শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা, দুর্বল ব্যবস্থাপনা ও বাস্তবতা
সকলের মনে এখন একটি প্রশ্নই ঘুরপাক খাচ্ছে সেটি হলো, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কবে খুলবে? আসলে আমাদেরতো দেশজুড়ে সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করার মতো পরিস্থিতি কখনোই তৈরি হয়নি। সেই গত বছরের মার্চের শেষের দিকে যখন করোনা আমাদের দেশে প্রথম শনাক্ত হলো তখন থেকে এখন পর্যন্ত দেশব্যাপী সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করার মতো পরিস্থিতি হয়নি।
ইতালির জনসংখ্যা আমাদের তিন ভাগের এক ভাগ। ওখানে এখনো প্রতিদিন প্রায় ৩৫০-৪০০ জন করোনায় মারা যাচ্ছে। করোনা আসার পর আমাদের সবচেয়ে খারাপ অবস্থার মতো এত ভালো অবস্থা ইতালিতে আসেনি। একই কথা বলা চলে ইংল্যান্ড কিংবা আমেরিকার ক্ষেত্রেও। ওদের দেশে যখন প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ মারা যাচ্ছিল তখনো দেশজুড়ে সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেয়নি। যেখানে লকডাউন বা রেড জোন হিসেবে ঘোষণা করা হয় সেইসব জায়গায় কেবল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ছিল যদিও অনলাইন ক্লাস তখনো চালু ছিল।
বিজ্ঞাপন
আমাদের পাশের দেশ ভারতেও কখনো পুরো দেশজুড়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করে রাখা হয়নি। যেখানে সংক্রমণ বেশি খারাপ সেখানে স্কুল সাময়িক বন্ধ রেখেছে। বিশ্বের কোনো দেশ তাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কী রকম খোলা বা বন্ধ রেখেছে তার একটি ম্যাপ ইউনেস্কো প্রকাশ করেছে। সেই ম্যাপে যেই ১৩টি দেশ সারা বছর জুড়ে দেশের সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রেখেছে বাংলাদেশ তাদের একটি। এই ১৩ বা ১৫টি দেশের মধ্যে প্রায় কোনোটিই উন্নত দেশ নয় এবং কোনোটিরই করোনা পরিস্থিতি এত খারাপ ছিল না যে, দেশজুড়ে বন্ধ রাখতে হবে।
আমরা হাসপাতালগুলোর সক্ষমতা বাড়াইনি। বাড়াইনি কারণ যারা নীতি-নির্ধারক তারাতো আমাদের স্বাস্থ্য এবং শিক্ষার ভোক্তা না। তারা অসুস্থ হলে বিদেশে চিকিৎসার জন্য দৌড়ান। তাদের ছেলেমেয়েরা শিক্ষার জন্য বিদেশে দৌড়ায়।
আমরা শুরু থেকেই ঢাকা, চট্টগ্রামসহ কয়েকটি বড় বড় শহর ব্যতীত পুরো দেশের সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সতর্কতা হিসেবে স্বাস্থ্যবিধি মানতে বাধ্য করে খোলা রাখতে পারতাম। কিন্তু আমাদের সরকার সেই দিকে হাঁটলেন না। কারণ হলো আমাদের এখানে দৈনিক ১০০ মানুষ মারা গেলেই দেশজুড়ে আইসিইউ পাওয়া, হাসপাতালে বেড পাওয়া নিয়ে একেবারে হাহাকার পড়ে যায়।
আমাদের চেয়ে অনেকগুণ খারাপ অবস্থায়ও ইউরোপ আমেরিকায় যেখানে হাজার হাজার মানুষ মারা যায় সেখানেও এত হাহাকার হয় না। কারণ আমাদের মানুষ সচেতন না। সচেতন হওয়ার জন্য যেই শিক্ষিত জনগোষ্ঠী দরকার আমরা সেই মানুষ তৈরি করতে পারিনি। কারণ আমরা হাসপাতালগুলোর সক্ষমতা বাড়াইনি। বাড়াইনি কারণ যারা নীতি-নির্ধারক তারাতো আমাদের স্বাস্থ্য এবং শিক্ষার ভোক্তা না। তারা অসুস্থ হলে বিদেশে চিকিৎসার জন্য দৌড়ান। তাদের ছেলেমেয়েরা শিক্ষার জন্য বিদেশে দৌড়ায়। এইরকম ভঙ্গুর স্বাস্থ্য-শিক্ষা ব্যবস্থার মধ্যে সরকারের জন্য সবচেয়ে সহজ এবং নিরাপদ কাজ হলো সব বন্ধ করে দেওয়া। নেতৃত্ব মানে চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করা। চ্যালেঞ্জিং সময়েই নেতৃত্বের পরীক্ষা হয়। আমাদের সরকার পরীক্ষা দিতে ভয় পায়। জাতির পিতা, বঙ্গবন্ধু হয়ে উঠতে পেরেছিলেন কারণ তিনি চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করে পরীক্ষা দিয়ে পাশ করেছেন।
আমাদের উচিত আর একটি দিনও নষ্ট না করে অতি শীঘ্রই ঢাকার বাইরের সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়া। ঢাকাসহ বিভাগীয় শহরগুলোর প্রতিষ্ঠানগুলোর ক্ষেত্রে হাইব্রিড ব্যবস্থা চালু করতে পারি। অর্থাৎ পরীক্ষাগুলোর সময় কমিয়ে নম্বর একই রেখে অন-সাইট বা অফলাইন নিতে পারি। এমনকি স্কুলের ক্লাসগুলো রোস্টার করে এমনভাবে সাজাতে পারি যেন প্রতিটি ছাত্র ৩ দিন স্কুলে যেতে পারে। বাকি দুইদিন বা তিনদিন অনলাইনে ক্লাস হতে পারে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে কেবল যাদের পরীক্ষা থাকবে তাদের জন্য হল খুলে অফলাইনে পরীক্ষা নেওয়া যেতে পারে কিন্তু ক্লাসগুলো অনলাইনেই নেওয়া যেতে পারে।
আবাসিক হলগুলোতে ছাত্রছাত্রীরা যেই পরিমাণ গাদাগাদি করে থাকে সেই অবস্থায় খোলাটা আসলেই ঝুঁকিপূর্ণ। কিন্তু ধাপে ধাপে নির্দিষ্ট কোনো বর্ষের জন্য খুলে কেবল পরীক্ষা ও ব্যবহারিক ক্লাসগুলো নেওয়ার ব্যবস্থা করা যেতে পারে।
কিন্তু সরকার আদৌ আমাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সহসা খুলবে বলে মনে হচ্ছে না। কয়েকদিন আগে শিক্ষামন্ত্রী এক সংবাদ সম্মেলনে ১৩ জুনের পর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়ার কথা বলেন। এর একদিন পরেই তিনি এক সভায় বলেন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়ার চেয়ে বন্ধ রাখার ম্যাসেজ বেশি পাচ্ছি। তিনি আরও বলেন, সংক্রমণ ৫ শতাংশের নিচে না নামলে ঝুঁকি নিয়ে স্কুল-কলেজ খোলা হবে না।
দেশে বর্তমানে সংক্রমণের হার হলো ৭ থেকে ৯ শতাংশ। তাহলে সংক্রমণ ৫ শতাংশের নিচেও সহসা নামবে না আর স্কুল কলেজও সহসা খুলছে না। আর বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে বলেছেন, ছাত্র-শিক্ষককে ভ্যাকসিন দিয়েই তবে বিশ্ববিদ্যালয় খোলা হবে। এদিকে সংবাদপত্রের মাধ্যমে জানলাম, জুন-জুলাই থেকে আবার প্রথম ডোজের টিকা শুরু হবে। তাহলে প্রথম ডোজ শেষ হতে হতে ন্যূনতম আগস্ট-সেপ্টেম্বর লেগে যাবে। আর সবকিছু ঠিক থাকলে দ্বিতীয় ডোজ দিতে লাগবে অক্টোবর-ডিসেম্বর। অর্থাৎ দুটো সংবাদ একত্রিত করলে বলা যায়, এই বছর বিশ্ববিদ্যালয় খুলছে না। সব চলে, সব খুলে কেবল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানই খুলে না।
বোঝা যাচ্ছে সরকার নিরাপদ অবস্থানে থাকতে চায়। হল খুললে ঝুঁকি থাকে। বিশেষ করে আমাদের আবাসিক হলগুলোতে ছাত্রছাত্রীরা যেই পরিমাণ গাদাগাদি করে থাকে সেই অবস্থায় খোলাটা আসলেই ঝুঁকিপূর্ণ। কিন্তু ধাপে ধাপে নির্দিষ্ট কোনো বর্ষের জন্য খুলে কেবল পরীক্ষা ও ব্যবহারিক ক্লাসগুলো নেওয়ার ব্যবস্থা করা যেতে পারে। তবে এইসব খুঁটিনাটি আইডিয়াতো আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়কে চিন্তা করে সরকারকে পথ দেখাতে হতো। কিন্তু এই উল্টো দেশে উল্টো জিনিস ঘটে। সরকার বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনকে পথ দেখায়।
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনও ঝুঁকি নিতে চায় না। যেকোনো নতুন আইডিয়া বাস্তবায়ন করতে গেলে কিছুটা ঝুঁকিতো থাকবেই। তাছাড়া প্রশাসনকে অতিরিক্ত কাজ করতে হবে। আমরা হয়তো ওটুকু করতে চাই না। বন্ধ রাখাটা সবচেয়ে ঝুঁকিহীন আরামের কাজ। কিন্তু এতে সারা বাংলাদেশের লক্ষ লক্ষ শিক্ষার্থীরা অপূরণীয় ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে। প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলো যদি পারে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় কেন নয়?
একটি কথা আমাদের মনে রাখতে হবে যে করোনাভাইরাস হয়তো সহসা যাবে না। তাহলে পোস্ট করোনা পরিস্থিতিতে আবাসিক হলের অবস্থা আর আগের মতো থাকতে পারে না। আবাসিক ব্যবস্থাকে উন্নত করার পরিকল্পনা প্রশাসন এবং সরকারকে এখনই ভাবতে হবে। এই বন্ধকালীন সময়ে আবাসিক ব্যবস্থার কোনো পরিবর্তন কি আদৌ আনা হয়েছে?
সামনে বাজেট। এইবারের বাজেটে শিক্ষা এবং স্বাস্থ্য খাতে ন্যূনতম আগের চেয়ে দ্বিগুণ বরাদ্দ অবশ্যই দিতে হবে। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে বিশ্ববিদ্যালয়কেই দায়িত্ব নিতে হবে। শিক্ষা ব্যবস্থাকে চলমান রাখতে কোনো না কোনো সমাধান বের করতেই হবে। মন্ত্রণালয় বা সরকারের দিকে তাকিয়ে না থেকে বরং বিশ্ববিদ্যালয়ের উচিত সরকারকে বিকল্প পথ দেখানো যাতে ছাত্রছাত্রীদের ক্ষতি কমানো যায়। ক্ষতি শূন্য করা সম্ভব না। আমাদের দেখতে হবে আমাদের সাধ্যের মধ্যে কী করলে ক্ষতির পরিমাণ কম হয়।
ড. কামরুল হাসান মামুন ।। অধ্যাপক, পদার্থবিজ্ঞান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়