সমাজের অন্তরালে অনেক ঘটনা ঘটে যায়, যার কারণ উদ্ঘাটন করতে হয়, না হলে অনেককিছু অজানা থেকে যায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তথ্য বিজ্ঞান ও গ্রন্থাগার ব্যবস্থাপনা বিভাগের ২০১৫-২০১৬ সেশনের ছাত্র হাফিজুর রহমানের অস্বাভাবিক অকালমৃত্যু ও পরবর্তী গোয়েন্দা অনুসন্ধান খুলে দিয়েছে এক ভয়ংকর অপরাধ জগতের কাহিনি।

কে এই হাফিজুর রহমান? কেন সে ঈদের পরের দিন বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে আসে? কেন সে অস্বাভাবিক ও ভয়ংকরভাবে ডাব বিক্রেতার দা দিয়ে নিজের গলা কাটে? উপরের ঘটনা অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসে ‘এলএসডি’ বা ‘লাইসার্জিক অ্যাসিড ডাইইথ্যালামাইড’।

এলএসডি কী?

এলএসডি একটি বর্ণহীন, গন্ধহীন গবেষণাগারে প্রস্তুত সেমি সিনথেটিক রাসায়নিক পদার্থ। এটি কিছুটা তিতা স্বাদ যুক্ত। এটি একটি হ্যালুসিনোজেন ড্রাগ ও সাইকোডেলিক মাদক হিসেবে পরিচিত।

১৯৩৮ সালে সুইস গবেষক অ্যালবার্ট হফম্যান প্রথম এলএসডি আবিষ্কার করেন যা মূলত মানসিক রোগের গবেষণায় ব্যবহৃত হতো। ১৯৫০-১৯৬০ সালের দিকে গবেষকরা এলএসডি নিয়ে ব্যাপক গবেষণা করে। ১৯৬০ সালে বিভিন্ন দেশে নেশার উপাদান হিসেবে এর চাহিদা বেড়ে যায়। ১৯৭১ সালে জাতিসংঘ এলএসডিকে নিষিদ্ধ মাদক হিসেবে তালিকাভুক্ত করে।

এলএসডি কীভাবে কাজ করে?

এলএসডি আমাদের ব্রেইনের সেরোটোনিন সিস্টেমকে এলোমেলো করে দেয়। 5HT2 রিসিপটারে পার্সিয়াল এগোনিষ্ট হিসেবে কাজ করে আবেগ ও অনুভূতির অতিশয় ব্যত্যয় ঘটায়।

১৯৩৮ সালে সুইস গবেষক অ্যালবার্ট হফম্যান প্রথম এলএসডি আবিষ্কার করেন যা মূলত মানসিক রোগের গবেষণায় ব্যবহৃত হতো।

কারও কারও ক্ষেত্রে এক বা দুইবার এলএসডি খেলে নিজের সৃজনশীল ক্ষমতা বেড়ে যাওয়া, নতুন মনস্তাত্ত্বিক অন্তর্দৃষ্টি তৈরি হওয়া বা মানসিক দুশ্চিন্তা ও মনোদৈহিক উপসর্গ কমে যায় বলে মনে হয় এবং ব্যক্তিত্বের অনেক পরিবর্তন হয় বলে মনে হয়। তাই এলএসডি খাওয়ার দিকে আগ্রহ বেড়ে যায়।

এলিএসডির শারীরিক ও মনস্তাত্ত্বিক প্রভাব

এলএসডি গ্রহণে শরীরে ধীরে ধীরে আবেগ ও অনুভূতির পরিবর্তন হতে থাকে। এলএসডি গ্রহণের পর ১ ঘণ্টার মধ্যে এর কাজ শুরু হয়, সর্বোচ্চ প্রভাব বা কর্মক্ষমতায় পৌঁছতে ২-৪ ঘণ্টা লাগে এবং ৮-১২ ঘণ্টায় পর্যন্ত প্রভাব থাকে।

এলএসডি গ্রহণকারীর চোখের মণি বড় হয়ে যায়, হার্টবিট বেড়ে যায়, শ্বাস-প্রশ্বাস বেড়ে যায়, হাই প্রেসার দেখা দেয়, শরীরের তাপমাত্রা বেড়ে যায়, ঘামতে থাকে, অনিয়ন্ত্রিত হাঁটা চলা এমনকি হৃদরোগ বা রক্তনালীর জটিলতায় মৃত্যু হতে পারে। এলএসডির প্রভাবে ক্ষুধা কমে যায়, অনিদ্রা দেখা দেয়, শরীর অবসাদ হয়, লালা পড়ে ও মনোযোগ কমে যায়।

আবেগ হঠাৎ করে অস্বাভাবিক হয়ে ওঠে এবং তাৎক্ষণিক পরিবর্তন হয়। দুই ধরনের অসামঞ্জস্যপূর্ণ অনুভূতি একই সাথে হতে পারে। অন্যের কথায় খুব সহজে প্রভাবিত হয়। তীব্র সংবেদনশীলতা ও অন্য থেকে নিজেকে বিচ্ছেদ বা পৃথক মনে করে।

এলএসডির প্রভাবে ক্ষুধা কমে যায়, অনিদ্রা দেখা দেয়, শরীর অবসাদ হয়, লালা পড়ে ও মনোযোগ কমে যায়।

দীর্ঘ সময় এলএসডি নিলে অনেক মানসিক রোগ দেখা দেয়। আত্মহত্যার প্রবণতা বা আত্মহত্যা করা, তীব্র বিষণ্নতা, উদ্বিগ্নতা, প্যানিক অ্যাটাক, অ্যাগারো ফোবিয়া, সাইকোসিস ইত্যাদি মানসিক রোগে ভুগতে থাকে।

হাফিজুর রহমানের মৃত্যু ও কিছু প্রশ্ন

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হাফিজুরের অস্বাভাবিক অপমৃত্যু নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলাম। একই সাথে শঙ্কিত ও চিন্তিত হই এলএসডির মতো হ্যালুসিনোজেন মাদকদ্রব্য সুদূর নেদারল্যান্ড থেকে বাংলাদেশে ট্রাফিকিং করার খবর যা কোনো সংঘবদ্ধ গ্রুপের কাজ। ঈদের পরের দিন ১৫ মে ২০২১ হাফিজুর রহমান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে কেন আসে? কেন সে রিকশাওয়ালাকে মারধর করে? কেন অনেক রিকশাওয়ালার পা ধরে মাফ চায়? কেন ডাব বিক্রেতার দা দিয়ে নিজের গলায় কোপ দেয়? কেন পুলিশ ঢাকা মেডিকেলের ইমার্জেন্সিতে নেওয়ার পথে সে রিকশা থেকে লাফ দেয়? এই প্রশ্নগুলোর উত্তর অজানা ছিল। হাফিজুরের পূর্বে কোনো মানসিক রোগের ইতিহাস এখনো জানা যায়নি।

পুলিশের ভাষ্যমতে, ওই শিক্ষার্থী বন্ধুদের সাথে এলএসডি সেবন করে একজন ডাব বিক্রেতার দা নিয়ে নিজেই নিজের গলায় আঘাত করেন। মাদকের প্রতি নেশা করোনা মহামারিতে অনেক বেড়ে গেছে। সুস্থ বিনোদনের অভাব, দৈনন্দিন একাডেমিক শিডিউল বিপর্যয়, লকডাউনে কর্মহীনতা, অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ, অর্থনৈতিক টানাপোড়ন, পারিবারিক কলহ, স্বাভাবিক সামাজিক যোগাযোগের ব্যত্যয়, নেশার সহজলভ্যতা, নৈতিক শিক্ষার অভাব, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ফাঁকফোকর, নেশা দ্রবের ট্রাফিকিং পথ সম্পূর্ণ নির্মূলে ব্যর্থতা এবং আইনের চোরাগলি দিয়ে জামিনে অপরাধী বেরিয়ে আসা।

হাফিজুর রহমানের মতো অমিত সম্ভাবনাময় প্রাণ অকালে ঝরে পড়ল কিন্তু খুলে দিয়ে গেল সমাজের এক ভয়ংকর অন্ধকার বিপদজনক পথ যা আমাদের তরুণ সমাজকে ধ্বংস করে দিতে পারে নিমেষে। তাই আসুন সবাই সচেতন হই, হাত বাড়াই মাদকমুক্ত সমাজ গঠনে।

ডা. মো. রশিদুল হক ।। সহকারী অধ্যাপক, স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ