২৫ মার্চ ১৯৭১। সন্ধ্যার পর থেকেই দৈনিক ইত্তেফাক অফিসে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর নানা তৎপরতার খবর আসছিল। অনেকেই ফোন করে সেনা মুভমেন্টের বিভিন্ন ধরনের তথ্য দিচ্ছিলেন। রাত ১০টা নাগাদ মোটামুটি নিশ্চিত হয়ে যায় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী বর্বর হত্যাযজ্ঞ শুরু করতে যাচ্ছে।

সবারই জানা, দৈনিক ইত্তেফাক ছিল আওয়ামী লীগের মুখপত্র। তাই যেকোনো ক্র্যাকডাউনে এই সংবাদপত্রটি আক্রান্ত হওয়ার বড় শঙ্কা ছিল। ওই রাতে অনেকেইে সে কথা সংবাদপত্রটির কার্যনির্বাহী সম্পাদক সিরাজুদ্দীন হোসেনকে বলেছিলেন। সাবধানও করেছিলেন। কিন্তু সিরাজুদ্দীন হোসেনের ধারণা ছিল আন্তর্জাতিক রীতি-নীতি ও মানবাধিকারের মানদণ্ডে যুদ্ধ পরিস্থিতিতেও কোনো গণমাধ্যমে হামলা করা যায় না। এটা নিষিদ্ধ, মানবাধিকার লঙ্ঘন।

তার বিশ্বাস ছিল গণমাধ্যম কর্মীরা নিরাপদে থাকবেন। কিন্তু পাকিস্তানি হানাদাররা সেই নীতি মানেনি। ২৫ মার্চ মধ্যরাতের ক্র্যাকডাউন শুরুর পর দুই দফা দৈনিক ইত্তেফাকে ব্রাশফায়ার করা হয়। যাতে শহীদ হন ইত্তেফাকের ক্যান্টিন ব্যবস্থাপকের ভাতিজা।

এছাড়া ২৬ মার্চ সকালে গান পাউডার ছিটিয়ে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয় ইত্তেফাক অফিসের নিচতলায়। কোনো মতে প্রাণ নিয়ে অফিস ত্যাগ করেন সিরাজুদ্দীন হোসেনসহ অন্যান্য সাংবাদিক, কর্মচারীরা। ওই রাতে ইংরেজি দৈনিক ‘দ্য পিপল’-এর সম্পাদক আবিদুর রহমান বাড়ির ছাদ থেকে হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল এলাকায় আগুনের লকলকে শিখা দেখেছিলেন। যদিও তখনো তিনি জানতেন না এই আগুনে পুড়ছে তারই সংবাদপত্র দ্য পিপল।

পাকিস্তানি বাহিনীর চোখের বিষে পরিণত হওয়া এই সংবাদপত্রটি অপারেশন সার্চলাইটের শুরুতে পুড়িয়ে দেয় হানাদার বাহিনী। যাতে অফিসের ভেতরে অগ্নিদগ্ধ হয়ে মারা যান কয়েকজন অফিস সহকারী। 

সন্ধ্যা থেকেই কারফিউ, ব্ল্যাকআউট। ঘুটঘুটে অন্ধকারে ডুবে যেত পুরো নগরী। তৈরি হতো ভয়ার্ত পরিবেশের। এমনই পরিবেশে ১০ ডিসেম্বর চামেলিবাগের বাসা থেকে তুলে নেওয়া হয় ইত্তেফাকের সিরাজুদ্দীন হোসেনকে...

ওই রাতে দেশবরেণ্য সাংবাদিক ফয়েজ আহমদ আশ্রয় নিয়েছিলেন জাতীয় প্রেসক্লাবে। তিনি এই স্থানকে নিরাপদ ভেবেছিলেন। কিন্তু পাকিস্তানি সেনারা এখানেও ট্যাঙ্কের গোলাবর্ষণ করে। আহত হয়েও প্রাণে বেঁচে যান ফয়েজ আহমদ।

২৬ মার্চ সকালে সার্জেন্ট জহুরুল হক হলে পাকিস্তানি সেনাদের হাতে ধরা পড়েন দৈনিক আজাদের বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি চিশতী শাহ হেলালুর রহমান। রাতের আক্রমণের সময় তিনি জীবন বাঁচাতে হল মিলনায়তনের শেডের উপর লুকিয়ে ছিলেন। তবে সকালে ধরা পড়েন।

তার বিশ্বাস ছিল দায়িত্বরত সাংবাদিকদের রেহাই দেবে সেনারা। একজন মেজরের সামনে পরিচয় পত্র পেশ করার পর খুব কাছ থেকে গুলি করে হত্যা করা হয় চিশতীকে। এখানেই শেষ নয়, ৩১ মার্চ পুড়িয়ে দেওয়া হয় দৈনিক সংবাদ-এর অফিস। যে আগুনে পুড়ে শহীদ হন সংবাদকর্মী শহীদ সাবের।

১৯৭১ সালে ইয়াহিয়া খানের বাঙালি নিধনযজ্ঞের অন্যতম লক্ষ্য ছিলেন বাংলার মুক্তিকামী সাংবাদিকেরা। যারা ষাটের দশকের শুরু থেকে বাঙালি জাতীয়তাবাদের উন্মেষে বুদ্ধিবৃত্তিক ভূমিকা রেখেছেন। মানুষকে রাজনীতি সচেতন করেছেন। মানুষের সামনে খোলাসা করেছেন পাকিস্তানিদের রাজনৈতিক ভণ্ডামি ও ষড়যন্ত্র।

যে কারণে একটি গভীর নীল নকশার অংশ হিসেবে এদেশের সাংবাদিকদের হত্যা করেছে পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের দোসররা। যে হত্যাকাণ্ডের চূড়ান্ত পর্যায় ছিল ডিসেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহ। ৩ ডিসেম্বর সর্বাত্মক যুদ্ধ শুরুর পর মাত্র এক সপ্তাহের মধ্যেই পাকিস্তানের পরাজয় মোটামুটি নিশ্চিত হয়ে যায়।

এ সময় শেষবারের মতো অবরুদ্ধ ঢাকাবাসীর ওপর নির্মম হত্যাযজ্ঞ শুরু করে পাকিস্তানি সেনা ও তাদের সহযোগীরা। এ সময় ঘরে থেকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয় দেশবরেণ্য সব সাংবাদিক, শিক্ষক, চিকিৎসকসহ সমাজের আলোকিতজনদের।

সর্বাত্মক যুদ্ধ শুরুর পর রাতের ঢাকা যেন ভূতুরে নগরী। সন্ধ্যা থেকেই কারফিউ, ব্ল্যাকআউট। ঘুটঘুটে অন্ধকারে ডুবে যেত পুরো নগরী। তৈরি হতো ভয়ার্ত পরিবেশের। এমনই পরিবেশে ১০ ডিসেম্বর চামেলিবাগের বাসা থেকে তুলে নেওয়া হয় ইত্তেফাকের সিরাজুদ্দীন হোসেনকে, ওই রাতেই আলবদর তুলে নেয় সাংবাদিক সৈয়দ নাজমুল হককে।

তিনি বিভিন্ন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সিবিএস নেটওয়ার্কের সংবাদদাতা হিসেবে কর্মরত ছিলেন। এক সময় ছিলেন পি.পি.আই. এর চিফ রিপোর্টার। এদিকে ১১ ডিসেম্বর গোপীবাগের বাসা থেকে তুলে নেওয়া হয় আ.ন.ম. গোলাম মোস্তফাকে। পরের কয়েকটি দিন ছিল আরও ভীতিকর।

১২ ডিসেম্বর অপহৃত হন নিজাম উদ্দিন আহমদ। ১৪ ডিসেম্বর ২৯ নম্বর কায়েতটুলির বাসা থেকে ঘাতকেরা বন্দুকের মুখে তুলে নেয় সংবাদ-এর শহীদুল্লা কায়সারকে। ওই রাতেই অস্ত্রের মুখে তুলে নেওয়া হয় দেশের ক্রীড়াঙ্গনের নামী সাংবাদিক শেখ আবদুল মান্নানকে। তিনি লাডু ভাই নামেই সবার কাছে পরিচিত ছিলেন।

কারফিউ ও ব্ল্যাকআউটের অভিশপ্ত রাতগুলোতে মৃত্যুদূত হয়ে সাংবাদিকদের ঘরে ঘরে হানা দিয়েছে পাকিস্তানি হায়েনা ও তাদের দোসর আলবদর বাহিনী। একে একে ঘর থেকে তুলে নিয়েছে মুহাম্মদ আখতার ও সেলিনা পারভীনকে। এই দুই গুণী সাংবাদিক সাপ্তাহিক পত্রিকার প্রকাশনার সাথে যুক্ত ছিলেন।

স্বাধীনতার ঠিক আগ মুহূর্তে জাতির এই শ্রেষ্ঠ সন্তানদের তুলে নিয়ে নির্মম নিষ্ঠুরতায় হত্যা করে ঘাতকেরা। তাদের অনেকের ক্ষত-বিক্ষত লাশ আবিষ্কৃত অবস্থায় পাওয়া যায় মিরপুরের বধ্যভূমিতে।

রাতের অন্ধকারে ঘর থেকে সাংবাদিকদের তুলে নেওয়া ও নির্মম নিষ্ঠুরতায় হত্যার ঘটনাগুলো যেন এক একটি মহাকাব্য। প্রতিটি শহীদের আত্মদানের ইতিহাস খুবই করুণ।

পরাজয়ের প্রাক্কালে হিংস্র হায়েনারা নিউ সার্কুলার রোডের বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে যান সেলিনা পারভীনকে। ওই সময় মাটি লেপা একটি মাইক্রো নিয়ে ঢাকা শহর থেকে চিহ্নিত বুদ্ধিজীবীদের তুলে নিচ্ছিলো আলবদর বাহিনী। সেলিনা পারভীনকে তুলে নিয়ে যাওয়ার ঘটনার বর্ণনা দিয়েছেন বিখ্যাত নারী অধিকার কর্মী মালেকা বেগম।

তিনি সেলিনা পারভীনকে নিয়ে স্মৃতিচারণায় লিখেছেন, ‘১৩ই ডিসেম্বর সকাল সাড়ে দশটায় কয়েকজন এসে বলল পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ডাক পড়েছে, যেতে হবে। সুমন (সেলিনা পারভীনের একমাত্র ছেলে) তখন ৮ বছর বয়সের ছিল। সব স্মরণ আছে তার। বলেছে তেল মাখিয়ে মা তাকে মামার সঙ্গে ছাদে পাঠিয়ে মোড়ায় বসে রান্না করছিলেন। বললেন পরে যাবেন কারফিউ শেষ হোক। ওরা সুযোগ দিল না। সুমন চেয়েছিল সঙ্গে যেতে। অনুমতি মেলেনি।’ (পৃষ্ঠা - ৯৩, স্মৃতি ১৯৭১, দ্বিতীয় খণ্ড)

ঘাতকদের সাথে যাওয়ার সময় ছেলে সুমনকে বলে গিয়েছিলেন কাজ শেষ করে দ্রুতই ফিরবেন। কিন্তু তার আর ফেরা হয়নি।

মিরপুরের বধ্যভূমিতে পিঠমোড়া করে হাত বাঁধা, আঙুলের নখ উপড়ানো, গুলিতে ঝাঁঝরা, বেয়োনেটে ক্ষত-বিক্ষত, অর্ধগলিত অনেক মরদেহ উদ্ধার করা হয়। যেগুলো ছিল স্বাধীনতাকামী বাঙালি শিক্ষক, ডাক্তার, চিকিৎসক, অধ্যাপক, আইনজীবী, সাংবাদিকসহ অন্যান্য পেশার আলোকিতজনের।

হতভাগ্য এই গুণীজনদের মধ্যে শহীদ সাংবাদিক সেলিনা পারভীনকে খুব সহজেই শনাক্ত করা গিয়েছিল। পরনে সাদা শাড়ি, সাদা জুতা আর মোজা থাকায় খুব সহজেই চেনা গিয়েছিল এটা সুমনের মা, সেলিনা পারভীন।

শুধু ২৫ মার্চ কালরাতের ক্র্যাকডাউন বা ১৪ ডিসেম্বরের বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডই নয়, যুদ্ধের নয় মাসই পাকিস্তানি হানাদাররা অনেকক্ষেত্রে বেছে বেছে হত্যা করেছে মুক্তিকামী সাংবাদিকদের। যাদের মধ্যে সাংবাদিক খোন্দকার আবু তালেব, শিবসাধন চক্রবর্তী, আবুল বাশার ছিলেন অন্যতম। 

শুধু ২৫ মার্চ কালরাতের ক্র্যাকডাউন বা ১৪ ডিসেম্বরের বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডই নয়, যুদ্ধের নয় মাসই পাকিস্তানি হানাদাররা অনেকক্ষেত্রে বেছে বেছে হত্যা করেছে মুক্তিকামী সাংবাদিকদের। যাদের মধ্যে সাংবাদিক খোন্দকার আবু তালেব, শিবসাধন চক্রবর্তী, আবুল বাশার ছিলেন অন্যতম। 

খোন্দকার আবু তালেব দৈনিক আজাদ, দৈনিক ইনসাফ, পাকিস্তান অবজারভার, দৈনিক সংবাদ, ইত্তেফাক ও পয়গাম প্রভৃতি পত্রিকায় সাংবাদিকতা করেছেন। ২৫ মার্চ ক্র্যাকডাউনের পর ২৯ মার্চ ১৯৭১ মিরপুর থেকে অপহৃত হন। পরে তার মরদেহ পাওয়া যায়।

সাংবাদিক শিবসাধন চক্রবর্তীসহ সম্পাদক হিসেবে কর্মরত ছিলেন পাকিস্তান অবজারভার পত্রিকায়। ২৫ মার্চ নির্বিচার হত্যাযজ্ঞ শুরুর পর এক পর্যায়ে প্রাণ বাঁচাতে রমনা কালীমন্দিরে আশ্রয় নিয়েছিলেন এই সাংবাদিক। দিনটি ছিল ২৭ মার্চ ১৯৭১। ওইদিন পাকিস্তান বাহিনীর নিষ্ঠুর নির্মমতায় হিন্দু ধর্মের অন্যান্য সদস্যদের সাথে শহীদ হন শিবসাধন চক্রবর্তী।

আর তরুণ সাংবাদিক আবুল বাশার কাজ করতেন মর্নিং নিউজ-এ। ঢাকার গেরিলারা ফার্মগেইটসহ বিভিন্নস্থানে অবিশ্বাস্য গুপ্ত হামলা চালানোর পর এক অভিযানে আটক হন আবুল বাশার। ২৯ আগস্ট তার সাথে আটক হয়েছিলেন গেরিলা যোদ্ধা বদি, আজাদসহ অন্যান্যরা। পৃথক অভিযানে আটক হয়েছিলেন রুমিসহ আরও বেশ কয়েকজন বীর যোদ্ধা। এরপর এই সাংবাদিকের আর কোনো সন্ধান পাওয়া যায়নি। মাত্র ২২ বছর বয়সে দেশ মাতৃকার জন্য প্রাণ বিসর্জন দেন আবুল বাশার।

১৪ ডিসেম্বর বিজয়ের ঊষালগ্নে অতল শ্রদ্ধা একাত্তরের বুদ্ধিজীবী সাংবাদিকদের। 

রাহাত মিনহাজ ।। সহকারী অধ্যাপক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়