এই তো মাস পেরোল মাত্র। মিরপুরের মিডিয়া ব্লকে আম্পায়ার কমিটির আয়োজনে প্রথমবারের মতো সার্টিফিকেট দেওয়া হচ্ছে নানা জায়গা থেকে পরীক্ষা দিয়ে বৈতরণী পার হওয়া নতুন আম্পায়ারদের। এর মধ্যে বাংলাদেশের ব্লেজার পরা কয়েকজন নারীও আছেন!

এই ব্লেজার আবার সাধারণ কোনো ব্লেজার নয়; বুক পকেটে বিসিবির বাঘটাও আছে। সেই ব্লেজার পরা নারীদের একজন হলেন শারমীন আক্তার সুপ্তা। যতদূর মনে পড়ে অনেক নম্বর নিয়েই উত্তীর্ণদের তালিকায় ছিলেন তিনি।

নতুন দিনের আম্পায়ার, ভবিষ্যৎ তৈরি করা সুপ্তাকে নিয়ে ফিসফিসানি উঠেই গিয়েছিল। তবে কি তার ক্রিকেট ক্যারিয়ার শেষ? না, সেটা হয়নি। গল্পের মজাটা এখানেই।

অনেকটা নাটকের পাণ্ডুলিপিতে ভীষণ ঝড় তুলে দেওয়া চরিত্রের আগমনের মতো শারমীন সুপ্তার প্রত্যাবর্তন। দেড় বছর পর তার জাতীয় দলের হয়ে খেলাটা বেশ নাটকীয় বটে।

নারীদের ক্রিকেটে যে সাফল্য সেটা পুরুষ ক্রিকেটের তুলনায় কোনো অংশে তো কমই নয়। বরং বেশি...

আম্পায়ার হতে চাওয়ার ইচ্ছের সঙ্গে এই ব্যাটারের ব্যাটের দূরত্ব তৈরি হয়নি। শারমীন সুপ্তা অ্যাম্পায়ারের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে আছেন কিন্তু ক্রিকেটার হিসেবে এখনো নিজেকে মাঠেই দেখেন। তাই দেড় বছর পর জাতীয় দলে আরেকবার সুযোগ পেয়ে ব্যাটের সঙ্গে তার সখ্যতার গল্পটা নতুন করে জানিয়ে দিলেন।

আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে ফিরে এসেই দাপুটে পারফরর্ম্যান্সে টপ অর্ডারের দায়িত্ব নিয়ে সামাল দিলেন চমৎকারভাবে। অথচ যে ম্যাচ অফিসিয়াল হওয়ার লক্ষ্য সুপ্তার তেমনই একজন সিরিজ জুড়ে সুপ্তা দুর্দান্ত পারফরর্ম্যান্স করার পরও ফারাজানা হক পিংকিকে বেছে নিলেন সিরিজ সেরা হিসেবে!

অবশ্য, সিরিজ জুড়ে আদতে দল হিসেবে খেলায় জুরি বোর্ডের পক্ষেও বেছে নেওয়া মুশকিল হয়ে গিয়েছিল- কাকে রেখে, কাকে সামনে আনেন। তাতে ফিরে আসার সিরিজে সুপ্তার মন খারাপ হয়নি।

নারীদের ক্রিকেটে যে সাফল্য সেটা পুরুষ ক্রিকেটের তুলনায় কোনো অংশে তো কম নয়ই, বরং বেশি। সম্প্রতি যদিও নিগার সুলতানা জ্যোতির দলে একটু ভাটার টান। ওপরের ব্যাটাররা রান দিতে পারছিলেন না। নাহিদাদের স্পিনটাও খুব বেশি বাঁক নিচ্ছিল না।

পরিস্থিতি এমন এক জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছিল যে, ২০২৫ সালে ভারতের মাটিতে ওয়ানডে বিশ্বকাপ খেলাতে গেলে অনেকগুলো শর্তপূরণের বেড়াজালে আটকে ছিল বাংলাদেশ। সেই শর্তের একটি পূরণ হয়ে গেল, পাওয়া গেল এক ধরনের আত্মবিশ্বাস এই আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে জয়ে।

তিন ম্যাচের সবগুলো জয়ের কারণে চলতি বছরে নিজেদের শেষ তিন ওয়ানডের দুটিতে জয়ের সমীকরণের সামনে দাঁড়িয়ে জ্যোতিরা। সেটা হলেই মিলে যাবে বিশ্বকাপের টিকিট।

তাই আইরিশ নারীদের বিপক্ষে জয়টাকে ছোট করে দেখার কোনো অবস্থা নেই। একইভাবে কাম-ব্যাক সিরিজে দুটি ফিফটিতে করা (১ম ওয়ানডেতে ৯৬, ২য় ওয়ানডেতে ৭২) সুপ্তার মোট ২১১ রানকেও আনতে হচ্ছে সবার আগে।

যে নারীর ব্যাটিং গড় ৭০.৩৩ তাকে তো আলোচনায় না এনে উপায় নেই। ফারাজানা হকের ২০২৩ সালের ভারতের বিপক্ষে এক সিরিজে সর্বোচ্চ ১৮১ রানকে পেছনে ফেলাটাও নতুন মাইলফলক। 

এই ফারাজানাও আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে দারুণ ফর্মে। টানা তিন ফিফটিতে ১৭২ রান। ওই যে লিখলাম, জুরি বোর্ডকে হিমশিম খেতে হয়েছে সেরা ক্রিকেটার বেছে নিতে, তার কারণ ফারজানার দুর্দান্ত ধারাবাহিকতা।

পুরো সিরিজ জুড়েই কে কাকে ছাড়িয়ে যাবে তা নিয়ে একরকম প্রতিযোগিতা হয়েছে বাংলাদেশের নারী ক্রিকেটারদের মধ্যে। সামনের কঠিন পরীক্ষার আগে নিজেদের চাঙা রাখার জন্য আয়ারল্যান্ডের মতো সহজ প্রতিপক্ষের সঙ্গে এমন ‘রেজাল্ট’ আসলে বাড়াবাড়ি রকমের অর্জন নয়। বরং এটাই প্রত্যাশিত।

সুলাতানা খাতুনের সাত উইকেটের পাশে নাহিদা আক্তারের ছয় উইকেটে আয়ারল্যান্ডের অবস্থা নাজেহাল হয়ে গেছে পুরো সিরিজে। আবার চাপ তৈরি করে ভয়ংকর মিতব্যয়ী বোলিংয়ে সুলতানাকে (২.৯১) টেক্কা দিয়েছেন স্বর্ণা আক্তারও (২.৬৩)।

পুরো সিরিজ জুড়েই কে কাকে ছাড়িয়ে যাবে তা নিয়ে একরকম প্রতিযোগিতা হয়েছে বাংলাদেশের নারী ক্রিকেটারদের মধ্যে...

সব মিলিয়ে বাংলাদেশ নারী ক্রিকেট দলটি এখন এক সুখী পরিবার। সামনে আইরিশদের বিপক্ষে টি-টোয়েন্টি সিরিজে তারাই স্পষ্ট ফেভারিট। কিন্তু সেসব ছাপিয়ে তাদের দৃষ্টি ২০২৫ সালের শুরুতে ক্যারিবীয় নারীদের বিপক্ষে তাদের মাটিতেই হতে যাওয়া ওয়ানডে সিরিজের দিকে।

সেখানে দুটি ম্যাচ জিতলে বিশ্বকাপে খেলাটা নিশ্চিত হয়ে যাবে। কঠিন সফর, এ বিষয়ে সন্দেহ নেই। প্রায় অসম্ভব ছুঁই ছুঁই লক্ষ্য জ্যোতিদের সামনে। ওয়েস্ট ইন্ডিজের মাটিতে খেলা বলেই নয়, নারীদের ক্রিকেটে বিশ্বের অন্যতম কঠিন প্রতিপক্ষ এই ক্যারিবিয়ানরাই।

কঠিনেরে ভালোবাসা ছাড়া উপায়ও জানা নেই জ্যোতি-সুপ্তাদের। পুরুষ ক্রিকেটারদের মতো তাদেরও টপ অর্ডারের ধারাবাহিক ব্যর্থতার বোঝা। যদিও সেটা এই আইরিশ সিরিজ দিয়ে কাটিয়ে ওঠার ইঙ্গিত মিলেছে।

পুরুষ ক্রিকেটারদের মতোই তাদের স্পিনটা ভালো। পুরুষ ক্রিকেটাররা এখন যে অস্থির সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, সেটা এই মুহূর্তে নারী ক্রিকেটারদের মধ্যে অনুপস্থিত। পার্থক্যটা এখানেই।

পুরো দলটাকে মনে হচ্ছে অনেক সাজানো গোছানো, যেন একটা ফুলের বাগান। সেই বাগানের ফুল ক্যারিবীয় দ্বীপপুঞ্জে সৌরভ ছড়িয়ে দিক, এটাই আপাতত চাওয়া।

বর্ষণ কবির ।। ক্রীড়া সাংবাদিক