ওষুধ একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ স্বাস্থ্য পণ্য এবং সারা বিশ্বেই এর উৎপাদন ও বিপণন নিয়ন্ত্রণ করা হয় খুব কঠোরভাবে। নতুন ওষুধ আবিষ্কার এবং ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের চারটি জটিল এবং ব্যয়বহুল ধাপ অতিক্রম করতে হয়। কোনো ওষুধকে বাজারজাত করে আবিষ্কারক ওষুধ কোম্পানিসমূহকে বিনিয়োগ করতে হয় ১ বিলিয়ন ডলারের বেশি অর্থ। তবে এ ব্যয়ের হিসাব শুধু পশ্চিমা ওষুধ বা অ্যালোপ্যাথিক মেডিসিনের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য।

ইউনানি, হার্বাল, আয়ুর্বেদিক, হোমিওপ্যাথিসহ বিকল্প চিকিৎসা পদ্ধতির ওষুধের উৎপাদন ও বিপণন পশ্চিমা ওষুধের মতো ততটা নিয়ন্ত্রিত নয়। কিন্তু পশ্চিমা ওষুধের উৎকর্ষতার সাথে তাল মেলাতে না পেরে একসময়ের অত্যন্ত প্রভাবশালী প্রাচীন পদ্ধতির ওষুধের ধারাসমূহ গুরুত্ব হারাতে বসেছে। তাই, এখন ওষুধ বলতে সাধারণভাবে আমরা পশ্চিমা ওষুধ বা অ্যালোপ্যাথিক মেডিসিনকে বুঝি এবং এ লেখায় সাধারণভাবে ‘ওষুধ’ বলতে শুধুমাত্র অ্যালোপ্যাথিক ওষুধকে বুঝিয়েছি।

প্রসঙ্গত বলে রাখি, দেশে ২৭০টি অ্যালোপ্যাথিক ওষুধ কোম্পানি রয়েছে। যাদের মধ্যে দু-একটি কোম্পানি ওষুধ গবেষণায় বিনিয়োগ করা শুরু করেছে। দেশীয় কোম্পানিসমূহের গবেষণা বলতে যা হয় তা হলো জেনেরিক ওষুধের ফর্মুলেশন উন্নয়ন, কিছু ক্ষেত্রে জেনেরিক ওষুধের কার্যকারিতা এবং নিরাপত্তা পরীক্ষার জন্য বায়োইকুভ্যালেন্স স্টাডি এবং উৎপাদন প্রক্রিয়া উন্নয়ন।

কিছু কোম্পানি বিদেশি ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানির সঙ্গে সহযোগিতায় আন্তর্জাতিক মানের ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল পরিচালনা করে। ওষুধ আবিষ্কারে বিনিয়োগ করতে হয় না বলে আমাদের দেশীয় কোম্পানিসমূহ অনেক কম মূল্যে ওষুধ বাজারজাত করতে পারে।

০৩ ফেব্রুয়ারি আজকের পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, বর্তমানে আমাদের দেশে প্রায় দেড় হাজারের বেশি জেনেরিকের বিপরীতে প্রায় সাতাশ হাজার ব্র্যান্ডের ওষুধ উৎপাদিত হয়। দেশের এই দেড় হাজার জেনেরিকের মধ্যে মাত্র ১১৭টি জেনেরিক এসেনশিয়াল মেডিসিনের তালিকাভুক্ত।

ওষুধের দাম নির্ধারণের ক্ষেত্রে দেশের ওষুধ প্রস্ততকারক কোম্পানিগুলো মূলত চারটি বিষয় বিবেচনায় নেয়—কাঁচামালের আমদানির খরচ, উৎপাদন ও প্যাকেজিং খরচ, বিতরণ ও বিপণনের খরচ এবং মুনাফা।

এসেনশিয়াল মেডিসিনের তালিকায় কোন ওষুধ থাকবে তা খুব গুরুত্বপূর্ণ কারণ, এ তালিকার ওষুধের সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য নির্ধারণ করে দেয় সরকার, তাই কোম্পানি চাইলেও এসব ওষুধের দাম সহজে বাড়াতে পারে না। অন্য সব ওষুধের মূল্য নির্ধারণ করে উৎপাদনকারী কোম্পানিগুলো

ওষুধের দাম নির্ধারণের ক্ষেত্রে দেশের ওষুধ প্রস্ততকারক কোম্পানিগুলো মূলত চারটি বিষয় বিবেচনায় নেয়—কাঁচামালের আমদানির খরচ, উৎপাদন ও প্যাকেজিং খরচ, বিতরণ ও বিপণনের খরচ এবং মুনাফা।

বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী দেশে এক দশকে ধাপে ধাপে বিভিন্ন জীবনরক্ষাকারী ওষুধের দাম বেড়েছে প্রায় ১০ থেকে ১৪০ শতাংশ। ওষুধ প্রস্তুতকারকদের দাবি, ডলারের মূল্যবৃদ্ধি এবং আন্তর্জাতিক বাজারে কাঁচামালের মূল্যবৃদ্ধির কারণে ওষুধের দাম বারবার বাড়াতে হয়েছে।

তথ্য বলছে, প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে ওষুধ কোম্পানিগুলো তাদের উৎপাদন ও বিপণন খরচের ৩০-৫০ শতাংশ চিকিৎসকদের পেছনে ব্যয় করে, যেটি ওষুধের দাম বৃদ্ধির পেছনে বড় ভূমিকা রাখে। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মতে, জনগণের ক্রয় ক্ষমতাকে বিবেচনায় নিয়ে এ খাতে ব্যয় কমিয়ে ওষুধ কোম্পানিগুলো ওষুধের দাম বৃদ্ধিকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে।

১২ ডিসেম্বর বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী বর্তমানে একজন রোগীর চিকিৎসার জন্য যে অর্থ ব্যয় করে তার প্রায় ৬৫ শতাংশ ব্যয় হয় ওষুধের পেছনে। এর মূল কারণ ওষুধের মূল্যবৃদ্ধি। জনগণের কল্যাণের কথা চিন্তা করে ওষুধ কোম্পানির চিকিৎসকদের পেছনে ব্যয় কমিয়ে, ওষুধের দাম সহনীয় পর্যায়ে রাখতে সচেষ্ট হওয়া উচিত।

বিশ্বের একেক দেশে ওষুধের দাম নির্ধারণের প্রক্রিয়া একেকরকম এবং বেশ জটিল। যুক্তরাষ্ট্রের কথায় ধরা যাক। যুক্তরাষ্ট্রে ওষুধের দাম মূলত প্রস্ততকারক কোম্পানি কর্তৃক নির্ধারিত হয়। সরকারের হস্তক্ষেপ নেই বললেই চলে। তাই সেখানে সব ওষুধের দাম অনেক বেশি। বিশেষ করে নতুন আবিষ্কৃত ওষুধের দাম খুব বেশি হয় কারণ আবিষ্কারক কোম্পানি ওষুধ আবিষ্কার, গবেষণা ও বাজারজাতকরণের পেছনে যে ১ বিলিয়ন ডলার ব্যয় করে তা ওষুধ বিক্রির লভ্যাংশ থেকে উঠিয়ে নেয়।

নতুন ওষুধের প্যাটেন্টের মেয়াদ সাধারণত ২০ বছর হয়। এ সময়ের মধ্যে শুধুমাত্র সে কোম্পানিই এককভাবে সে ওষুধ উৎপাদন করে এবং উচ্চদামে বিক্রি করে। প্যাটেন্টের মেয়াদ শেষ হলে জেনেরিক উৎপাদন শুরু হয় তখন যেকোনো কোম্পানি চাইলে সে ওষুধ উৎপাদন ও বাজারজাত করতে পারে।

বাজার প্রতিযোগিতার কারণে তখন জেনেরিক ওষুধের দাম কমে যায়। যুক্তরাষ্ট্রে ওষুধের দাম নির্ধারণে বীমা কোম্পানি, ফার্মেসি বেনিফিট ম্যানেজারদের দরকষাকষি এবং হাসপাতাল ও বীমা কোম্পানির সাথে চুক্তি বড় প্রভাব ফেলে।

ইউরোপের দেশগুলোতেও ওষুধের দাম নির্ধারণে সরকারের শক্তিশালী নিয়ন্ত্রণ রয়েছে, তাই কোনো কোম্পানি চাইলে সহজেই ওষুধের দাম বাড়াতে পারে না।

যুক্তরাজ্যসহ ইউরোপের সব দেশ, কানাডা ও অস্ট্রেলিয়ায় ওষুধের দাম নির্ধারণে সরকারের ভূমিকাই মুখ্য। যুক্তরাজ্যে National Health Service (NHS) এবং National Institute for Health and Care Excellence (NICE) ওষুধের দাম নিয়ন্ত্রণে খুব শক্ত ভূমিকা পালন করে।

নতুন ওষুধের আবিষ্কারক কোম্পানি নাইস (NICE)-এর নিকট দাম প্রস্তাব করে। এরপর, নাইস (NICE) নতুন ওষুধের কার্যকারিতা এবং দামের ন্যায্যতা পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে পর্যালোচনা করে এবং এনএইচএস (NHS)-এর নিকট সুপারিশ করে। নাইসের সুপারিশের ভিত্তিতে এনএইচএস নতুন ওষুধ আবিষ্কারক কোম্পানির সাথে দাম নিয়ে চুক্তি করে। এর মাধ্যমে নতুন ওষুধের দামের ন্যায্যতা, প্রয়োজনীয়তা এবং সাশ্রয়ীতা নিশ্চিত করা হয়। এ কারণে প্যাটেন্ট-ভুক্ত অনেক ওষুধ যুক্তরাষ্ট্রের চেয়ে যুক্তরাজ্যের এনএইচএস কম দামে কিনতে পারে।

অন্যদিকে প্যাটেন্ট-মুক্ত বা জেনেরিক ওষুধের দাম বাজার প্রতিযোগিতার ওপর নির্ভর করে এবং ফলে ওষুধের দাম নিয়ন্ত্রণে থাকে। অন্য ইউরোপের দেশগুলোতেও ওষুধের দাম নির্ধারণে সরকারের শক্তিশালী নিয়ন্ত্রণ রয়েছে, তাই কোনো কোম্পানি চাইলে সহজেই ওষুধের দাম বাড়াতে পারে না।

তবে মূল্যস্ফীতি ও কাঁচামালের দাম বৃদ্ধির কারণে আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশসমূহেও ওষুধের দাম বেড়েছে। ভারতে ওষুধের দাম নিয়ন্ত্রণ করে National Pharmaceutical Pricing Authority (NPPA)। এনপিপিএ প্রায় ৩৮৪-এর বেশি এসেনশিয়াল মেডিসিনের দাম নির্ধারণ করে দেয় এবং কোম্পানিগুলো এর বেশি দামে ওষুধ বিক্রি করতে পারে না।

তুলনামূলকভাবে বাংলাদেশে এসেনশিয়াল মেডিসিনের তালিকা অনেক ছোট, সংখ্যাটি মাত্র ২৮৫। এসেনশিয়াল মেডিসিনের বাইরে অন্যান্য ওষুধের দাম নির্ধারণে ভারত সরকারের তেমন ভূমিকা পালন করে না, তাই ভারতেও বিভিন্ন সময়ে অন্য ওষুধগুলোর দাম বেড়েছে। কিন্তু, ভারতে এসেনশিয়াল মেডিসিনের তালিকা অনেক বড় হওয়ায় এবং স্বাস্থ্য বীমা থাকায় ওষুধের দাম বৃদ্ধি সাধারণ রোগীদের তেমন ক্ষতিগ্রস্ত করে না।

২০২৪ সালে ভারত সরকার মুদ্রাস্ফীতি ও উচ্চ উৎপাদন মূল্যের কথা বিবেচনা নিয়ে এসেনশিয়াল মেডিসিন লিস্টের ৩৮৪ ওষুধের মধ্যে ১১টি ওষুধের দাম ৫০ শতাংশ এবং বাকিগুলোর ক্ষেত্রে ১২ শতাংশ পর্যন্ত মূল্য বাড়ানোর অনুমতি দেয়। একইভাবে পাকিস্তানেও মুদ্রাস্ফীতি ও উচ্চ উৎপাদন মূল্যের কারণে ওষুধের দাম বেড়েছে।

মুদ্রাস্ফীতি ও উৎপাদন খরচ বৃদ্ধির কারণে ওষুধের দাম বৃদ্ধি একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। কিন্তু, আমাদের মতো নিম্ন আয়ের দেশে ওষুধের দাম বৃদ্ধির প্রভাব খুব ভয়ানক। দেশে সর্বজনীন স্বাস্থ্য বীমা না থাকায় ওষুধের দাম বৃদ্ধি সরাসরি সরাসরি গ্রাহকদের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।

অনেক পরিবার ওষুধের কিনতে গিয়ে নিঃস্ব হয়ে যায়। সরকারের উচিত যেসব ওষুধ দীর্ঘ মেয়াদে রোগীদের খেতে হয় এবং যেসব রোগের ওষুধের দাম বেশি সেগুলো এসেনশিয়াল মেডিসিনের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা এবং পাশাপাশি ওষুধকে অন্তর্ভুক্ত করে সর্বজনীন স্বাস্থ্য বীমা চালু করা যাতে রোগীরা উচ্চ মূল্যের ওষুধের কারণে চিকিৎসা বঞ্চিত না হন।

ড. মো. আজিজুর রহমান ।। অধ্যাপক, ফার্মেসি বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
ajijur.rubd@gmail.com