নিরাপদ ভ্রমণ মানেই বিমান ভ্রমণ
ভ্রমণ পিপাসুদের আস্থার জায়গা হলো বিমানে ভ্রমণ। মাঝে মাঝে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে বিমান দুর্ঘটনার খবর শিরোনাম হয়ে আসে। তখন ব্যথিত হই। চিন্তার ভাঁজ কপালে ফুটে ওঠে। সারা বিশ্বে প্রতিদিন প্রায় লক্ষাধিক বাণিজ্যিক ফ্লাইট, কার্গো ফ্লাইট, বিভিন্ন সামরিক বাহিনীর আন্তসংযোগ ফ্লাইট, ব্যক্তিগত ফ্লাইট, ট্রেনিং ফ্লাইট, হেলিকপ্টারসহ নানা রকম ফ্লাইট পরিচালিত হয়।
পৃথিবীর প্রায় দুই তৃতীয়াংশ এয়ারক্রাফট সবসময়ই আকাশে থাকে। বিপরীত চিত্রও দেখতে পেয়েছি, মহামারি করোনায় শতভাগ এয়ারক্রাফটও গ্রাউন্ডে দেখেছি, যেমন এভিয়েশন শিল্পের জন্য অস্বাভাবিক চিত্র তেমন বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষের জন্যও একই অবস্থা। কোনো দেশের বিমানবন্দরই শতভাগ এয়ারক্রাফটের জন্য অবকাঠামো তৈরি করেনি।
বিজ্ঞাপন
বিমান ভ্রমণ যে নিরাপদ তা কোনো মনগড়া বক্তব্য নয়, বিমান চলাচল শুরু হওয়ার পর থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত নানা তথ্য উপাত্তের উপর ভিত্তি করেই বলার সুযোগ আছে। গত দশ বছরে গড়ে প্রতি ১০ লক্ষ ফ্লাইট পরিচালনা করার পর ১.৭১ ফ্লাইট দুর্ঘটনায় পতিত হয়েছিল। যা যেকোনো পরিবহনের তুলনায় অনেক বেশি নিরাপদ।
সর্বশেষ ৭০ বছরের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, বিশ্বে বাণিজ্যিক ফ্লাইট পরিচালনা শুরু হওয়ার পর ২০১৭ সালে একটিও বাণিজ্যিক ফ্লাইট দুর্ঘটনায় পতিত হয়নি। ২০১৭ সাল বিমান পরিবহনের ইতিহাসে সবচেয়ে নিরাপদ বছর হিসেবে স্বীকৃত। ২০১০ সালের পর সারা বিশ্বে ৯৪টি বিভিন্ন এয়ারলাইন্স ১০৯টি দুর্ঘটনায় পতিত হয় এবং ৩,৯৩০ জন যাত্রী ও ক্রুদের জীবনহানি ঘটে।
২০১৪ সালে ২২টি দুর্ঘটনায় ৯৯২ জন যাত্রী ও ক্রু নিহত হন। পরিসংখ্যান অনুযায়ী গত দশ বছরে ১০টি এয়ারলাইন্সের ১৩টি দুর্ঘটনা ও একটি নিরুদ্দেশ হওয়ার পর মোট ২০৮০ জন যাত্রী ও ক্রুকে চির বিদায় জানাতে হয়। এর মধ্যে একক দেশ হিসেবে নেপালে সর্বোচ্চ ৯টি দুর্ঘটনায় ১৪৭ জন নিহত হন।
সর্বশেষ ৭০ বছরের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, ২০১৭ সাল বিমান পরিবহনের ইতিহাসে সবচেয়ে নিরাপদ বছর হিসেবে স্বীকৃত।
২০১৭ সালের পর ২০১৮ সালকেও এভিয়েশনে একটি নিরাপদ বছর হিসেবে গণ্য করা হয়। যদিও পূর্ববর্তী বছরের তুলনায় দুর্ঘটনার সংখ্যা বৃদ্ধি পায়। সারাবছর সারা বিশ্বে মাত্র ১৫টি ছোট-বড় বিমান দুর্ঘটনা সংগঠিত হয় এবং ৫৫৬ জন নিহত হন। তেমনিভাবে ৭৪ বছরের ইতিহাসে ২০১৯ সালকেও এভিয়েশনে নিরাপদ বছর হিসেবে মনে করা হয়। এ বছর মাত্র ২০টি দুর্ঘটনায় ২৮০ জন নিহত হন।
২০২০ সাল দুর্যোগপূর্ণ মহামারি করোনার কবলে নিষ্পেষিত সারা বিশ্বের এভিয়েশন ইন্ডাস্ট্রি। করোনার কারণে অনেকটা লকডাউন অবস্থায় ৪০টির মতো দুর্ঘটনা সংগঠিত হয়। এর মধ্যে বড় আকারের ৫টি দুর্ঘটনা ঘটে এবং এসব দুর্ঘটনায় ২৯৯ জন হতাহত হন। চলতি বছর মে মাস পর্যন্ত তিনটি দুর্ঘটনা ঘটে। যার সর্বশেষ দুর্ঘটনায় নাইজেরিয়ার সেনাবাহিনী প্রধানসহ ১০জন নিহত হন।
গত দশ বছরে এশিয়ান এয়ারলাইন্স এবং মারপাতি নুসানতারা এয়ারলাইন্স দুটি সর্বোচ্চ সংখ্যক তিনটি করে দুর্ঘটনায় পতিত হয়ে মোট ছয়টি দুর্ঘটনায় মোট ৩০ জন নিহত হন।
গত এক দশকে ২০১৪ সালে আমস্টারডাম থেকে কুয়ালালামপুরে মালয়েশিয়া এয়ারলাইন্স এর একটি বাণিজ্যিক ফ্লাইট ৪০ হাজার ফুট উপরে ইউক্রেন-রাশিয়া সীমানার আকাশসীমায় ভূমি থেকে ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করে ভূপাতিত করে, ফলে ২৮৩ জন যাত্রী ও ১৫ জন ক্রু নিহত হন। যা অত্যন্ত দুঃখজনক। একটি যাত্রীবাহী বাণিজ্যিক ফ্লাইটকে কেন ভূপাতিত করা হলো এর সঠিক কারণ এখনো উদঘাটিত হয়নি। একই বছর কুয়ালালামপুর থেকে বেইজিং এ যাওয়ার সময় মালয়েশিয়া এয়ারলাইন্স এর এমএইচ ৩৭০ এয়ারক্রাফটটি ২৩৯ জন যাত্রী ও ক্রু নিয়ে নিরুদ্দেশ হয়। যা আজও বিশ্ব এভিয়েশনের কাছে অনেকটা ধাঁধার মতো। এর কোনো হদিস এখনো মেলেনি।
১৯৭০ সালের পর ২০১৯ সাল পর্যন্ত প্রতি এক মিলিয়ন ফ্লাইটে ১২ গুণ দুর্ঘটনা হ্রাস পায়। গাণিতিক হিসেবে প্রতি মিলিয়নে ৬.৩৫ থেকে ০.৫১ -এ নেমে আসে। আবার হতাহতের সংখ্যা বিচারে ৮১ গুণ হ্রাস পায়। যা ১৯৭০ সালের প্রতি ট্রিলিয়নে ৩২১৮ থেকে নেমে ৪০ নেমে আসে। দুর্ঘটনা ও হতাহতের সংখ্যা বিচারে বর্তমানে বিমান পরিবহন যেকোনো সময়ের তুলনায় অনেক বেশি নিরাপদ।
১৯৭০ সালের পর ২০১৯ সাল পর্যন্ত প্রতি এক মিলিয়ন ফ্লাইটে ১২ গুণ দুর্ঘটনা হ্রাস পায়। গাণিতিক হিসেবে প্রতি মিলিয়নে ৬.৩৫ থেকে ০.৫১ -এ নেমে আসে।
গত ৭০ বছরে পৃথিবীর একমাত্র এয়ারলাইন্স কানতাস এর এক্সিডেন্টাল রেকর্ড শূন্যের কোঠায়। যা নিরাপদ এয়ারলাইন্স হিসেবে পথপ্রদর্শকের ভূমিকা পালন করছে। এয়ারলাইন্স রেটিংস ডট কম এর জরিপে ৩৮৫টি এয়ারলাইন্স এর মধ্যে কানতাস এয়ারলাইন্স নিরাপদ এয়ারলাইন্স হিসেবে উচ্চ শিখরে অবস্থান করছে। বিশ্বের নিরাপদ এয়ারলাইন্স এর তালিকায় আছে কাতার এয়ারওয়েজ, এমিরেটস, ব্রিটিশ এয়ারওয়েজসহ বিখ্যাত সব এয়ারলাইন্সগুলো।
বাংলাদেশের আকাশপথ ও আকাশ পরিবহনও অনেক বেশি নিরাপদ। স্বাধীনতার পর গত ৫০ বছরের ইতিহাসে ছোট বড় কয়েকটি দুর্ঘটনা ঘটলেও বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স ও ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্স যথাক্রমে ১৯৮৪ সালে ঢাকায় ও ২০১৮ সালে কাঠমান্ডুতে দুর্ঘটনায় পতিত হয়।
২০১৮ সালের সেপ্টেম্বর মাসে চট্টগ্রামের হযরত শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে পাইলটের সচেতনতায় ইউএস-বাংলার এয়ারক্রাফটকে বড় ধরনের দুর্ঘটনার হাত থেকে রক্ষা করে শতাধিক যাত্রীদের জীবন বাঁচিয়ে বীরত্বও দেখিয়েছেন। ১৭ই ফেব্রুয়ারি ২০১৪, ইথিওপিয়ান এয়ারলাইন্সের একটি যাত্রীবাহী বিমান কো-পাইলট কর্তৃক অপহৃত হয়। বিমানটি আদ্দিস আবাবা থেকে ইতালির মালপেনসাতে যাচ্ছিল। বিমানটিতে ১৯৩ জন যাত্রী ও ৯ জন ক্রু ছিলেন। বিমানটিকে কো-পাইলট জেনাভাতে জোরপূর্বক অবতরণ করতে বাধ্য করে। অনেক নাটকীয়তার পর সকল যাত্রী ও ক্রুরা নিরাপদে মুক্ত হন।
আবার সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশ বিমানের একটি আন্তর্জাতিক ফ্লাইটও অবরুদ্ধ হওয়ার ঘটনা ঘটেছিল। এ ধরনের কিছু ঘটনা এভিয়েশনে বিচ্ছিন্ন ঘটনা হিসেবেই দেখা হয়। ১১ আগস্ট ২০১৪, কলকাতার মধ্য আকাশে জামশেদপুর জেলায় ভূমি থেকে ৩২০০০ ফুট উচ্চতায় পাইলটের সচেতনতা ও দক্ষতার কারণে ইউনাইটেড এয়ারওয়েজ (বিডি) লিমিটেড ও সৌদি এয়ারলাইন্স এর বিমান মুখোমুখি সংঘর্ষ পরিহার করা সম্ভব হয়। যাতে বেঁচে যান কয়েক শত যাত্রী।
সাম্প্রতিক সময়ে বিচ্ছিন্ন কিছু ঘটনা আর ধারাবাহিকভাবে বিমান পরিবহনে দুর্ঘটনা হ্রাস পাওয়ায় হতাহতের সংখ্যা কমায় বিমান পরিবহন বর্তমানে যেকোনো সময়ের তুলনায় নিরাপদ ভ্রমণ হিসেবে পরিগণিত হচ্ছে। বাস্তবতার নিরিখে সারাবিশ্বের এভিয়েশন যাত্রীদের নিরাপদ ভ্রমণে প্রতিনিয়ত কাজ করে যাচ্ছে।
পরিশেষে তথ্য উপাত্ত বিবেচনায় বলা যায় ‘নিরাপদ ভ্রমণ মানেই বিমান ভ্রমণ।’
মো. কামরুল ইসলাম ।। মহাব্যবস্থাপক- জনসংযোগ, ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্স