টিকা প্রাপ্তির অনিশ্চয়তা বাংলাদেশে এখন সবচেয়ে আলোচিত বিষয়। সম্প্রতি আমরা করোনা সংক্রমণের ঊর্ধ্বগতি লক্ষ্য করছি, যেটা করোনার দ্বিতীয় ঢেউ নামে পরিচিত। তৃতীয় ঢেউয়ের শঙ্কাও আমরা করছি। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে করোনার বিরুদ্ধে আমাদের এই যুদ্ধ আরও দীর্ঘমেয়াদি হতে পারে।

এই যুদ্ধ জয়ের জন্য দরকার স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা, শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখা এবং দেশের প্রায় ৮০ শতাংশ মানুষকে টিকার আওতায় এনে হার্ড ইমিউনিটি তৈরি করা।

এই লক্ষে সরকার কাজ শুরু করেছে। গত বছর ‘বেক্সিমকো’ এর মধ্যস্থতায় সেরাম ইন্সটিটিউটের সঙ্গে অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার ৩ কোটি ডোজ টিকা ক্রয়ের চুক্তি সম্পাদন করে এবং অগ্রিম অর্থ পরিশোধ করে। চুক্তি মোতাবকে প্রথম চালান দেশে চলে আসে, শুরু হয় টিকা কার্যক্রম।

সম্প্রতি ভারতে করোনা পরিস্থিতির চরম অবনতি ও আমেরিকা কর্তৃক কাঁচামাল রপ্তানিতে নিষেধাজ্ঞা প্রয়োগ করায় (পরবর্তীতে শিথিল) সেরাম ইন্সটিটিউট থেকে অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা কোভিশিল্ড প্রাপ্তি অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়ে। এর ফলশ্রুতিতে সরকার টিকার প্রথম ডোজ প্রয়োগ স্থগিত ঘোষণা করে, দ্বিতীয় ডোজ প্রাপ্তি অনিশ্চিত হয়ে পড়ে প্রায় ১৪ লক্ষের বেশি মানুষের। সেরাম ইন্সটিটিউট তাদের প্রতিশ্রুত পরিমাণ টিকা সরবরাহ না করলে এই ১৪ লক্ষের বেশি জনগণের জন্য বিকল্প ব্যবস্থা কী, সে প্রশ্নটা ঘুরপাক খাচ্ছে।

অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা যদি দ্রুত সময়ে ব্যবস্থা করা না যায় সেক্ষেত্রে স্পুটনিক-ভি দ্বিতীয় ডোজ হিসেবে নেওয়া সময়ের দাবি।

টিকা প্রাপ্তির অনিশ্চয়তাকে আমলে নিয়ে সরকার বিকল্প উৎস থেকে অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা সংগ্রহের আপ্রাণ চেষ্টা করছে। পাশাপাশি দ্রুত সময়ের মধ্যে সকলের টিকা প্রাপ্তি নিশ্চিতকরণে সরকার জরুরি ভিত্তিতে দেশে রাশিয়ার স্পুটনিক-ভি ও চীনের সিনোফার্মের টিকা জরুরি ব্যবহারের অনুমতি প্রদান করেছে।

সরকারের দ্রুত পদক্ষেপের ফলশ্রুতিতে উপহার হিসেবে চীনের সিনোফার্মের টিকার ৫ লক্ষ ডোজ আমাদের হাতে পৌঁছেছে। প্রশ্ন হচ্ছে, যদি দ্রুততম সময়ে অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা সংগ্রহ করা না যায় সেক্ষেত্রে যে ১৪ লক্ষের বেশি মানুষের দ্বিতীয় ডোজ নেওয়া অনিশ্চিত, তাদের জন্য সুরাহা কী? এমতাবস্থায় টিকা মিক্সিং এর বিষয়টি সামনে চলে এসেছে।

টিকা মিক্সিং বলতে কী বুঝায়? সহজ কথায়, টিকা মিক্সিং হচ্ছে যারা অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার কোভিশিল্ড এর প্রথম ডোজ নিয়েছে তাদেরকে অন্য টিকা, যেমন স্পুটনিক-ভি দ্বিতীয় ডোজ হিসেবে দেওয়া যাবে কি না তাই জানা। টিকা মিক্সিং বিষয়ে কোনো ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল এখনও সম্পন্ন হয়নি। কিন্তু সম্প্রতি ফান্স, জার্মানি ও স্পেনে টিকা মিক্সিং এর বিষয়ে নীতিগত সিদ্ধান্ত হয়েছে বলে জানা যায়। ‘পাবলকি হেলথ ইংল্যান্ড’ এর বরাত দিয়ে ‘ব্রিটিশ মেডিকেল জার্নাল’ এ উল্লেখ করা হয় যে, খুব বিশেষ প্রয়োজনে টিকা মিক্সিং এর মতো বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া যেতে পারে।

বাংলাদেশে এই মুহূর্তে স্পুটনিক-ভি ও চীনের সিনোফার্মের টিকা প্রাপ্তির সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। সম্প্রতি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কর্তৃক সিনোফার্মের টিকা জরুরি ব্যবহারে অনুমোদন লাভ করেছে। আর স্পুটনিক-ভি এর তৃতীয় ধাপের ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল এর অন্তর্বর্তীকালীন একটি ফলাফল বিখ্যাত ল্যানসেট পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে।

প্রকাশিত নিবন্ধে এই টিকার কার্যকারিতা ৯০ শতাংশেরও বেশি বলে দাবি করা হচ্ছে যা কি না অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকার চাইতে বেশি কার্যকর। সবচেয়ে বেশি আশাব্যঞ্জক খবর হলো, স্পুটনিক-ভি দেশেই উৎপাদনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, আর ইতোমধ্যে ইনসেপ্টা, পপুলার এবং হেলথ কেয়ার এই তিনটি স্বনামধন্য ওষুধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান তাদের আগ্রহের বিষয়টি নিশ্চিত করছে। এখন অপেক্ষার পালা কোন প্রতিষ্ঠান রাশিয়া কর্তৃক অনুমোদন পায়। অনুমোদন পাওয়া গেলে স্পুটনিক-ভি এর বাল্ক প্রোডাক্ট এনে এখানে দ্রুত উৎপাদন করা সম্ভব।

আমাদের মত হলো, যেহেতু কোভিশিল্ড ও স্পুটনিক-ভি একই ধরনের ভেক্টর-বেজড ডিএনএ ভ্যাকসিন, সুতরাং ‘খুব বিশেষ প্রয়োজনে’ স্পুটনিক-ভি দ্বিতীয় ডোজ হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে।

অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা যদি দ্রুত সময়ে ব্যবস্থা করা না যায় সেক্ষেত্রে স্পুটনিক-ভি দ্বিতীয় ডোজ হিসেবে নেওয়া সময়ের দাবি। 

অন্যদিকে চীনের সিনোফার্ম টিকাটি নতুন নিবন্ধিত জনগণের মধ্যে প্রয়োগ করা যেতে পারে। অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকার সাথে মিক্সিং করে রাশিয়ার স্পুটনিক-ভি ভ্যাকসিনের ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল শুরু হয়েছে যার ফলাফল পেতে আমাদের আরও বেশ কিছুদিন অপক্ষো করতে হবে। ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের ফলাফলের উপর ভিত্তি করে টিকা মিক্সিং এর বিষয়ে সুনিশ্চিতভাবে মন্তব্য করা যাবে।

করোনা মহামারির শুরুর দিকে বিশেষ সংস্থাগুলো টিকা কেন্দ্রিক রাজনীতি না করার জন্য বিশ্বের উন্নত দেশগুলোর প্রতি বারবার আহ্বান জানিয়েছে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে, টিকা কেন্দ্রিক রাজনীতি দেশগুলোর মধ্যে বিভক্তি ছড়িয়েছে। টিকা উৎপাদনকারী দেশগুলোর টিকার ফর্মুলা গোপন রাখার একটি প্রয়াস দেখা যাচ্ছে, যা মহামারির এ সময়ে অনভিপ্রেত।

করোনা মহামারি একটি বৈশ্বিক সমস্যা, তাই এ থেকে রক্ষা পেতে হলে সকল দেশে এই টিকা নিশ্চিত করতে হবে। এজন্য প্রয়োজন টিকা উৎপাদনকারী ও উন্নত দেশগুলোর উদারনীতি গ্রহণ। অন্যথায় এ ধরনের দুর্যোগ মোকাবিলা করা সত্যিই কঠিন হবে।

(লেখার মূল ভাবনা, তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ ও বিশ্লেষণে সহযোগতিা করেছেন ড. আ.স.ম. মঞ্জুর আল হোসেন, সহকারী অধ্যাপক, ওষুধ প্রযুক্তি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।)

অধ্যাপক ড. ফিরোজ আহমেদ ।। চেয়ারম্যান, ফার্মেসি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়