নজরুলের অসাম্প্রদায়িক চেতনা
প্রথম বিশ্বযুদ্ধোত্তর সময়ে পৃথিবীব্যাপী হতাশা, অর্থনৈতিক বিপর্যয় এবং মূল্যবোধের অবক্ষয়ের প্রতিবেশে বাংলা সাহিত্যে কাজী নজরুল ইসলামের উজ্জ্বল আবির্ভাব। নবজাগ্রত বাঙালি মুসলিম মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানস-মৃত্তিকায় নজরুলের চেতনার শিকড় প্রোথিত ছিল। নজরুলের কবি চৈতন্যে রাজনীতি সচেতনতা ও জনমূল-সংলগ্নতা এনেছিল নতুন মাত্রা।
ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির প্রতিষ্ঠা, সোভিয়েত ইউনিয়নের সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব, স্বাধীনতা আন্দোলন এবং নবজাগ্রত মুসলিম মধ্যবিত্তের স্বপ্ন-সম্ভাবনা নজরুলের কবি মানসকে করে তুলেছিল আলোক-উদ্ভাসিত। পরম আশাবাদী নজরুল স্বদেশের মুক্তি প্রত্যাশা করেছেন; ঔপনিবেশিক শক্তির বিরুদ্ধে সমগ্র জনগোষ্ঠীকে জাগ্রত হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন।
বিজ্ঞাপন
উপনিবেশ আঁকড়ে রাখার মানসে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ সুচতুর কৌশলে সাম্প্রদায়িক বিভেদ সৃষ্টি করেছিল ভারতবর্ষে; ভারতের দুই বৃহৎ ধর্ম-সম্প্রদায় পরস্পর বিভেদে জড়িয়ে পড়েছে বারংবার। এর পশ্চাতে ছিল কতিপয় রাজনৈতিক দলের ইন্ধন।
মানুষের হৃদয়ের চেয়ে বড় কোনো মন্দির-কাবা নেই, এইটা কাজী নজরুল ইসলাম মনে প্রাণে বিশ্বাস করতেন। তাই তিনি মানুষকেই নিবেদন করেন তার সকল শ্রদ্ধা, ভক্তি ও ভালোবাসা। মানুষকেই তিনি সর্বদেশ, সর্বযুগ, সর্বকালের পরম জ্ঞাতি হিসেবে জেনেছেন এবং মেনেছেন।
এই সাম্প্রদায়িক বিভেদ নজরুলকে ব্যথিত করেছে। তাই তিনি সচেতনভাবে হিন্দু-মুসলিমের মধ্যে সম্প্রদায়-নিরপেক্ষ সম্প্রীতি প্রত্যাশা করেছেন।
সত্য-সুন্দর-কল্যাণের পূজারি নজরুল চেয়েছেন সম্প্রদায়ের ঊর্ধ্বে মানুষের মুক্তি।
আরও পড়ুন : নজরুল-পাঠের সনাতন ধারা ও সীমাবদ্ধতার দুটি দিক
বস্তুত, সাম্যবাদী চিন্তা তার মানসলোকে সম্প্রদায়-নিরপেক্ষ মানবসত্তার জন্ম দিয়েছে—হিন্দু ও মুসলিম বৈপরীত্যের দ্যোতক না হয়ে তার চেতনায় হতে পেরেছে জাতিসত্তার দুই পরিপূরক শক্তি। তাই আন্তধর্মীয় সম্প্রীতিকামী সাম্যবাদী নজরুল বলেন,
‘কাটায়ে উঠেছি ধর্ম-আফিম-নেশা
ধ্বংস করেছি ধর্ম-যাজকী পেশা
ভাঙি মন্দির, ভাঙি মসজিদ
ভাঙিয়া গির্জা গাহি সঙ্গীত,
এক মানবের একই রক্ত মেশা
কে শুনিবে আর ভজনালয়ের হ্রেষা।’
— (‘বিংশ শতাব্দী’ / ‘প্রলয়-শিখা’)
বস্তুত, মানুষকে, মানুষের ধর্মকে নজরুল বড় করে দেখেছেন আজীবন। তাই হিন্দু কিংবা মুসলমান নয়, বিদ্রোহের জন্য মানুষের প্রতিই ছিল তার উদাত্ত আহ্বান। তিনি কল্পনা করেছেন এক সাম্যবাদী সমাজের, যেখানে নেই শোষণ, বৈষম্য আর সাম্প্রদায়িক বিভেদ। তিনি লিখেছেন,
‘গাহি সাম্যের গান-
যেখানে আসিয়া এক হয়ে গেছে সব বাধা-ব্যবধান,
যেখানে মিশেছে হিন্দু-বৌদ্ধ-মুসলিম-ক্রীশ্চান।’
— (‘সাম্যবাদী’)
আরও পড়ুন : নজরুলের বিদ্রোহী সত্তার পটভূমি
মানুষের প্রতি অপরিসীম ভালোবাসা আর বিশ্বাস ছিল বলেই চরম সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার মুখেও নজরুল অবলীলায় শ্যামাসংগীত আর বৃন্দাবন গীত রচনা করেছেন, লিখেছেন গজল, ব্যাখ্যা করেছে তৌহিদের একেশ্বর তত্ত্ব। দাঙ্গার পটভূমিতে তিনি লিখেছেন, ঐতিহাসিক কবিতা ‘কাণ্ডারী হুঁশিয়ার’, উচ্চারণ করেছেন অসামান্য এই চরণগুচ্ছ,
‘হিন্দু না ওরা মুসলিম?’ ওই জিজ্ঞাসে কোনজন?
কান্ডারী! বল ডুবিছে মানুষ, সন্তান মোর মার।
— (‘কাণ্ডারী হুঁশিয়ার’ / ‘সর্বহারা’)
তিনি জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে অসাম্প্রদায়িক চেতনায় সকল মানুষের কল্যাণ কামনা করেছেন। নজরুলকে অনেক সময়েই খণ্ডিতভাবে মূল্যায়ন করা হয়। তাকে গ্রহণ করতে হবে সমগ্র দৃষ্টিকোণে। মনে রাখতে হবে, তিনি যেমন হামদ-নাত-গজল লিখেছেন—তেমনি লিখেছেন কীর্তন ও শ্যামাসংগীত। কোনো কোনো ক্ষেত্রে কালী-কীর্তন ও নাত রচনায় তিনি নির্মাণ করেছেন প্রায়-সমার্থক চিত্রকল্প।
বিভিন্ন ধর্ম-সম্প্রদায়ের মধ্যে সম্প্রীতি কামনার জন্যই তিনি কবিতায়-গানে একই সঙ্গে আল্লাহ-ঈশ্বর, মসজিদ-মন্দির-গির্জা, মোহাম্মদ-কৃষ্ণ-খালেদ-অর্জুন, কোরান-বেদ-বাইবেল-ত্রিপিটক প্রভৃতি অনুষঙ্গ ব্যবহার করেছেন।
নজরুলের অসাম্প্রদায়িক চেতনা প্রথম থেকেই কায়েমি স্বার্থবাদী মহল সহ্য করতে পারেনি। হিন্দু-মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের স্বার্থান্বেষী চক্র তার বিরুদ্ধে অপপ্রচার করেছে, তার সাহিত্যে পেয়েছে সংকীর্ণতার গন্ধ।
মুসলিমরা ক্ষেপেছেন নজরুলের কবিতা ও গানে ভারতীয় দেব-দেবীর নাম দেখে; আর হিন্দুরা ক্ষেপেছেন, যখন দেখেছেন নজরুলের কবিতায় পশ্চিম এশিয়ার ঐতিহ্য জায়গা পেয়েছে, আর যখন তিনি ভগবানের বুকে পদচিহ্ন এঁকে দিয়েছেন, তখন।
আরও পড়ুন : শতাব্দীর পশ্চাতে নজরুল অবলোকন
বস্তুত, বিভিন্ন ধর্ম-সম্প্রদায়ের মধ্যে সম্প্রীতি কামনার জন্যই তিনি কবিতায়-গানে একই সঙ্গে আল্লাহ-ঈশ্বর, মসজিদ-মন্দির-গির্জা, মোহাম্মদ-কৃষ্ণ-খালেদ-অর্জুন, কোরান-বেদ-বাইবেল-ত্রিপিটক প্রভৃতি অনুষঙ্গ ব্যবহার করেছেন।
নজরুল ধর্মের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেননি, বিদ্রোহ করেছেন ধর্ম-ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধে। একালে যেমন, সেকালেও তেমনি, ধর্মকে শোষণের অন্যতম হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। তাই ভণ্ড মোল্লা-মৌলভি আর পুরোহিত-পাদ্রির বিরুদ্ধে সংগ্রামে তিনি ছিলেন সোচ্চার।
মানবাত্মার মুক্তি সাধনাই নজরুলের সাহিত্যকর্মের কেন্দ্রীয় অন্বিষ্ট। মানুষের সামূহিক অবচেতনায় তিনি জ্বেলে দিতে চেয়েছেন মানবিকতার আলো। ধর্মীয় কুসংস্কারকে তিনি অতিক্রম করেছেন মানবিকতার শক্তি দিয়ে—তার কাছে ধর্মের জন্য মানুষ নয়, বরং মানুষের জন্যই ধর্ম।
প্রাতিস্বিক মানব বন্দনার পশ্চাতে নজরুলের সৃষ্টিশীল ঐতিহ্য চেতনা ছিল সদা-সক্রিয়। উত্তরাধিকারের ব্যাপকতা সম্পর্কে সচেতন নজরুল পশ্চিম-এশীয় ইতিহাস এবং ভারতীয় ঐতিহ্য শক্তির উৎস সঞ্চান করেছেন তার বিদ্রোহকে বাস্তবরূপ দেওয়ার প্রত্যাশায়।
আরও পড়ুন : বিতর্কিত রবীন্দ্রনাথ?
তার এই শক্তি-সঞ্চয় মূলত ধর্ম-ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধে সংগ্রাম করার জন্য, সাম্প্রদায়িক শক্তিকে আঘাত করার জন্য এবং ঔপনিবেশিক শক্তির ভিতকে কাঁপিয়ে দেওয়ার জন্য। তাই নটরাজ শিব আর অসুরনাশিনী দুর্গার শক্তি, কিংবা মহররমের আত্মত্যাগ আর মরু ভাস্কর মুহাম্মদের বিদ্রোহ তার কবি আত্মাকে উদ্দীপ্ত করে মানুষের মুক্তি কামনায়।
সাম্প্রদায়িক বিভেদের বিরুদ্ধে জন্ম-বিদ্রোহী নজরুল সংগ্রাম করেছেন একক শক্তিতে এবং তিনি বিশ্বাস করতেন—শ্রমিকরাজ প্রতিষ্ঠিত হলেই দূর হয়ে যাবে সব অপশক্তি।
কাজী নজরুল ইসলাম অসাম্প্রদায়িক মানবিক বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখেছেন। তার কালে যেমন, তেমনি একালেও নানা সাম্প্রদায়িক শক্তি প্রগতির চাকাকে পেছন দিকে নিতে চায়। এই অপশক্তির বিরুদ্ধে সকলকে সম্মিলিতভাবে এগিয়ে আসতে আত্মার আহ্বান জানিয়েছেন তিনি। একটি অসাম্প্রদায়িক মানবিক বাংলাদেশ গঠনে নজরুল হয়ে উঠতে পারেন আমাদের অন্যতম শক্তির উৎস—এবং সে সূত্রেই তিনি আমাদের কাছে অব্যাহতভাবে প্রাসঙ্গিক।
অধ্যাপক ড. বিশ্বজিৎ ঘোষ ।। উপাচার্য, রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ