করোনাভাইরাস আসলেই গোটা পৃথিবীকে বদলে দিয়েছে। একসময় শিক্ষার্থীরা ছুটির জন্য অপেক্ষা করত। আর এখন স্কুল খোলার দাবিতে আন্দোলন হচ্ছে। কারণ বাসায় বাবা-মা’র কঠোর অনুশাসনের চেয়ে শিক্ষকদের শাসন এখন তাদের কাছে মধুর লাগছে।

বাংলাদেশে করোনা সংক্রমণ শুরুর পর ২০২০ সালের ১৭ মার্চ থেকে দেশের সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ রয়েছে। এই সময়ে করোনার প্রথম ঢেউ গেছে, দ্বিতীয় ঢেউও কিছুটা স্তিমিত হয়ে এসেছে। এই সময়ে করোনার সংক্রমণ ঠেকাতে দেশে সাধারণ ছুটি, লকডাউন, কঠোর লকডাউন নানা কিছু হয়েছে। একবার খোলা, একবার বন্ধ—এইভাবে চলেছে সবকিছু। কিন্তু একাধিকবার উদ্যোগ নিয়েও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলার ঝুঁকি নিতে পারেনি সরকার।

বারবার শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলার নানা পরিকল্পনা করা হয়েছে। কিন্তু করোনার বিস্তার সব পরিকল্পনা ভণ্ডুল করে দিয়েছে। কথায় বলে না, ম্যান প্রপোজেস, গড ডিসপোজেস। এই সময়ে করোনা প্রায় সাড়ে ১২ হাজার মানুষের জীবন নিয়েছে। তাই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলে শিক্ষার্থীদের করোনার ঝুঁকিতে ফেলার সাহস করতে পারেনি সরকার। কিন্তু করোনার ভয়ে অনন্তকাল তো আর শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখা সম্ভব নয়। তাই সরকার পরিস্থিতি অনুকূল থাকলে আগামী ১৩ জুন থেকে স্কুল-কলেজ খোলার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তবে বিশ্ববিদ্যালয় খুলবে শিক্ষক ও আবাসিক শিক্ষার্থীদের টিকা দেওয়ার পর। তবে টিকার এখন যে সঙ্কট, তাতে সেটা কবে নাগাদ সম্ভব হবে তা একদমই অনিশ্চিত।

করোনা সংক্রমণ ঠেকাতে দেশে সাধারণ ছুটি, লকডাউন, কঠোর লকডাউন নানা কিছু হয়েছে। একবার খোলা, একবার বন্ধ—এইভাবে চলেছে সবকিছু। কিন্তু একাধিকবার উদ্যোগ নিয়েও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলার ঝুঁকি নিতে পারেনি সরকার।

প্রায় দেড় বছর শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় দেশের প্রায় চার কোটি শিক্ষার্থীর শিক্ষা জীবন এলোমেলো হয়ে গেছে। গতবছর এইচএসসির অটো পাস নিয়ে সমালোচনা-জটিলতা কম হয়নি। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকার সময়ে অনলাইনে ক্লাস নিয়ে নানাভাবে ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়ার চেষ্টা হয়েছে বটে, তবে দুধের স্বাদ যেমন ঘোলে মেটে না, তেমনি ক্লাসরুমের শিক্ষা অনলাইনে হয় না।

করোনা সংক্রমণ ঠেকাতে দেশে সাধারণ ছুটি, লকডাউন, কঠোর লকডাউন নানা কিছু হয়েছে। একবার খোলা, একবার বন্ধ—এইভাবে চলেছে সবকিছু। কিন্তু একাধিকবার উদ্যোগ নিয়েও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলার ঝুঁকি নিতে পারেনি সরকার।

শুধু শিক্ষা জীবন এলোমেলো হয়ে যাওয়াই নয়, শিক্ষার্থীদের মধ্যে হতাশা বেড়েছে, ঘরে ঘরে অশান্তি বেড়েছে। অনলাইন ক্লাসের সুবাদে বাধ্য হয়ে অভিভাবকরা সন্তানের হাতে স্মার্ট ডিভাইস তুলে দিয়েছেন। আর অল্প একটু ক্লাস করার সাথে অনেক বেশি গেম খেলায় অভ্যস্ত হয়ে গেছে শিশুরা। শিশুরা রাতভর কম্পিউটারে বা মোবাইলে সময় কাটায়, দিনভর ঘুমায়। এ নিয়ে ঘরে ঘরে অশান্তি। আমার ঘরেও একজন এইচএসসি পরীক্ষার্থী আছে। তার সাথে তার মায়ের খিটমিট দেখে বুঝি ঘরে ঘরে কী চলছে।

তবে গেম খেলাটা শহুরে মধ্যবিত্তের সমস্যা। গ্রামের শিক্ষার্থীদের তো স্মার্ট ফোন নেই, হাইস্পিড ইন্টারনেট নেই। তাই তাদের স্মার্ট ডিভাইসে আসক্ত হওয়ারও সুযোগ নেই। বরং গ্রামের শিক্ষার্থীরা সংসারের কাজে লেগে পড়ে। করোনার থাবায় শিক্ষা খাতের সবচেয়ে বেশি ক্ষতির আশঙ্কা হলো ঝরে পড়া। এরই মধ্যে গ্রামে বাল্যবিয়ে বেড়ে গেছে আশঙ্কাজনক হারে। ছেলে শিশুদের যারা একবার সংসারে কাজে লেগে গেছে, তাদের হয়তো আর কখনোই ক্লাসরুমে ফেরা হবে না।

বাংলাদেশের অন্য সব খাতের মতো শিক্ষা খাতেও পদে পদে বৈষম্য। নানামুখী শিক্ষাব্যবস্থা তো আছেই, আছে গ্রাম এবং শহরে পাঠদানে আকাশ-পাতাল ফারাক। শহরের স্কুল-গ্রামের স্কুল, সরকারি স্কুল-বেসরকারি স্কুল, ইংলিশ মিডিয়াম-বাংলা মিডিয়াম, ভালো শিক্ষক-মন্দ শিক্ষক বৈষম্যের কোনো শেষ নেই। কোচিং, টিউটর তো আছেই।

করোনার সময় অনলাইন ক্লাসে এই বৈষম্য আরও প্রকট হয়েছে। একটি জরিপে দেখা গেছে, ৬৯ ভাগ শিক্ষার্থী অনলাইন কার্যক্রমে অংশ নিতে পারেনি। কারণ দেশের সব জায়গায় হাইস্পিড ইন্টারনেট নেই, অনেকের স্মার্ট ডিভাইস ছিল না। তাই অনলাইনে ক্লাস একটা চেষ্টা হতে পারে, তবে তা সর্বজনীন ছিল না। এখন পরীক্ষায় বসলে এই বৈষম্য কীভাবে ঘুচবে?

জরিপে দেখা গেছে, ৬৯ ভাগ শিক্ষার্থী অনলাইন কার্যক্রমে অংশ নিতে পারেনি। কারণ দেশের সব জায়গায় হাইস্পিড ইন্টারনেট নেই, অনেকের স্মার্ট ডিভাইস ছিল না।

অবশ্য সরকারের সিদ্ধান্ত হলো, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলার পর ৬০ দিন ক্লাস করিয়ে এসএসসি এবং ৮৪ দিন ক্লাস করিয়ে এইচএসসি পরীক্ষা নেওয়া। আর পরীক্ষা হবে সংক্ষিপ্ত সিলেবাসে। যত যাই হোক, ক্লাসরুমের শিক্ষার অভাবটা কখনোই পূরণ হবে না। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান তো শুধু শিক্ষার্থীদের পড়াশোনা শেখায় না, জীবন শেখায়। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান তো শুধু ক্লাসরুমে নির্দিষ্ট কিছু বই মুখস্থ করানো নয়।

স্কুল হলো আসলে শিক্ষার্থীদের গড়ে তোলার প্রতিষ্ঠান। স্কুলে তারা একাডেমিক শিক্ষা যেমন পাবে, পাবে জীবনের শিক্ষাও। সামাজিকতা, নেতৃত্ব, নৈতিকতা, বন্ধুত্ব—স্কুলে এমন সব গুণের বিকাশ ঘটে। বাসায় বসে কেউ সব বই মুখস্থ করে ফেললে পরীক্ষায় হয়তো অনেক নম্বর পাবে, কিন্তু জীবনের পরীক্ষায় পাস করা মুশকিল হবে।

জরিপে দেখা গেছে, ৬৯ ভাগ শিক্ষার্থী অনলাইন কার্যক্রমে অংশ নিতে পারেনি। কারণ দেশের সব জায়গায় হাইস্পিড ইন্টারনেট নেই, অনেকের স্মার্ট ডিভাইস ছিল না।

আমাদের একমাত্র ছেলে প্রসূন, সেন্ট যোসেফ কলেজ থেকে এবার এইচএসসি পরীক্ষা দেওয়ার জন্য অপেক্ষা করছে। কলেজে ওঠার পর সে অল্প কিছুদিন ক্লাস করার সুযোগ পেয়েছে। কিন্তু আমি নিজের জীবন থেকে দেখেছি, কলেজ জীবন একজন মানুষের কত মধুর স্মৃতি, কত বড় শিক্ষা।

বর্তমান প্রজন্মের কলেজের তেমন কোনো স্মৃতিই থাকবে না। জীবনের একটা বড় অংশ এভাবে হারিয়ে যাওয়া বড় বেদনার। করোনার সব ক্ষতিই হয়তো কোনো না কোনোভাবে পূরণ করা যাবে। কিন্তু করোনা শিক্ষায় যে প্রভাব ফেলেছে, তা সত্যিই অপূরণীয়।

তবে স্কুল খুললেই সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে এমন নয়। বরং শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলার পর থেকে শুরু হবে শিক্ষার ক্ষতি পোষানোর নতুন চ্যালেঞ্জ। স্কুল বন্ধ থাকায় শুধু যে শিক্ষার্থীদের পড়াশোনার গতি নষ্ট হয়েছে, তাই নয়; এই সময়ে অনেকের মনোযোগ নষ্ট হয়ে গেছে, জীবনের লক্ষ্য বদলে গেছে। তাই শিক্ষাকে আবার গতিতে ফিরিয়ে আনা সত্যি কঠিন। কঠিন হলেও সেই চেষ্টাটা আমাদের করতে হবে। প্রত্যেক শিক্ষার্থীকে ক্লাসরুমে ফিরিয়ে আনতেই হবে। শিক্ষার্থীরা ফিরলেই প্রাণ ফিরে পাবে ক্লাসরুম। আমরাও চাই, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো আবার মুখরিত হোক আমাদের সন্তানদের কলকাকলিতে। কিন্তু আমিও জানি, সন্তানের স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে ফেলে তাকে কেউই স্কুলে পাঠাতে চাইবেন না। তাই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলার আগে করোনার ঝুঁকিটা যাচাই করতে হবে। আপাতত এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষার্থীরা সপ্তাহে ছয়দিন ক্লাস করবে। বাকিরা সপ্তাহে একদিন ক্লাস করবে। তবে সবচেয়ে বড় কথা হলো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে স্বাস্থ্যবিধি নিশ্চিত করতে হবে। ক্লাসরুম নতুন করে সাজাতে হবে, যাতে সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিত করা যায়।

শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলার জন্য আরও দুই সপ্তাহ সময় আছে। এই সময়ের মধ্যেই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো ঢেলে সাজাতে হবে। পুরো ক্যাম্পাস জীবাণুমক্ত কি না তা নিশ্চিত করতে হবে। স্কুলে গিয়ে যেন কেউ করোনা নিয়ে না আসে।

প্রভাষ আমিন ।। বার্তা প্রধান, এটিএন নিউজ
probhash2000@gmail.com