উৎসবকেন্দ্রিক বিনোদনে নির্মাণ-বিনির্মাণের গল্প

ঈদ, পূজা, বৈশাখ বা বিভিন্ন উৎসবকে কেন্দ্র করে টেলিভিশন নাটক, টেলিফিল্ম, ইউটিউব, ওটিটি এবং সিনেমাতে প্রযোজকরা যেমন অর্থলগ্নি করে থাকেন, তেমন দর্শকরাও আগ্রহ ও অপেক্ষায় অধীর থাকেন। এই সময় দারুণ সব অনুষ্ঠান বা প্রোডাকশন নির্মিত হয়।
গণমাধ্যম বলছে, অন্যান্য বছরের ন্যায় এই বছর ঈদেও সব মাধ্যমে একাধিক প্রোডাকশন আসছে। সুসংবাদ। নাটক, সিনেমার টিজারগুলোও খুব আকর্ষণীয়। দর্শকপ্রিয় অভিনয়শিল্পীদের উপস্থিতি দেখে মনে দোলা দেয়। কোন প্রোডাকশন কোনটাকে ছাপিয়ে যাবে, তা নিয়ে একপ্রকার গুঞ্জন শুরু হয়ে যায়।
বিজ্ঞাপন
তবে, দুর্দান্ত সব টিজার দেখে চমকিত হলেও একটু শঙ্কা কাজ করে ‘আসলে কেমন হবে?’। সিনেমাগুলো পপকর্নের মতো হবে না তো! শুধু খেলাম অথচ পেট ভরলো না! অর্থাৎ দেখলাম, মনে দাগ কাটলো না বা হল থেকে বের হয়ে ফুড কোর্টে বসে খাবার অর্ডার দিয়ে, আড্ডা দিতে দিতেই সিনেমার গল্প ভুলে গেলাম।
আবার টেলিভিশন নাটক দেখতে বসে বারবার ফোন স্ক্রিনের লক খুলে ফেসবুক স্ক্রল করা মানে টানছে না। হা করে নাটক, সিনেমা কিন্তু গেলা যায়। চুলায় তরকারি বা ভাত পুড়লেও কোনো আফসোস লাগে না। উল্টো দর্শক সেইসব গল্প এবং প্রোডাকশন-ই দেখতে চায়। মনে রাখতে হবে, হাওয়াই মিঠাই আড্ডার বিষয় নয়, সাথী মাত্র।
অবাক হয়ে দেখি, নাটক, টেলিফিল্ম, ওটিটি প্রোডাকশনে যেভাবে নাচ-গান যুক্ত করা হচ্ছে, তা কোনো অংশে সিনেমার থেকে কম নয়। দারুণ বিনোদন। নাটক মনে না থাকলেও, গান হিট। তাহলে সিনেমার থেকে পার্থক্য কোথায় থাকে! ওদিকে সিনেমা হলে মুক্তি পেতে না পেতেই কিছুদিন পরই ওটিটিতে রিলিজ পায়! তাহলে কেন সিনেমা হলে গিয়ে মানুষ সিনেমা দেখবে। ঘরে শুয়ে-বসেই তো আরামে দেখতে পারবে ক’দিন পর। তারপরও মানুষ দেখবে। যদি সেই সিনেমা গণমানুষের কথা বলে। হৃদয়ের কথা বলে। ঘরের কথা বলে। বলে মনের কথা।
এই যে মনের কথা’র অর্থ কিন্তু কেবল প্রেম বা বিরহ বা বিয়ে করার মানসিকতা নয়। বাবা, মা, স্ত্রী, স্বামী, সন্তান, পরিজন, বন্ধু সর্বোপরি পরিবার ও পারিপার্শ্বিক গল্প তো হতে পারে। নাকি পারে না? সংকটের গল্প হতে পারে, শ্রমজীবী থেকে শুরু করে রেমিট্যান্স যোদ্ধাদের গল্প হতে পারে, শিশু ও নারীর গল্প হতে পারে। আরও কত বিচিত্র বিষয় যে গল্পের প্লট হতে পারে তা বলে শেষ করা যাবে না।
দর্শক হয়তো মুখে ‘আছে কোনো রকম’, ‘নাহ, ঠিক দাগ কাটলো না’ ইত্যাদি ইত্যাদি বলে। আসলে তো দর্শক বিনোদনের পাশাপাশি নিজের দেখা, শোনা অভিজ্ঞতার মাধ্যমে নাটক বা সিনেমার সাথে একটা সংযোগ স্থাপনের চেষ্টা করে। নিজের কৃষ্টি, আচার, সংস্কৃতিকে খোঁজার চেষ্টা করে।
দুর্দান্ত সব টিজার দেখে চমকিত হলেও একটু শঙ্কা কাজ করে ‘আসলে কেমন হবে?’। সিনেমাগুলো পপকর্নের মতো হবে না তো! শুধু খেলাম অথচ পেট ভরলো না! অর্থাৎ দেখলাম, মনে দাগ কাটলো না...
আমরা যেমন মাছে-ভাতে বাঙালি তেমন আমাদের সমাজের সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যময়তা উপস্থাপনের চেষ্টা চলে প্রতিনিয়ত। আর রাজনৈতিক বিষয়, সেতো দর্শকদের পাতে তুলে দেওয়া মাছের কাঁটা গলায় বিঁধে যাওয়ার মতো, মহা বিপদ। তাহলে পারিবারিক সূক্ষ্মাতি সূক্ষ্ম বিষয়গুলো আমরা কেন তুলে ধরি না! শুধু প্রেম, প্রেম আর প্রেম। এত প্রেমের স্রোতে মাঝে মধ্যে পারিবারিক যে নাটকগুলো দেখা যায় সেগুলোই কিন্তু আলোচনায় উঠে আসে বারংবার।
প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে উৎসবের ধরন বদলেছে। একেকজন একেকভাবে উৎসব উদযাপন করে। সেটাও দর্শকদের সামনে উপস্থাপিত হতে দেখা যায় না। উৎসবকে কেন্দ্র করে একটি পরিবারের আয়োজন, মানি লন্ডারিং, বিভিন্ন ধরনের স্ক্যাম, প্রেমের জোয়ারে ভেসে যাওয়া, প্রেমে ব্যর্থ হওয়া, প্রেম পাবার জন্যে মরিয়া হয়ে যাওয়া; আবার সাম্প্রতিক সময়ের ঘটে যাওয়া কোনো ভয়াবহ ঘটনা প্রোডাকশনের বিষয়বস্তু হিসেবে দেখা যায় আজকাল। তাহলে উৎসবের আনন্দ কোথায়?
শুধু কী ‘আনন্দমেলা’ বা ‘ইত্যাদি’র মতো একটি অনুষ্ঠানের মধ্যেই তা সীমাবদ্ধ! আর নাটক বা সিনেমা অপরাপর দেশের সাথে সামঞ্জস্য রেখে নিজ দেশে উপস্থাপন করা! সিনেমা হতেই পারে। তবে, নাটক একটা, দুটো ভিন্নধর্মী গল্প হতে পারে কিন্তু দর্শক চায় আরও বেশি।
মার্কেটিং, প্রযোজক অনেক সময় পরিচালককে বলেন, ফানি/ফান, ট্রেন্ডিং, ট্র্যাকের বাইরের নাটক চিন্তা করেন। খুব কমই বলতে শুনেছি স্নিগ্ধ, মোলায়েম, মিষ্টি, আবেগী, বন্ডিংয়ের কনসেপ্ট চিন্তা করেন। নানা চিন্তা, সংকট, সমস্যার চাপে মানুষ বড় অস্থির থাকে। এই অস্থিরতা আরও বেড়েছে বিভিন্ন অ্যাপের কারণে।
পিতা-মাতার সাথে সম্পর্ক, সন্তানের আবদার/আহ্লাদ, অগ্রজ-অনুজের সুসম্পর্ক, বন্ধুত্বের বাঁধন, প্রেমের সম্মান, স্বামী-স্ত্রীর ভাব ভালোবাসা, মমত্ব ইত্যাদি অনুভূতি কেমন যেন মূল্যহীন হয়ে পড়ছে। তাই ভিজ্যুয়াল মিডিয়াগুলোয় এমন কাজ প্রয়োজন যা মানুষকে ভাবাবে, কাঁদাবে, ভালোবাসায় ভাসাবে আবার দায়িত্ববোধের অনুভূতিতে নাড়া দিয়ে যাবে।
আরও পড়ুন
বিনোদন বিনোদিত করলেও সব শিক্ষার অনুষঙ্গ। তাই ভিজ্যুয়াল মিডিয়ার ভূমিকা অস্বীকার করার কোনো সুযোগ নেই। তারপরও যদি ট্রেন্ডের বিষয়ে আসি বিশ্বের অন্যান্য দেশগুলোয় পরিবার, সম্পর্ক নিয়ে প্রোডাকশন বেড়েছে। আবার মেটাফরিক বা রূপকভাবে বা সরাসরি সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক বিষয়গুলোও তুলে ধরা হচ্ছে।
বাংলাদেশেও চেষ্টা করা হয় কিন্তু বিধি-নিষেধের ঘোরপ্যাঁচে একটা জট লেগে যায়, বিষয়বস্তু অর্থবহ হয় না। তাই স্বচ্ছ, সুশৃঙ্খলভাবে যা দেখানো সম্ভব সেদিকে মনোযোগী থাকা বাঞ্ছনীয়।
একটা গল্পকে অহেতুক জটিল করে তোলারও প্রবণতা দেখা যায় কোনো কোনো কাজে। সত্যি বলতে কী, সহজ সরলের আলাদা গ্রহণযোগ্যতা আছে। তাই জটিল করে ক্রাইসিস তৈরি করা বা সাসপেন্স বিল্ড আপ করা বড় কঠিন কাজ। এই কঠিনকেও কিন্তু সহজভাবে দর্শকদের বোধগম্য করে তোলাটা অনেক বড় দায়িত্ব।
তাই শুধু নিজের চিন্তা নয়, অভিনয়শিল্পীদের চিন্তা নয়, টেকনিশিয়ানদের চিন্তা নয় আপামর জনগণের চিন্তা করে ঈদের এই বিগ বাজেটের কাজগুলো নিশ্চয়ই ভাবেন প্রযোজনা সংস্থা এবং পরিচালকবৃন্দ। আবার যদি ভিউয়ের কথা চিন্তা করি কোটি কোটি ভিউ হওয়া কাজগুলোও কিন্তু অনেক সময় দর্শকনন্দিত হয় না। মানুষ দেখে অথচ মুগ্ধ হয় না। তাই ভিউয়ের চেয়ে দর্শকদের চাওয়া ও দেওয়া নিয়ে সদা সতর্ক থাকতে হবে।
আরও একটি বিষয়, একাধিক নাটকে একই চেহারাগুলো মাঝে মাঝে নাটক বা সিনেমার স্বাদ নষ্ট করে। হ্যাঁ, অভিনয়শিল্পী মানে সব মাধ্যমে কাজ করবে। তবে, একই মুখ একাধিকবার দেখা মাঝে মধ্যে সমস্যা সৃষ্টি করে। প্রয়োজন অনেকটা রান্নার মতো স্বাদের পরিবর্তন। যেমন রান্নায় প্রাচ্যের সাথে পাশ্চাত্যের বা বাঙালিয়ানার সাথে চাইনিজের যে ফিউশন করা হয়, অনেকটা তেমন। পুরাতন অভিনয়শিল্পীর সাথে নতুন সহশিল্পী।
ভিজ্যুয়াল মিডিয়া বড় একটা মার্কেট। লেন্স, ফ্রেম, লাইট, অ্যাকশন এবং ইমোশনের মাধ্যমে বিশ্বের আনাচে কানাচে পৌঁছানো যায় অনায়াসে। তাই প্রয়োজন নিজেদের গল্প বলা।
স্ট্র্যাট্রিজিক্যালি সিনেমা টিভিতে দেখা, নাটক ইউটিউবে দেখে নেওয়ার প্রবণতাটা টেলিভিশনের প্রতি আগ্রহ কমিয়ে দিচ্ছে। ভিজ্যুয়াল মিডিয়া এমন একটা চলমান প্রক্রিয়া যেখানে প্রচুর রিসার্চ প্রয়োজন, প্রয়োজন দর্শকদের মনস্তত্ত্ব জানা। প্রতিটি মাধ্যমের ব্যবসাকে আলাদা করার প্রয়াসে কোনো না কোনো স্ট্র্যাটিজি গ্রহণ করতে হবে। ভিজ্যুয়াল মিডিয়া বড় একটা মার্কেট। লেন্স, ফ্রেম, লাইট, অ্যাকশন এবং ইমোশনের মাধ্যমে বিশ্বের আনাচে কানাচে পৌঁছানো যায় অনায়াসে। তাই প্রয়োজন নিজেদের গল্প বলা। অন্য কোনো গল্পের অনুকরণ দর্শক সহজে নিতে পারে না।
তবে, এবার ঈদে মনে হচ্ছে, বড় পর্দায় প্রিয় অনেক মুখ এবং ভিন্ন স্বাদের গল্প পাওয়া যাবে। টেলিভিশন এবং ওটিটিতে একই মুখের ভিন্ন ভিন্ন চরিত্র কতটা ভিন্নতা দেবে- সেটা এখন দেখার অপেক্ষা। আশার বিষয় হলো, দেশের পাশাপাশি বিদেশে শুট করা নাটকও দেখা যাবে। যা একধরনের ভালোলাগা।
কমে আসছে ঈদের প্রোডাকশন নিয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণ। ভালো শোনার পাশাপাশি নেতিবাচক সমালোচনারও প্রয়োজন। এতে দর্শকদের মনোভাব ও দেখার স্বাদ বোঝা যায়। করা যায়, আগামীর পরিকল্পনা। সর্বোপরি, মনে রাখতে হবে ব্যক্তিবাদের চেতনায় মানুষ দায়িত্বশীলতার অনুভূতি হারিয়ে ফেলে, উদাসীন ও উন্নাসিক হয়ে পড়ে অনেক সময়। তাই সর্বসাধারণের বিনোদনের কথা নাটক, টেলিফিল্ম, সিনেমা ও সিরিজ নির্মাণ করে এগিয়ে যাবে আমাদের ভিজ্যুয়াল মিডিয়া।
নাজনীন হাসান চুমকী ।। অভিনেত্রী, নাট্যকার ও পরিচালক