মিডিয়া ট্রায়াল কি চলবেই?
দুটি প্রশ্ন দিয়ে আলোচনা শুরু করা যাক...
এক. মিডিয়া ট্রায়াল কেন হয়? উত্তর সহজ। বিচারিক কার্যক্রমে দীর্ঘসূত্রিতা ও আস্থাহীনতা এর প্রধান কারণ। যে প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ তথা তৃতীয় বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশের গণমাধ্যম নিজেরা এক ধরনের ‘ট্রায়ালে’র দিকে ঝুঁকে পড়ে।
বিজ্ঞাপন
দুই. মিডিয়া ট্রায়াল কেন ক্ষতিকর? উত্তর- এর মাধ্যমে মুহূর্তেই একজন মানুষের আজীবন অর্জিত সুনাম ভূ-লুণ্ঠিত হতে পারে। ধ্বংস হতে পারে পেশাগত জীবন। বিভীষিকাময় হয়ে উঠতে পারে সামাজিক সম্পর্কগুলো।
মিডিয়া ট্রায়ালের মাধ্যমে একজন মানুষের স্বাভাবিক জীবনেও ছন্দপতন ঘটতে পারে। বিঘ্নিত হতে পারে কোনো ব্যক্তি বা তার পরিবারের সদস্যদের নিরাপত্তা।
তথ্য প্রযুক্তির বিকাশ ও ইন্টারনেটের প্রসার মিডিয়া ট্রায়াল প্রবণতাকে আরও প্রবল করেছে। সাথে যুক্ত হয়েছে ডিসইনফরমেশন, ডিপফেকসহ নানা অনুষঙ্গ। তবে সুষ্ঠু সাংবাদিকতার ধারা বজায় রাখতে গণমাধ্যমের নেতিবাচক এই চর্চা অবশ্যই পরিহার করতে হবে। পুরোপুরি বন্ধ করতে না পারলেও অন্তত আন্তরিকভাবে মিডিয়া ট্রায়াল রুখে দেওয়ার চেষ্টা করতে হবে।
আরও পড়ুন
একটু পেছনে ফিরি। প্রতিহিংসা, প্রতিশোধ মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি। মানুষ সবসময় প্রতিশোধ নিতে চায়। শত্রুকে যেকোনো মূল্যে পরাজিত ও নিশ্চিহ্ন করতে চায়। যে কারণে হাতের কাছে মানুষ যা পায় তাই ব্যবহার করে। এক্ষেত্রে গণমাধ্যমও ব্যবহৃত হয়েছে আদি কাল থেকেই।
ভারতবর্ষে ১৭৮০ সালে প্রথম সংবাদ প্রকাশ করেছিলেন আইরিশ নাগরিক জেমস অগাস্টাস হিকি (James Augustus Hicky)। তার বেঙ্গল গ্যাজেট (Hicky's Bengal Gazette) বা ক্যালকাটা জেনারেল এ্যাডভারটাইজার-এর প্রধান লক্ষ্য ছিল সেই সময়ের বড় লাট ওয়ারেন হেস্টিংস (Warren Hastings)। যার সাথে হিকির স্বার্থগত সংঘাত ছিল। যে কারণে হিকি যা ইচ্ছে তা লিখতেন হেস্টিংস, তার স্ত্রী ও বিচারক এলিজা ইম্পে (Elijah Impey)-এর বিরুদ্ধে। হিকির লেখানীতে তারা সমকামী বলেও আখ্যায়িত করা হয়েছিল।
মিডিয়া ট্রায়ালের মাধ্যমে একজন মানুষের স্বাভাবিক জীবনেও ছন্দপতন ঘটতে পারে। বিঘ্নিত হতে পারে কোনো ব্যক্তি বা তার পরিবারের সদস্যদের নিরাপত্তা।
একটা ব্রিটিশ প্রবাদ এখানে প্রাসঙ্গিক। প্রবাদে বলা হয়েছে, তুমি যদি কোনো একটা কুকুরকে হত্যা করতে চাও তাহলে তার একটা খারাপ নাম দাও (‘If you want to kill a dog, you start by giving it a bad name’)। অর্থাৎ কাউকে হত্যা, ধ্বংস করতে চাইলে তাকে একটা খারাপ, ঘৃণিত নাম দিতে হবে। যা বাংলাদেশের গণমাধ্যমে চলে আসছে দীর্ঘদিন ধরে।
কীভাবে এলো ‘মিডিয়া ট্রায়াল’ শব্দযুগল
সাধারণত খুব চাঞ্চল্যকর কোনো ঘটনা বা কোনো বিখ্যাত-কুখ্যাত ব্যক্তি বা সংশ্লিষ্ট ঘটনায় মিডিয়া ট্রায়াল হয়ে থাকে। বাংলাদেশে মিডিয়া ট্রায়ালের বড় একটি টেস্ট কেস আলোচিত সাংবাদিক দম্পতি সাগর সরওয়ার ও মেহেরুন রুনি হত্যাকাণ্ড। অমীমাংসিত এই হত্যা রহস্য নিয়ে কতজন যে মিডিয়া ট্রায়ালের শিকার হয়েছেন তার কোনো হিসাব নেই।
তবে গণমাধ্যম পরিসরে এই শব্দযুগলের ব্যবহার শুরু হয় ষাটের দশকে। সে সময় টেলিভিশন ছিল খুবই শক্তিশালী মাধ্যম। সাংবাদিকরাও সমাজে সম্মানিত ও প্রভাবশালী ছিলেন। একজন সাংবাদিকের প্রতিবেদন ও উপস্থাপনার ওপর ভিত্তি করে জনমত গঠিত হতো।
এমনই প্রেক্ষাপটে ১৯৬৭ সালের ৩ ফেব্রুয়ারি বিশ্বখ্যাত সাংবাদিক ডেভিড ফ্রস্ট ইনস্যুরেন্স ব্যবসায়ী এমিল সাভুনড্রার (Emil Savundra) একটি সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন। এই অনুষ্ঠানে তার সাথে ফ্রস্ট্রের বেশ বাদানুবাদ হয়। পরে আইটিভি’র (ITV) নির্বাহী প্রশ্ন তুলেছিলেন এই অনুষ্ঠানের কারণে এমিল সাভুনড্রার বিচার প্রভাবিত হতে পারে।
ওই সময় অনিয়ম ও তহবিল তছরুপে অভিযোগে আদালতে এমিল সাভুনড্রার বিচার চলছিল। এরপর দেখা গেছে খুবই সংবেদনশীল মামলার ক্ষেত্রে গণমাধ্যম একটি বিশেষ রায়ের পক্ষে এক ধরনের পরিস্থিতি তৈরি করে। যাতে বাধাগ্রস্ত হয় ন্যায়বিচার।
মিডিয়া ট্রায়াল নিয়ে ভারতে গুরুত্বপূর্ণ কিছু কাজ হয়েছে। অনেক ভুক্তভোগী বিষয়টি নিয়ে আদালতের দ্বারস্থ হয়েছিলেন। ফলে ভারতের বিচার বিভাগ এ বিষয়ে পরিষ্কার একটি সংজ্ঞা নির্ধারণ করেন। ভারতের সুপ্রিম কোর্টের ব্যাখ্যা অনুযায়ী মিডিয়া ট্রায়াল হলো—‘the impact of the television and newspaper coverage on a person's reputation by creating a widespread perception of guilt regardless of any verdict in a court of law.’
আরও পড়ুন
সহজ কথায়, মিডিয়া ট্রায়াল হলো সংবাদপত্র ও টেলিভিশনের কাভারেজের ফল। যার মাধ্যমে কোনো বিচারিক আদালতের রায়ের আগেই একজন ব্যক্তিকে সম্ভব্য দোষী আখ্যায়িত করে তার সুনাম ক্ষুণ্ন করা হয়। মিডিয়া ট্রায়ালের মাধ্যমের একজন ব্যক্তির জীবনযাপন করা অনেক কঠিন হয়ে যায়। এই ধরনের বিচার উচ্ছৃঙ্খল মানসিকতাকে (mob mentality) উৎসাহিত করে।
সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশের গণমাধ্যমে এই নেতিবাচক চর্চা বিদ্যমান। শেখ হাসিনার ১৫ বছরের শাসন আমলে দুর্নীতি হয়েছে। সেইসব অভিযোগ এখনো প্রমাণিত হয়নি কিন্তু গণমাধ্যম ট্রায়ালের মাধ্যমে দুর্নীতিবাজ প্রমাণিত করে দেওয়া হয়েছে। বর্তমানে ড. মুহম্মদ ইউনূসের অন্তর্বর্তী সরকারের সময় দেখছি ফ্যাসিবাদী, ফ্যাসিস্ট ও ফ্যাসিবাদের দোসর শব্দের অতি ব্যবহার। যা নিশ্চিতভাবেই মিডিয়া ট্রায়াল।
গণমাধ্যম নীতির ন্যূনতম মানদণ্ড হলো বিচারের পূর্বে, দোষী সাব্যস্ত হওয়ার আগে কাউকে কোনো নেতিবাচক অভিধায় অভিযুক্ত করা যাবে না। এমনকি বিচারে প্রমাণিত হওয়ার আগে দুর্নীতিবাজ বলাও মিডিয়া ট্রায়াল। যদিও বাংলাদেশসহ ভারতবর্ষে এর বহুল ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়।
গণমাধ্যম নীতির ন্যূনতম মানদণ্ড হলো বিচারের পূর্বে, দোষী সাব্যস্ত হওয়ার আগে কাউকে কোনো নেতিবাচক অভিধায় অভিযুক্ত করা যাবে না। এমনকি বিচারে প্রমাণিত হওয়ার আগে দুর্নীতিবাজ বলাও মিডিয়া ট্রায়াল।
১৭ অক্টোবর ২০২৪ বাংলাদেশের প্রথম সারির দৈনিক ইত্তেফাক সংবাদ প্রকাশ করেছে—‘আওয়ামী জোটের নেতা মেননের ২৫ হাজার কোটি টাকার সম্পদ’। এই সংবাদ পুরোটা পাঠ করার পর জানা যায়, এটা একটা অভিযোগ। যার পেছনে কোনো নির্ভরযোগ্য তথ্যসূত্র নেই। ওয়ার্কার্স পার্টির রাশেদ খান মেনন আওয়ামী লীগ আমলে কয়েক দফায় মন্ত্রী ছিলেন। তার বিরুদ্ধে অনিয়ম, দুর্নীতির অনেক অভিযোগ আছে। কিন্তু ২৫ হাজার কোটি টাকা!
বাংলাদেশের বাস্তবতায় তা রীতিমতো অসম্ভব। এমন সেনসেশান তৈরির সংবাদ এরইমধ্যেই রাশেদ খান মেননকে দুর্নীতিবাজ বলে জনসম্মুখে তুলে ধরেছে। একইসাথে তিনি যে সর্বোচ্চ শাস্তি পাওয়ার যোগ্য সেটার পক্ষেও জনমত তৈরি করেছে। যা কাম্য নয়।
দেশের টেলিভিশনগুলো এর বাইরে নয়। বরং কিছু টেলিভিশন ছিল আরও এক ধাপ এগিয়ে। শেখ হাসিনার আমলে একাত্তর টিভি ছিল এককাঠি সরেস। একাত্তর জার্নাল নামের সংবাদ বিশ্লেষণধর্মী অনুষ্ঠানকে অনেক সময় মনে হতো একাত্তর টিভির আদালত। এই অনুষ্ঠানে কত মানুষকে যে ট্যাগ দেওয়া হয়েছে বা অন্য আলোচকরা ট্যাগ দিয়েছেন, যেটা উপস্থাপক অনুমোদন করেছেন তার কোনো হিসাব নেই। অন্যান্য টিভিও এর বাইরে ছিল না।
এখনো যে এই অবস্থার পরিবর্তন ঘটেছে তা কিন্তু নয়। বরং বিভিন্ন বাস্তবতায় বলা যায় এখনো মিডিয়া ট্রায়ালের পরম্পরা চলছে। নেতিবাচক থেকে রক্ষা পেতে প্রথমেই প্রয়োজন মিডিয়া ট্রায়াল ও গণমাধ্যমের স্বাধীনতার সীমারেখা সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা থাকা। মনে রাখা প্রয়োজন বিচারিক প্রক্রিয়া ও গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশের প্রক্রিয়া সম্পূর্ণ আলাদা, স্বতন্ত্র। বিচারিক প্রক্রিয়ায় কোনো প্রভাব থাকা উচিত নয়। যদিও সংবাদমাধ্যমের নানাভাবে প্রভাবিত হওয়ার সুযোগ থাকে।
এছাড়া গণমাধ্যমের একটি বড় লক্ষ্য থাকে জনমত তৈরি, সম্মতি তৈরি। আর বিচারিক আদালতের লক্ষ্য অপরাধের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রদানের পাশাপাশি অভিযুক্ত বা সম্ভব্য অপরাধীর সর্বোচ্চ সুরক্ষা। বাংলাদেশের গণমাধ্যমে মিডিয়া ট্রায়ালের চর্চা বন্ধ হোক।
রাহাত মিনহাজ ।। সহকারী অধ্যাপক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়
minhaz_uddin_du@yahoo.com