অভিজাত অক্সিপিউর অক্সিজেন বার। তবে এই বিশুদ্ধ প্রাণবায়ু গ্রহণ করে শরীরকে চাঙ্গা করে তুলতে পকেটও চাঙ্গা থাকতে হবে। মাত্র ১৫ মিনিটের জন্য অক্সিজেন বার ব্যবহার করতে খরচ হবে ৪৯৯ রুপি। বিদেশে এই থেরাপি ইতোমধ্যেই রমরমিয়ে চলছে। যদিও চিকিৎসকদের মতে এই থেরাপির কোনো ব্যাখ্যা নেই। বরং প্রয়োজন ছাড়া শরীরে আলাদা করে অক্সিজেন নিলে হিতে বিপরীত হতে পারে বলেই মত ডাক্তারদের। আমাদের এই প্রিয় পৃথিবীর পরিবেশকে আমরা এমনভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করেছি যে, এখন আমাদের অক্সিজেন অভিজাত মল থেকে কিনে গ্রহণ করতে হচ্ছে।
বিজ্ঞাপন
পরিবেশ সচেতনতা এবং সংরক্ষণে প্রতিবছর ৫ জুন পালিত হয় বিশ্ব পরিবেশ দিবস। এবারের পরিবেশ দিবসের মূল প্রতিপাদ্য, ‘বাস্তুতন্ত্র পুনরুদ্ধার’। কোনো একটি পরিবেশের জীব এবং জড় উপাদানসমূহের মধ্যে পারস্পরিক ক্রিয়া, আদান-প্রদান ইত্যাদির মাধ্যমে যে তন্ত্র গড়ে ওঠে তাই বাস্তুতন্ত্র।
একটি পূর্ণবয়স্ক ব্যাঙ একদিনে তার ওজনের সমপরিমাণ কীটপতঙ্গ খেয়ে ফসলের সুরক্ষা করতে পারে। অথচ এই পোকামাকড় দমনের জন্য অনিয়ন্ত্রিতভাবে কীটনাশক প্রয়োগ করা হচ্ছে যার ফলে ধ্বংস হচ্ছে ব্যাঙ, দূষিত হচ্ছে পরিবেশ।
কোনো স্থানের প্রাণী, উদ্ভিদ এবং জড় উপাদান নিজেদের মধ্যে এবং একে অপরের মধ্যে ক্রিয়া-বিক্রিয়া করে বেঁচে থাকে। বাস্তুতন্ত্রের সকল উপাদানসমূহ পরস্পরের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। বাস্তুতন্ত্রের বিপুলসংখ্যক জীববৈচিত্র্যের পারস্পরিক সম্পর্কের কারণেই পরিবেশে ভারসাম্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। প্রতিনিয়ত প্রকৃতিকে অযাচিত ও অন্যায়ভাবে ব্যবহারের মাধ্যমে বাস্তুতন্ত্রকে নষ্ট করে পৃথিবীকে আমরা ভারসাম্যহীন করে চলেছি। জলবায়ু পরিবর্তনের ভয়াবহতা বিবেচনায় এই মুহূর্তে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন ক্ষতিগ্রস্ত বা ধ্বংস হয়ে যাওয়া বাস্তুতন্ত্রকে পুনরুদ্ধার করা।
পরিবেশের যেকোনো একটি ক্ষুদ্র উপাদানের ক্ষতি বা বিলুপ্তি বিরাট বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে। বিশ্বব্যাপী করোনা মহামারি আমাদেরকে দেখিয়েছে এবং শিখিয়েছে পরিবেশ কতটা গুরুত্বপূর্ণ আমাদের জন্য। পরিবেশ বিষয়ে আমাদের অজ্ঞতার কারণে যে জীবকে এক সময়ে অপ্রয়োজনীয় মনে করা হতো সময়ের বিবর্তনে সেই জীব সম্প্রদায় পরিবেশ রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ধরা দিয়েছে।
উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, একটি পূর্ণবয়স্ক ব্যাঙ একদিনে তার ওজনের সমপরিমাণ কীটপতঙ্গ খেয়ে ফসলের সুরক্ষা করতে পারে। অথচ এই পোকামাকড় দমনের জন্য অনিয়ন্ত্রিতভাবে কীটনাশক প্রয়োগ করা হচ্ছে যার ফলে ধ্বংস হচ্ছে ব্যাঙ, দূষিত হচ্ছে পরিবেশ।
পাখিদের প্রধান খাদ্য পোকামাকড়। এর মধ্যে ফসলের জন্য ক্ষতিকর কীটপতঙ্গই বেশি। তাছাড়া উদ্ভিদের পরাগায়ন, বিস্তার ও প্রজাতি রক্ষায় পাখি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। অথচ এই পাখিদের পুড়িয়ে হত্যা করার ঘটনাও বাংলাদেশে ঘটেছে। পেঁচা, ঈগল, চিল, বাজপাখিকে আমরা শিকারি প্রজাতি হিসেবে জানি। এরা ক্ষতিকর ইঁদুর খেয়ে ইঁদুরের সংখ্যা নিয়ন্ত্রণে রাখে।
মানুষের বসতবাড়িতে বসবাসকারী একজোড়া ইঁদুর বিনা বাধায় বংশবিস্তার করলে এক বছরে তার পরিবারের সংখ্যা দাঁড়াবে ৮৮০-তে। কিন্তু একটি পেঁচা দিনে কমপক্ষে তিনটি ইঁদুর খেয়ে এদের নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। কাক, চিল ও শকুন ময়লা আবর্জনা খেয়ে পরিবেশ ঠিক রাখে এবং রোগজীবাণু বিস্তার রোধে ভূমিকা রাখে। এজন্য বাস্তুতন্ত্রের কোনো জীবকেই ‘অপ্রয়োজনীয়’ বলা যায় না। পরিবেশ থেকে কোনো উদ্ভিদ বা প্রাণী বিলুপ্ত হলে বাস্তুতন্ত্রের স্থিতিশীলতা নষ্ট হয়।
পৃথিবীর জনসংখ্যা ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং মানুষ আধুনিক জীবনযাপনে অভ্যস্ত হচ্ছে। মানুষের চাহিদা মেটাতে গিয়ে প্রাকৃতিক উপাদান ধ্বংস করা হচ্ছে।
আমাদের এ সুন্দর পৃথিবীকে মানুষ ও অন্যান্য জীবের বসবাসযোগ্য করার জন্য পরিবেশ সংরক্ষণ অপরিহার্য। পৃথিবীতে রয়েছে অসংখ্য জীব, আর তাদের জীবন ধারণের জন্য বিভিন্ন উপাদান- বায়ু, মাটি, পানি, ইত্যাদি। পৃথিবীর জনসংখ্যা ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং মানুষ আধুনিক জীবনযাপনে অভ্যস্ত হচ্ছে। মানুষের চাহিদা মেটাতে গিয়ে প্রাকৃতিক উপাদান ধ্বংস করা হচ্ছে। প্রকৃতি ও পরিবেশের ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র উদ্ভিদ এবং প্রাণী থেকে শুরু করে বৃহদাকৃতির যে কেউই কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। খাদ্য শৃঙ্খলের প্রতিটি জীবের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে।
পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় উদ্ভিদ ও প্রাণীকুল একে অপরের সাথে নিবিড়ভাবে আবদ্ধ। বিভিন্ন প্রজাতির উদ্ভিদ, পশুপাখি, কীটপতঙ্গ, মানুষ ইত্যাদি নিয়ে গড়ে উঠেছে জীববৈচিত্র্য। পাহাড়, অরণ্য, জলাভূমি, সমুদ্র জীববৈচিত্র্যের অতীব প্রয়োজনীয় আধার। তাই পরিবেশ সুরক্ষিত থাকলে মানুষের বেঁচে থাকার প্রয়োজনীয় উপাদান—অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, ওষুধ, জ্বালানি নিরবিচ্ছিন্নভাবে পাওয়া সম্ভব।
পরিবেশ ক্ষতিগ্রস্ত হলে বিশেষ করে উদ্ভিদ ক্ষতিগ্রস্ত হলে বৃষ্টিপাতের হার কমে যাবে। ফলে চাষাবাদের যথেষ্ট ক্ষতি হবে। বিশ্বব্যাপী জনসংখ্যা বৃদ্ধি, শিল্পায়ন এবং পরিবেশ দূষণের ফলে ধীরে ধীরে পৃথিবী উষ্ণ হয়ে উঠছে যার ফলে গ্রিন হাউজ প্রতিক্রিয়া দেখা দিচ্ছে এবং বাস্তুতন্ত্র ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। পরিবেশ সুরক্ষিত থাকলে এর তীব্রতা থেকে রক্ষা পাওয়া যাবে।
মানুষের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য পরিবেশ সংরক্ষণের প্রতি বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন। কোনো একটি শিল্পকারখানা অথবা যেকোনো স্থাপনা নির্মাণের পূর্বেই সে এলাকার পরিবেশের উপর বিরূপ প্রভাব হিসেব করে দেখতে হবে এবং সেখান থেকে উৎপাদিত বর্জ্য ব্যবস্থাপনা পরিবেশবান্ধব ভাবে করতে হবে। সুন্দর মানব সভ্যতা তৈরির লক্ষ্যে পরিকল্পিত নগরায়ন এবং সৌর শক্তির ব্যবহার করা প্রয়োজন।
রাসায়নিক সার এবং কীটনাশক—যেগুলো বাস্তুতন্ত্রের জন্য ক্ষতিকর সেগুলোর ব্যবহার কমিয়ে জৈব সার এবং জৈব কীটনাশক ব্যবহারে উৎসাহিত করতে হবে। বায়ু, পানি, মাটি, শব্দ দূষণ যেন না হয় সেরকম সব ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। পরিবেশ দূষণ জীববৈচিত্র্য রক্ষা করতে জনসচেতনতা প্রয়োজন। এক্ষেত্রে সরকারি সংস্থা এবং পরিবেশবাদী সংগঠনগুলো মুখ্য ভূমিকা পালন করতে পারে। বাংলাদেশ এবং আন্তর্জাতিক পরিবেশ নীতিকে যথার্থভাবে অনুসরণ করে পরিবেশ রক্ষায় দুর্বার আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। অন্যথায় আমাদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার সংগ্রামে আমরা পরাজিত হব।
আমরা অভিজাত মলে গিয়ে অক্সিজেন ক্রয় করতে চাই না, পরিবেশ থেকে বুক ভরে অক্সিজেন নিতে চাই। প্রকৃতি ও পরিবেশের সাথে বৈরিতা নয়, চলুন সেতুবন্ধন রচনা করে অক্সিজেনের পরিপূর্ণ আধারে রূপান্তরিত করি আমাদের এই প্রিয় পৃথিবীকে।
অধ্যাপক ড. কবিরুল বাশার ।। প্রাণিবিদ্যা বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়