‘বিজয়’ শব্দটিকে আমরা প্রায়শই রাজনৈতিক বিজয় হিসেবে দেখি। কিন্তু বাংলাদেশের বর্তমান ক্রান্তিকালে, একটি বৈষম্যহীন সমাজ প্রতিষ্ঠায় যখন সবাই অঙ্গীকারাবদ্ধ এবং সচেষ্ট, অর্থনৈতিক বিজয় বিষয়টিও আমাদের জন্য অতীব গুরুত্বপূর্ণ—বিশেষত এবারের বিজয় দিবসে। সেখানে প্রাসঙ্গিক প্রশ্ন হচ্ছে যে, এই অর্থনৈতিক বিজয় লাভের পন্থাগুলো কী?

তবে সে প্রশ্নের উত্তরের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িয়ে আছে যে বিষয়টি, তা হচ্ছে এই বিজয়ের পথে অন্তরায়গুলো কী। বলা নিষ্প্রয়োজন যে, এসব অন্তরায়ের কিছু কিছু আছে আপাতদৃষ্ট, কিছু কিছু মৌলিক। যেমন, মূল্যস্ফীতিকে একটি আপাত অন্তরায় বলা যেতে পারে, আবার অর্থনৈতিক শৃঙ্খলার দলনকে একটি মৌলিক বাধা হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে।

বর্তমান সময়ে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক বিজয়ের পথে যে আপাত অন্তরায়গুলো রয়েছে তার প্রথমেই রয়েছে দারিদ্র্য এবং বৈষম্য। এ দেশের ৪ কোটি মানুষ এখনো দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করে। প্রতি পাঁচটি শিশুর মধ্যে একটি অপুষ্টির শিকার। এ দেশে প্রতি ২০০০ লোকের জন্য একজন চিকিৎসক আছেন এবং প্রতি আড়াই হাজার মানুষের জন্য একজন সেবিকা।

বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অঙ্গনে আয় এবং সম্পদের অসমতা সর্বজনবিদিত। হাজার হাজার কোটি টাকার খেলাপি ঋণ বা অর্থপাচারের দিকে তাকালেই বোঝা যায় যে, অর্থ ও বিত্ত কয়েকটি মানুষ এবং পরিবারে কুক্ষিগত ছিল। মোটাদাগের উপাত্তের দিকে যদি তাকাই, তাহলে আয়ের মাপকাঠিতে বাংলাদেশের মোট আয়ের মাত্র ১৩ শতাংশ যেখানে দেশের নিম্নতম ৪০ শতাংশ জনগোষ্ঠীর যায়, সেখানে সমাজের সর্বোচ্চ ১০ শতাংশ মানুষ ভোগ করে দেশজ আয়ের ৩৮ শতাংশ।

উচ্চ মূল্যস্ফীতিও প্রবৃদ্ধিকে ক্ষয় করেছে। কিছুদিন আগে দেশের ভয়াবহ বন্যাও একদিকে যেমন মানুষের জীবন, জীবিকা বিনষ্ট করেছে, সম্পদের ক্ষতি করেছে, অন্যদিকে উপদ্রুত অঞ্চলের উৎপাদন কাঠামো নষ্ট করেছে

মানব উন্নয়নের নানান সূচকেও এমন বৈষম্য বিদ্যমান। অনূর্ধ্ব পাঁচ বছরের শিশু মৃত্যুর হার সর্বনিম্ন ২০ শতাংশ জনগোষ্ঠীর মধ্যে যেখানে প্রতি হাজারে ৪৯, সেখানে সর্বোচ্চ ২০ শতাংশ জনগোষ্ঠীর মধ্যে তা প্রতি হাজারে ২৫। আঞ্চলিক বৈষম্যের দিকে যদি তাকাই, তাহলে দেখা যায়, বরিশালে সাক্ষরতার হার যেখানে ৭৫ শতাংশ, সিলেটে সেটা ৬০ শতাংশ।

বৈষম্য শুধু ফলাফলেই নয়, সুযোগের ক্ষেত্রেও বিদ্যমান। যেমন, শিক্ষা এবং স্বাস্থ্য সুযোগে বৈষম্য অত্যন্ত প্রকট। শিক্ষায় সরকারি এবং বেসরকারি ধারা, বাংলা এবং ইংরেজি মাধ্যম, বিত্তবান এবং বিত্তহীনদের জন্যে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ইত্যাদি প্রবণতার মাধ্যমে শিক্ষা সুযোগে একটি বিশাল বৈষম্যের সৃষ্টি করা হয়েছে।

একইভাবে স্বাস্থ্যখাতে ত্রি-ধারা ব্যবস্থা বজায় রেখে স্বাস্থ্য সুযোগের ক্ষেত্রেও একটি বিশাল বৈষম্যের দেয়াল নির্মাণ করা হয়েছে। ফলে সরকারি স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় সেবার পরিমাণ যেমন অপ্রতুল, তেমনি তার মানও খুব নিচু। সাধারণ মানুষই সরকারি স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় যায় এবং স্বাভাবিকভাবেই তারা ন্যূনতম স্বাস্থ্য সুবিধা পান না।

অন্যদিকে বিত্তবানেরা স্বাস্থ্য সেবা গ্রহণের জন্যে বিদেশে পাড়ি জমান। শিক্ষা এবং স্বাস্থ্যের মতো মানবিক অধিকার এবং মৌলিক মানবিক চাহিদা বলয়ে এ জাতীয় বৈষম্য অগ্রহণযোগ্য। তথ্যপ্রযুক্তি সেবায় সর্বোচ্চ ২০ শতাংশ গৃহস্থালির তিন-চতুর্থাংশের যেখানে আন্তর্যোগ সেবায় লভ্যতা আছে, সেখানে নিম্নতম ২০ শতাংশ গৃহস্থালির ক্ষেত্রে তুলনামূলক সংখ্যাটি হচ্ছে মাত্র ৯ শতাংশ। শহরাঞ্চলের ৫৫ শতাংশ মানুষ আন্তর্যোগ ব্যবহার করে, গ্রামাঞ্চলের তেমন মানুষের অনুপাত হচ্ছে ৩৫ শতাংশ। গ্রামাঞ্চলের মাত্র ৩ শতাংশ ঘরে কম্পিউটার আছে এবং ৭৮ শতাংশ গ্রামীণ মানুষ এ যন্ত্রটি ব্যবহার করতে জানেন না।

বাংলাদেশে নারী-পুরুষের মধ্যেও ফলাফল ও সুযোগের মধ্যে অসমতা রয়েছে। যেমন, উচ্চতম শিক্ষাস্তরে নারীর অন্তর্ভুক্তির হার যেখানে ১৭ শতাংশ, সেখানে পুরুষদের মধ্যে সে সংখ্যাটি হচ্ছে ২৪ শতাংশ। দেশের শ্রমশক্তিতে পুরুষের অংশগ্রহণের হার যেখানে ৮১ শতাংশ, নারীদের মাঝে সে সংখ্যাটি হচ্ছে মাত্র ৩৬ শতাংশ। জ্যেষ্ঠ এবং মধ্যমস্তরের নির্বাহীদের মাঝে নারীর অনুপাত হচ্ছে মাত্র ১২ শতাংশ। বাংলাদেশে মুঠোফোনের ব্যবহারের ক্ষেত্রে পুরুষ-নারীর মাঝে তফাত হচ্ছে ২৯ শতাংশ। আন্তর্যোগ ব্যবহারের ক্ষেত্রে দেশের ৩৩ শতাংশ পুরুষ আন্তর্যোগ ব্যবহার করেন—নারীদের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট সংখ্যাটি হচ্ছে ১৭ শতাংশ।

এই বিভিন্ন মাত্রিকতার বৈষম্য কমাতে একদিকে যেমন দরিদ্রবান্ধব নীতিমালা গ্রহণ করতে হবে, তেমনি অন্যদিকে যেসব প্রাতিষ্ঠানিক বা কাঠামোগত প্রতিবন্ধকতা এবং দুর্বলতা আছে, সেগুলো দূর করতে হবে। নীতিমালার ক্ষেত্রে মুদ্রা, করনীতি, বাণিজ্য নীতিতে যেন ধন ও সম্পদ পক্ষপাত না থাকে তা নিশ্চিত করা প্রয়োজন।

তেমনিভাবে, নারী-পুরুষের মধ্যকার অসমতা কমানোর জন্য নীতিমালা যেন নারীদের প্রত্যাশা পূর্ণ করে, তা দেখা দরকার। সামাজিক সুরক্ষা ব্যবস্থাও বৈষম্য কমিয়ে আনে। শিক্ষা সুযোগে, স্বাস্থ্য সেবায় সুযোগের অসমতা কমানোর জন্যে কাঠামোগত সংস্কার প্রয়োজন।

অর্থনৈতিক বিজয়ের পথে আমাদের দ্বিতীয় আপাত অন্তরায়টি হচ্ছে মূল্যস্ফীতি, যা জনজীবনকে বিপর্যস্ত করে তুলেছে। দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশের মানুষ উচ্চমূল্যের শিকার হয়েছে। এর সঙ্গে বৈশ্বিক মূল্যস্ফীতির সংযোগ নেই। উন্নত বিশ্বে যুক্তরাজ্যে মূল্যস্ফীতির হার ২ শতাংশ, যুক্তরাষ্ট্রে ৩ শতাংশ, ক্যানাডায় ১ শতাংশ। সব দেশই কোভিড সম্পর্কিত এবং ইউক্রেন যুদ্ধ সম্পৃক্ত উচ্চমূল্য কমিয়ে আনতে পেরেছে।

বাংলাদেশের প্রতিবেশী দেশগুলোর মধ্যে পাকিস্তান ভিন্ন অন্য সব দেশের মূল্যস্ফীতি বাংলাদেশের চেয়ে কম। দুই বছর আগেকার সংকট কাটিয়ে শ্রীলঙ্কা তার ৭০ শতাংশ মূল্যস্ফীতিকে বর্তমান সময়ে ১ শতাংশের নীচে কমিয়ে নিয়ে আসতে পেরেছে। কিন্তু বাংলাদেশে মূল্যহ্রাস হয়নি। এখনো এ দেশে মূল্যস্ফীতি ১৩ শতাংশের ওপরে।

সম্প্রতি অর্থ উপদেষ্টা এ হারকে ৯ শতাংশের নিচে নামিয়ে আনবেন বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। কিন্তু যেকোনো বিচারে, ৯ শতাংশও উচ্চহারের মূল্যস্ফীতি। আমরা সবাই বলছি যে, বন্যার কারণে আমাদের বিভিন্ন পণ্যসামগ্রীর দাম বাড়তে পারে এবং বর্তমান সময়ে সে শঙ্কাটাও সত্য বলে প্রমাণিত হয়েছে।

মূল্যস্ফীতির ক্ষেত্রে নানান মুদ্রা নীতি এবং শুল্ক কমানো, আমদানি খুলে দেওয়ার মতো বাণিজ্য নীতি গ্রহণ করা হয়েছে। সরকারিভাবে উন্মুক্ত বাজারে পণ্য বিক্রয়েরও চেষ্টা করা হয়েছে। কিন্তু মূল্যস্ফীতির অশ্বকে বাগ মানানো যাচ্ছে না। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে যে, সমস্যাটি কাঠামোগত—যেখানে একটি গোষ্ঠী শ্রেণি এখনো বাজার ব্যবস্থাকে নিয়ন্ত্রণ করছে। প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার ভিন্ন মূল্যস্ফীতি কমবে না।

নানাবিধ কারণে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে শ্লথ গতি লক্ষ্য তার যাচ্ছে। একে অর্থনৈতিক বিজয়ের পথে তৃতীয় আপাত অন্তরায় হিসেবে ধরা যেতে পারে। আমাদের সামগ্রিক অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড এখনো তার আগের পর্যায়ে যেতে পারেনি। তেমনিভাবে, পোশাক শিল্পখাতের উৎপাদন এখনো স্বাভাবিক পর্যায়ে পৌঁছায়নি। অন্যান্য শিল্পখাতেও উৎপাদন হ্রাস এখনো কাটিয়ে ওঠা যায়নি। এ সবকিছু বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ওপরে বিরূপ প্রতিক্রিয়া ফেলছে।

উচ্চ মূল্যস্ফীতিও প্রবৃদ্ধিকে ক্ষয় করেছে। কিছুদিন আগে দেশের ভয়াবহ বন্যাও একদিকে যেমন মানুষের জীবন, জীবিকা বিনষ্ট করেছে, সম্পদের ক্ষতি করেছে, অন্যদিকে উপদ্রুত অঞ্চলের উৎপাদন কাঠামো নষ্ট করেছে। যদিও প্রবৃদ্ধির ওপরে বন্যার অর্থনৈতিক প্রভাব এখনো যথাযথভাবে নিরূপিত হয়নি, কিন্তু দেশের বিস্তৃত অঞ্চলের ব্যাপ্ত বন্যা যে ভবিষ্যৎ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে বিরূপ প্রতিক্রিয়া ফেলবে, তাতে সন্দেহ নেই।

বর্তমান অর্থনৈতিক বাস্তবতার নিরিখে দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির কিছু প্রাক্কলন করা হয়েছে। অতি সম্প্রতি বিশ্বব্যাংক আভাস দিয়েছে যে, ২০২৪-২৫ সালের অর্থবছরে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ৪.১ শতাংশ হতে পারে। এর আগে একই অর্থবছরের জন্যে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট প্রাক্কলিত সংখ্যা ছিল ৫.১ শতাংশ।

এসব উপাত্ত থেকে দুটো বিষয় খুব স্পষ্ট—এক, প্রাক্কলিত প্রবৃদ্ধি বাংলাদেশের বর্তমান বাস্তবতারই প্রতিফলন। দুই, যদিও দেয় উপাত্তের মধ্য পার্থক্য আছে, কিন্তু বিশ্বব্যাংক এবং এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক উভয়েই তাদের পূর্ব প্রাক্কলিত উপাত্তকে কমিয়ে নিয়ে এসেছে। সরকারও বলছেন যে, ২০২৪ সালে প্রবৃদ্ধির হার ৫ শতাংশের মতো হতে পারে। 

অর্থনৈতিক শ্লথ গতি যে শুধু দেশের উৎপাদন খাতের ওপরে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে তাই নয়, তা দেশের সামাজিক খাতকেও প্রভাবিত করবে। সামাজিক খাত যেমন শিক্ষা, স্বাস্থ্য ইত্যাদি জায়গায় বিনিয়োগ কমে আসতে পারে, কারণ সম্পদের অপ্রতুলতা।  অবশ্য বাংলাদেশ অর্থনীতির কোনো খাতে অর্থনৈতিক শ্লথ গতি সবচেয়ে বেশি আঘাত হানছে, তার ওপরে এ শ্লথ গতির সামগ্রিক প্রতিক্রিয়া নির্ভর করবে।

বিগত সময়ে শিল্পখাতে কর্মশূন্য প্রবৃদ্ধি পরিলক্ষিত হয়েছে, যেখানে খাতের প্রবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে করে নিয়োজনের প্রবৃদ্ধি দেখা যায়নি। এ অবস্থায় শিল্পখাতে উৎপাদন হ্রাস পেলেও হয়তো কর্মনিয়োজন তেমন একটা কমবে না তবে সেবাখাতের কর্মকাণ্ড হ্রাস পেলে মানুষের কর্মনিয়োজন এবং আয়ের ওপরে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব পড়তে পারে।

প্রবৃদ্ধিকে দারিদ্র্যমুখী করতে হলে পাঁচটি বিষয়ের ওপরে মনোযোগ দেওয়া দরকার—

এক. কর্মনিয়োজন, জীবিকা, খাদ্য নিরাপত্তা এবং দারিদ্র্য নিরসনের জন্যে উৎপাদনশীল, আধুনিক এবং সৃজনশীল একটি কৃষিখাত গড়ে তোলা। সেই সাথে গ্রামীণ অর্থনীতির বিস্তৃত উন্নয়নের জন্য একটি নীতিকাঠামোর প্রতিস্থাপন যাতে বাংলাদেশের কৃষি-বহির্ভূত খাতে বিবিধ কর্মকাণ্ডকে প্রসারিত করা যায়।

দুই. প্রবৃদ্ধি-চালিত কর্মনিয়োজনের পরিবর্তে কর্মনিয়োজনচালিত প্রবৃদ্ধি কৌশল অনুসরণ। এ কৌশল অনুসরণ করে কর্মনিয়োজনের কর্মকাণ্ড সেসব খাতে পরিচালিত হয়, যেখানে দরিদ্র এবং প্রান্তিক মানুষেরা বাস করে, তবে অর্জিত প্রবৃদ্ধি দরিদ্রবান্ধব হবে।

অর্থনৈতিক শ্লথ গতি যে শুধু দেশের উৎপাদন খাতের ওপরে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে তাই নয়, তা দেশের সামাজিক খাতকেও প্রভাবিত করবে। সামাজিক খাত যেমন শিক্ষা, স্বাস্থ্য ইত্যাদি জায়গায় বিনিয়োগ কমে আসতে পারে, কারণ সম্পদের অপ্রতুলতা

তিন. বাংলাদেশকে নারী এবং মেয়েদের শিক্ষা এবং স্বাস্থ্য সুযোগে আরও বিনিয়োগ করতে হবে। এর ফলে তাদের অর্থনৈতিক, আইনগত এবং রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন বৃদ্ধি পাবে। নিরাপদ ভৌত কাঠামো (যেমন, রাস্তা-ঘাট); তথ্য-প্রযুক্তি লভ্যতা; ভূমি, ঋণের মতো উৎপাদনশীল সম্পদে নারীর অধিকার তাদের ক্ষমতায়নকে সুসংহত করবে। জল-সুবিধা এবং বিদ্যুৎ তাদের কাছে পৌঁছে দিলে নারীদের গৃহস্থালি কাজের বোঝা হ্রাস পাবে।

চার. বাংলাদেশে একটি সংহত, প্রাসঙ্গিক ও বাস্তবসম্মত সামাজিক সুরক্ষা কাঠামোর নির্মাণ ও বাস্তবায়ন। এর ফলে দারিদ্র্য এবং অসমতা কমে আসবে।

পাঁচ. বয়োবৃদ্ধ, প্রতিবন্ধী এবং ভঙ্গুর ভূমিতে বসবাসরত প্রান্তিক এবং নাজুক জনগোষ্ঠীর জন্য লক্ষ্যভিত্তিক ব্যবস্থা গ্রহণ।

আপাত কারণ ছাড়িয়ে অর্থনৈতিক বিজয়ের পথে মৌলিক অন্তরালগুলোর দিকে তাকালে তিনটা কারণ সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে—অর্থনৈতিক বিধি-বিধান এবং শৃঙ্খলার দলন, দৃশ্যমানতা ও জবাবদিহিতার কাঠামোর বিনষ্টিকরণ এবং সহিংসতার একটি সংস্কৃতির প্রসারণ। এটা অনস্বীকার্য যে বিগত দীর্ঘ একটা সময় ধরে বাংলাদেশ অর্থনীতিতে একটি ভঙ্গুরতা এবং একটি নাজুকতা জন্মলাভ করেছে।

আজকের বাংলাদেশে যে অর্থনৈতিক সংকটের কথা সবাই বলছেন, যা আমাদের অর্থনৈতিক বিজয়কে দুরূহ করে তুলেছে, তার একটি কারণ অতীতের দিনগুলোয় রাষ্ট্রের সব অর্থনৈতিক শৃঙ্খলা ও বিধিনিষেধ ভঙ্গ করা হয়েছে। ব্যক্তিগত সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে, কোনো ব্যয়-সুফল বিশ্লেষণ ব্যতীত মর্যাদামূলক প্রকল্প অনুমোদন করা হয়েছে। ফলে সার্বিক এক অর্থনৈতিক স্বেচ্ছাচারিতা বাংলাদেশ অর্থনীতিকে আজকের সংকটের মধ্যে ফেলে দিয়েছে। যেমন, ব্যাংকিং ব্যবস্থায় সংকট, খেলাপি এবং কু-ঋণ, অর্থ পাচারের কারণে এক বিরাট অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তার জন্ম হয়েছে। অতীত অর্থনীতিতে উদ্ভূত বিশাল এবং গভীর বহু সমস্যা বর্তমান বাংলাদেশের কাছে দায় হয়ে দাঁড়িয়েছে।

অর্থনৈতিক বিজয়ের জন্য দৃশ্যমানতা এবং জবাবদিহিতার কাঠামো একটি মৌলিক অপরিহার্যতা। অথচ, দীর্ঘসময় ধরে এই জাতীয় কাঠামোকে বিনষ্ট করা হয়েছে। ফলে, একদিকে যেমন সব ধরনের অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠান দুর্বল হয়েছে, তেমনি সর্ব পর্যায়ে দুর্নীতি এবং দুর্বৃত্তায়ন প্রসারিত হয়েছে।

দৃশ্যমানতার অনুপস্থিতিতে সরকারি তথ্য এবং উপাত্তকেও অতিরঞ্জিত করা হয়েছে এবং উন্নয়নের ভাষ্যকে বিভ্রান্তিমূলকভাব উপস্থাপন করা হয়েছে। দৃশ্যমানতা এবং দায়বদ্ধতার অভাবে কোনো রকমের আলাপ-আলোচনা, উন্নয়ন বিতর্কে বা সিদ্ধান্তে জনগণের কণ্ঠকে আমল দেওয়া হয়নি।

বর্তমান সময়ে আমাদের সমাজে সহিংসতা আমাদের ভাষা এবং সন্ত্রাস আমাদের সংস্কৃতি হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক বিজয়ের পথে এটা মৌলিক অন্তরায়। অর্থনৈতিক বিজয়ের জন্য সব মানুষের প্রতি সম্মান, পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ এবং সহনশীলতা ও পরমত সহিষ্ণুতা অপরিহার্য। এ সবকিছু অর্জন করতে গেলে মানসিকতার পরিবর্তন, মূল্যবোধের পরিশীলন এবং কাঠামো ও প্রতিষ্ঠানের সংস্কার প্রয়োজন হবে। বলা বাহুল্য যে, অর্থনৈতিক বিজয়ের পথে মানসিকতার পরিবর্তন একটি বড় বাধা।

বাংলাদেশ অর্থনীতির এইসব অন্তরায় আমাদের অর্থনৈতিক বিজয়ের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আশা করা যাচ্ছে যে, আগামী দিনগুলোয় যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে বাংলাদেশ এসব অন্তরায় কাটিয়ে উঠতে পারবে এবং অর্থনৈতিক বিজয়ের পথে আমাদের পথযাত্রা অব্যাহত থাকবে।

ড. সেলিম জাহান ।। ভূতপূর্ব পরিচালক, মানব উন্নয়ন প্রতিবেদন দপ্তর এবং দারিদ্র্য দূরীকরণ বিভাগ, জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি, নিউইয়র্ক, যুক্তরাষ্ট্র