ছবি : সংগৃহীত

বিশ্বের বহু দেশ আছে যেখানে নির্বাচন নিয়ে কোনো আলোচনা-সমালোচনা সামনে আসে না। নীরবে-নিভৃতে গ্রহণযোগ্য মানের নির্বাচন হওয়ার দৃষ্টান্ত রয়েছে পৃথিবীর বহু দেশে। যেমন নিউজিল্যান্ড নিয়ে বহির্বিশ্বে তেমন একটা আলোচনা হয় না। নিউজিল্যান্ড এমন একটি দেশ যেখানে সবকিছু চলছে স্বাভাবিক নিয়মে। কীভাবে নির্বাচন কমিশন নিয়োগ হলো, কে নিয়োগপ্রাপ্ত হলো, কে নাম প্রস্তাব করলো—এসব নিয়ে কোনো মাথাব্যথা নেই।

নির্বাচন কমিশন গঠনের জন্য গভর্নর জেনারেল একক সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকেন। কাকে অ্যাপয়েন্টমেন্ট করতে হবে এবং কীভাবে গঠন করবেন কমিশনের সিদ্ধান্ত। সে অনুযায়ীই তাদের নির্বাচন কমিশন গঠন করা হয়। তাদের নির্বাচন নিয়ে আলোচনায় সবার আগে আসে ভোটাধিকারের কথা। হ্যাঁ, দেশটিতে সব নাগরিক, নারী-পুরুষ নির্বিশেষে নিঃসংকোচে তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারেন।

ভোটাধিকার প্রয়োগে বাধা দেওয়ার ঘটনা কিংবা ভোট গ্রহণযোগ্য হবে কি হবে না—সেটি নিয়ে আলোচনা নেই। এখানে একটি কথা উল্লেখ করতেই হয়, তা হলো নারীর ভোটাধিকার নিশ্চিতে সবচেয়ে এগিয়ে আছে দেশটি। কারণ নিউজিল্যান্ডই বিশ্বে প্রথম দেশ হিসেবে নারীর ভোটাধিকার নিশ্চিত করেছিল ১৮৯৩ সালে।

নিউজিল্যান্ডের পদাঙ্ক অনুসরণ করে ১৮৯৪ সালে দক্ষিণ অস্ট্রেলিয়ার নারীরা ভোটাধিকার লাভ করে। ব্রিটেনের নারীরা ভোটাধিকার পায় ১৯১৮ সালে, আমেরিকায় ১৯২০ সালে। আর অবিভক্ত বাংলার নারীরা ভোটাধিকার পায় ১৯৩৫ সালে। আর সবশেষে ২০১৫ সালে সৌদি আরবের নারীরা প্রথমবারের মতো পৌরসভা নির্বাচনে ভোট দেওয়ার সুযোগ পান।

নিউজিল্যান্ডে নির্বাচন উপলক্ষে কোনো মিছিল, মিটিং, মাইকিং, স্লোগান এসব কিছুই হয় না। শুধু টেলিভিশন, খবরের কাগজে কিছু আলোচনা, বিতর্ক আর রাস্তার কোথাও কোথাও থাকে প্রার্থীদের প্ল্যাকার্ড। সাধারণ প্রার্থী থেকে শুরু করে প্রধানমন্ত্রী পর্যন্ত সব প্রার্থীই নিজের হাতে সীমিত আকারে লিফলেট বিতরণ করেন।

নির্বাচনী সমাবেশ দু’একটি হলেও তা হয় নির্দিষ্ট কোনো জায়গায়। এক্ষেত্রে কারও কোনো কষ্টের উদ্রেক না করে প্রচারণা চলতে থাকে। সেখানে নির্বাচন পরিচালনাকারী সংস্থা নিজেদের দায়িত্বশীল ভূমিকায় রেখে ন্যায্যতার মাপকাঠিতে কাজ করেন। এ জন্য তাদের নির্বাচন পরিচালনাকারী সংস্থাকে রোল মডেল হিসেবে চিহ্নিত করা যায়।

সরাসরি ছাড়াও দুটি মজার ভোট দেওয়ার ব্যবস্থা রয়েছে ব্রিটেনে। কোনো ভোটার যদি ভোট কেন্দ্রে গিয়ে ভোট দিতে না পারেন, তবে ডাক বিভাগের মাধ্যমে বিশ্বের যেকোনো জায়গা থেকে তার ভোট পৌঁছে দিতে পারেন নির্বাচন কমিশনে।

ত্রয়োদশ শতকে ইংল্যান্ডে সংসদীয় ব্যবস্থা গড়ে ওঠার মধ্য দিয়ে আধুনিক নির্বাচনী প্রক্রিয়ার শুরু। সেখানে নির্বাচন কমিশন অত্যন্ত ন্যায্যতার মাপকাঠিতে দায়িত্ব পালন করেন। ব্রিটেনের পার্লামেন্টের আপার হাউস বা উচ্চকক্ষকে বলা হয় হাউস অব লর্ডস। লোয়ার হাউস বা নিম্নকক্ষ যাকে বলা হয় হাউস অব কমন্স।

হাউস অব কমন্সের সদস্যরা নির্বাচিত হন সাধারণ ভোটারদের ভোটে। তবে, উচ্চকক্ষের সদস্যরা নির্বাচিত হন বংশগত যোগ্যতায় অথবা সরকারের মনোনয়নে। তাদের কোনো প্রস্তাব পাসের আগে পুনর্বিবেচনার জন্য নিম্নকক্ষে পাঠানো ছাড়া তেমন কোনো ক্ষমতা থাকে না।

গোটা ব্রিটেনকে মোট ৬৫০টি নির্বাচনী এলাকায় ভাগ করে অনুষ্ঠিত হয় নির্বাচন। এলাকাগুলো ছোট বড় যাই হোক, সেগুলোর প্রতিটিতে ৬০ হাজার থেকে ৮০ হাজার ভোটার রয়েছে। অন্যদিকে, প্রার্থী হতে হলে, তার বয়স ১৮ বছরের বেশি এবং ব্রিটিশ, আইরিশ কিংবা কমনওয়েলথভুক্ত কোনো দেশের নাগরিক হতে হয়।

সরাসরি ছাড়াও দুটি মজার ভোট দেওয়ার ব্যবস্থা রয়েছে ব্রিটেনে। কোনো ভোটার যদি ভোট কেন্দ্রে গিয়ে ভোট দিতে না পারেন, তবে ডাক বিভাগের মাধ্যমে বিশ্বের যেকোনো জায়গা থেকে তার ভোট পৌঁছে দিতে পারেন নির্বাচন কমিশনে। মনোনীত ব্যক্তির মাধ্যমেও, ভোট দেওয়া যায়। এক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশনের ভূমিকা খুবই প্রশংসনীয়।

নির্বাচন কমিশন যেরূপভাবে চান ঠিক সেভাবেই প্রশাসন ভূমিকা পালন করে থাকে। বিশ্বের অনেক দেশের মতোই ব্রিটেনে নির্বাচনের সময় ক্ষমতাসীন প্রধানমন্ত্রীই দায়িত্ব পালন করেন। অর্থাৎ নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কোনো ব্যবস্থা ব্রিটিশ সংবিধানে নেই। সেখান রাজনৈতিক দল এবং জনগণের মানসিকতা এভাবেই গড়ে উঠেছে। ক্ষমতা আঁকড়ে থাকার মানসিকতা কোনো রাজনৈতিক দল বা রাজনৈতিক নেতার নেই।

অস্ট্রেলিয়াতেও গভর্নর জেনারেল অব অস্ট্রেলিয়া এককভাবে সিদ্ধান্ত নেন নির্বাচন কমিশনে কারা থাকবেন। কিন্তু এ বিষয়ে কোনো প্রশ্ন ওঠা দূরে থাক বরং সবার আস্থা প্রতিফলিত হয় নির্বাচন কমিশনের কার্যক্রম এবং যৌক্তিক দায়িত্বশীল আচরণের জন্য।

কয়েকদিন আগেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ভোট গ্রহণ শেষ হয়েছে। আগাম ভোট দিয়ে নির্বাচন শুরু হয়। তবে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ভোট গ্রহণ ও গণনার প্রক্রিয়া একটু আলাদা। মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে নির্দিষ্ট দিনে সরাসরি ভোটের পাশাপাশি ভোটাররা ই-মেইল ও ডাকযোগেও ভোট দিতে পারেন। এমনকি নির্বাচনের জন্য নির্ধারিত দিনের আগেও সরাসরি ভোট দেওয়া যায় নির্দিষ্ট পোলিং বুথে।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল নির্বাচন কমিশন থাকলেও কোনো কেন্দ্রীয় নির্বাচনব্যবস্থা নেই। যুক্তরাষ্ট্রে ফেডারেল নির্বাচন কমিশন কেন্দ্রীয় নির্বাচনী তহবিল আইন প্রয়োগ করে। এটি নির্বাচনী তহবিল, অনুদান ও প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের জন্য সরকারি তহবিল ব্যবস্থাপনা করে।

তবে নির্বাচন পরিচালনার দায়িত্ব থাকে স্থানীয় আরও স্পষ্ট করে বললে সংশ্লিষ্ট অঙ্গরাজ্যের কর্তৃপক্ষের হাতে। এই কর্তৃপক্ষগুলো স্থানীয়, রাজ্য এবং ফেডারেল আইন মেনে চলে। একই সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানও তাদের নির্দেশনা দেয়। ফলে নির্বাচনী নিয়মাবলি রাজ্যভেদে ভিন্ন হয়ে থাকে। যুক্তরাষ্ট্রে ভোট দেওয়া বাধ্যতামূলক নয়। মেইল বা ডাকযোগে ভোট দেওয়া গেলেও দেশটিতে অনলাইনে ভোট দেওয়ার কোনো ব্যবস্থা নেই।

বাংলাদেশের মতোই দেশটির বিভিন্ন অঙ্গরাজ্যের প্রত্যেক ভোটারের জন্য নির্দিষ্ট ভোটকেন্দ্র বরাদ্দ করা হয়। এসব কেন্দ্র সাধারণত সরকারি ভবন, যেমন কনভেনশন সেন্টার, লাইব্রেরি, স্কুল বা কমিউনিটি সেন্টারে স্থাপন করা হয়ে থাকে। ভোটাররা এসব কেন্দ্রে গোপন বুথে গিয়ে ব্যালট পূরণ করেন। আরও অনেক পদ্ধতিতে খুব ন্যায্যভাবে ভোট গ্রহণের প্রক্রিয়া থাকলেও সেখানে নানা ধরনের সমস্যার কথাও শোনা যায়।

আমাদের পাশের দেশ ভারত, সেখানকার রাজনৈতিক কৃষ্টি ও সংস্কৃতি আমাদের কাছাকাছি। আয়তন ও জনসংখ্যার বিচারে ভারত বৃহত্তম গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র। সেখানে নির্বাচন প্রক্রিয়ায় বেশকিছু অভিনবত্ব রয়েছে। নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ অনেকটা আমাদের মতোই। প্রধানমন্ত্রীর দফতরের পরামর্শ অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি নিয়োগ দিয়ে থাকেন।

যুক্তরাষ্ট্রে ভোট দেওয়া বাধ্যতামূলক নয়। মেইল বা ডাকযোগে ভোট দেওয়া গেলেও দেশটিতে অনলাইনে ভোট দেওয়ার কোনো ব্যবস্থা নেই।

ভারতের সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার টি এন সেশন (১৯৯০ থেকে ১৯৯৬) ভারতের নির্বাচনের সংস্কৃতিতে আমূল পরিবর্তন নিয়ে আসেন। অনেকে তাকে ‘চেঞ্জ মেকার’ বা পরিবর্তনের রূপকার হিসেবে অভিহিত করেন। ভারতের সংবিধানের ৩২৪ অনুচ্ছেদ রাষ্ট্রপতিকে তার বিবেচনার ভিত্তিতে একটি নির্বাচন কমিশন নিয়োগের ক্ষমতা প্রদান করে। কমিটির সদস্য সংখ্যা এবং তাদের মেয়াদ কত হবে তা নির্দিষ্ট করা হয়নি।

নির্বাচন কমিশন (নির্বাচন কমিশনারদের চাকরির শর্তাবলি এবং ব্যবসার লেনদেন) আইন ১৯৯১ সিইসি এবং নির্বাচন কমিশনারদের মেয়াদ ছয় বছর বা ৬৫ বছর বয়স পর্যন্ত সীমাবদ্ধ করে। সিইসিকে শুধু সুপ্রিম কোর্টের বিচারকের মতো একই কারণে রাষ্ট্রপতি পদ থেকে বরখাস্ত করতে পারেন। সিইসি রাষ্ট্রপতির কাছে সুপারিশ করলে অন্য নির্বাচন কমিশনারদের বরখাস্ত করা হতে পারে। ইসি প্রার্থীদের নাম প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রিপরিষদ রাষ্ট্রপতির কাছে পাঠান।

সম্প্রতি বাংলাদেশে নতুন নির্বাচন কমিশন নিযুক্ত হয়েছে। তাদের কাছে আমাদের প্রত্যাশা অনেক। আমরা আশা করবো বিশ্বের বুকে নির্বাচনী রোল মডেল হিসেবে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা পাবে। বাংলাদেশ সংবিধানের ১২৬ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব পালনে সহায়তা করা সকল নির্বাহী কর্তৃপক্ষের কর্তব্য হইবে।’

আবার সংবিধানের ১২০ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, নির্বাচন কমিশনের ওপর ন্যস্ত দায়িত্ব পালনের জন্য যেরূপ কর্মচারীদের প্রয়োজন হইবে, নির্বাচন কমিশন অনুরোধ করিলে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন কমিশনকে সেইরূপ কর্মচারী প্রদানের ব্যবস্থা করিবেন।’ কাজেই নির্বাচন কমিশনই প্রশাসনকে ঢেলে সাজিয়ে একটি সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের আয়োজন করতে পারে।

মূলত নির্বাচন কমিশন এবং প্রশাসনের ভূমিকার ওপরই সুষ্ঠু নির্বাচনের সম্পর্ক রয়েছে। কমপক্ষে জনগণের ভোটাধিকার প্রয়োগে আস্থার পরিবেশ তৈরির ভিত্তি হিসেবে হলেও এই নির্বাচনটি সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও অবাধ হওয়ার কোনো বিকল্প নেই।

ড. সুলতান মাহমুদ রানা ।। অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
sultanmahmud.rana@gmail.com