পাপিয়া সারোয়ার, নামটি উচ্চারিত হওয়া মাত্রই বাঙালির হৃদয়ে এক অতলস্পর্শী প্রশান্তি ও সুরের ছন্দময় অনুরণন জাগ্রত হয়। তিনি এক অদ্ভুত শিল্পসত্তার অধিকারিণী, যার জীবন ও কর্ম রবীন্দ্রনাথের গানের সাথে এমনভাবে মিশে ছিল যেন তার প্রতিটি সুর, প্রতিটি কথা নবজাগরণের সুরধ্বনি হয়ে মানুষের অন্তরে গেঁথে যায়। প্রয়াত এই সংগীত সাধিকা বাংলা সংস্কৃতির আকাশে এক নক্ষত্র, যার দীপ্তি চিরকাল অক্ষুণ্ন থাকবে।

পাপিয়া সারোয়ার ছিলেন বাংলাদেশের প্রথম সংগীতশিল্পী, যিনি রবীন্দ্রনাথের গান নিয়ে প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনার জন্য শান্তিনিকেতনের বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে পাড়ি দেন। এটি ছিল এক অভূতপূর্ব পদক্ষেপ, যা শুধু তার নিজের জীবনের নয়, বরং সমগ্র বাংলার রবীন্দ্রসংগীতের অগ্রযাত্রার ক্ষেত্রে এক নবদিগন্তের সূচনা করে।

তার এই প্রবাস-অভিযান শুধু যে একাডেমিক পরিসরে তার স্থান নিশ্চিত করে, তা নয় বরং তিনি প্রমাণ করেন যে রবীন্দ্রনাথের গান কেবল আবেগ নয়, এটি জ্ঞানের গভীরতায় ডুব দিয়ে উপলব্ধি করার এক অসীম ভাণ্ডার।

তার এই প্রচেষ্টা ছিল এক ধ্রুপদি অভিযাত্রার ন্যায়, যেখানে সুরের জ্যোতিষ্কে আলোকিত হয়ে তিনি বাংলাসংগীত জগতে এক উজ্জ্বল তারকা হয়ে ওঠেন।

পাপিয়া সারোয়ার কেবল একজন অনন্য সুরের সাধকই ছিলেন না, তিনি ছিলেন এক মাতৃরূপী সত্তার প্রতীক। তার ব্যক্তিত্বের এই দিকটি তাকে অন্যদের থেকে আলাদা করেছিল। তার আচরণে ছিল মমতার উষ্ণতা, যা তার সঙ্গে যেকোনো ব্যক্তির সম্পর্ককে গভীরতায় পূর্ণ করত। ব্যক্তিগতভাবে আমি নিজে তার পরম মমতা ও স্নেহের সন্ধান পেয়েছি বহুবার।

পাপিয়া সারোয়ার কেবল একজন অনন্য সুরের সাধকই ছিলেন না, তিনি ছিলেন এক মাতৃরূপী সত্তার প্রতীক। তার ব্যক্তিত্বের এই দিকটি তাকে অন্যদের থেকে আলাদা করেছিল।

তার স্নেহময় আচরণ কেবল ব্যক্তিগত জীবনে নয়, বরং তার শিল্পীসত্তার প্রতিফলনেও দেখা যায়। তিনি তরুণ শিল্পীদের পরম মমতায় শেখাতেন রবীন্দ্রসংগীতের সঠিক আঙ্গিক ও মর্মার্থ। তার শিক্ষাদান পদ্ধতিতে রবীন্দ্রনাথের আদর্শ এবং গানের গভীর ব্যাখ্যার প্রতি যে অনুরাগ, তা স্পষ্ট হয়ে উঠত।

রবীন্দ্রনাথের গান পাপিয়া সারোয়ারের জীবনে ছিল যেন শিরায় শিরায় প্রবাহিত এক ধ্রুপদি সুরমাল্য। তার গায়কিতে ছিল এক অপরিসীম স্নিগ্ধতা, যা শ্রোতাদের হৃদয়ে গভীর প্রভাব বিস্তার করত। তার কণ্ঠস্বরে ছিল এক সমুদ্রতুল্য প্রশান্তি, যেখানে সুরের প্রতিটি ঢেউ মনে করিয়ে দিত জীবনের নিখুঁত সুন্দরতম মুহূর্তগুলো।

তিনি রবীন্দ্রসংগীতকে শুধুমাত্র সংগীতের একটি শাখা হিসেবে নয়, বরং এক আধ্যাত্মিক অধ্যয়ন হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন। তার গায়কিতে এই আধ্যাত্মিকতা স্পষ্টভাবে প্রতিফলিত হতো। গানের প্রতিটি শব্দ, প্রতিটি সুর যেন জীবনের গভীরতম মর্মার্থকে তুলে ধরত। তার গানে রবীন্দ্রনাথের প্রকৃতি, প্রেম, মানবতা এবং চিরন্তন ভাবনা নতুন রূপে ধরা দিত।

পাপিয়া সারোয়ারের সাংগঠনিক দক্ষতা ছিল তার আরেকটি অনন্য বৈশিষ্ট্য। তিনি জাতীয় রবীন্দ্রসংগীত সম্মিলন পরিষদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত ছিলেন। এই সংগঠনের মাধ্যমে তিনি সারা দেশে রবীন্দ্রসংগীতের বিস্তার ঘটিয়েছেন।

তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে, রবীন্দ্রসংগীত শুধু একক শিল্পীর গানের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকা উচিত নয় বরং এটি সমগ্র সমাজের মননে প্রতিষ্ঠিত হওয়া উচিত। এই লক্ষ্যে তিনি একটি ‘গীতসুধা’ নামে গানের স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন, যেখানে নতুন প্রজন্মের শিল্পীদের রবীন্দ্রসংগীতের সঠিক চর্চার সুযোগ দেওয়া হতো।

এই স্কুলটি কেবল সংগীতশিক্ষার প্রতিষ্ঠান নয় বরং এটি ছিল এক প্রেরণাদায়ী কেন্দ্র, যা তরুণদের মধ্যে সংগীতের প্রতি ভালোবাসা এবং গভীরতা তৈরি করত। তার প্রয়াণে সংগীতজগতে যে শূন্যতার সৃষ্টি হয়েছে, তা পূরণ করা প্রায় অসম্ভব।

রবীন্দ্রসংগীতের পাশাপাশি তার বহুল জনপ্রিয় আধুনিক গান—‘নাই টেলিফোন, নাইরে পিয়ন, নাইরে টেলিগ্রাম’ গানটি আমাদের সারাজীবন অবাক করবে মুগ্ধতায়! রবীন্দ্রসংগীতের ক্ষেত্রেও তার কণ্ঠে জনপ্রিয়তা পায় কিছু গান যেমন, ‘হল না লো, হল না, সই, হায়--’, ‘বরিষ ধরা-মাঝে শান্তির বারি’ প্রভৃতি গান।

পাপিয়া সারোয়ার কেবল একজন শিল্পী নন; তিনি একটি যুগের প্রতীক। তার গানে, আচরণে এবং তার জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে এক চিরন্তন সৌন্দর্যের উপস্থিতি পাই।

এইসব গানের মধ্য দিয়ে তিনি রবীন্দ্রনাথের গানকে সর্বসাধারণের একান্তের গান করে তুলেছিলেন। তিনি যে স্নেহ, ভালোবাসা, এবং সংগীতের প্রতি অনুরাগ রেখে গেছেন, তা একটি প্রজন্ম থেকে আরেক প্রজন্মের মধ্যে ছড়িয়ে পড়বে। তবে, তার মতো রবীন্দ্রসংগীতের প্রতি নিবেদিতপ্রাণ শিল্পী পাওয়া দুঃসাধ্য।

পাপিয়া সারোয়ার কেবল একজন শিল্পী নন; তিনি একটি যুগের প্রতীক। তার গানে, আচরণে এবং তার জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে এক চিরন্তন সৌন্দর্যের উপস্থিতি পাই। বাংলার সংস্কৃতি এবং সংগীত তাকে চিরকাল স্মরণ করবে এক অনন্য সাধক এবং রবীন্দ্রসংগীতের অগ্রণী পথিকৃৎ হিসেবে।

পাপিয়া সারোয়ারের জীবন ও কর্ম আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় যে, প্রকৃত শিল্পী কেবল সুরকে কণ্ঠে ধারণ করেন না বরং মানবিক গুণাবলির এক জীবন্ত প্রতিচ্ছবি হয়ে ওঠেন।

তার গান, তার মাতৃসুলভ আচরণ এবং রবীন্দ্রসংগীতের প্রতি তার অগাধ নিবেদন তাকে বাংলার সংস্কৃতির ইতিহাসে অমর করে রাখবে। তিনি আমাদের হৃদয়ে চিরকাল বেঁচে থাকবেন, এক অনন্য সাধক এবং অনুপ্রেরণাদায়ী চরিত্র হিসেবে।

ড. অণিমা রায় ।। সহযোগী অধ্যাপক, সংগীত বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়