ছবি : সংগৃহীত

অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের ১০০ দিন পেরিয়েছে। মুক্তির আনন্দের সাথে গগনচুম্বী স্বপ্ন নিয়ে এসেছিল এবারের বর্ষা। যে শ্রমিক জীবন দিয়েছেন, হয়তো তিনি ভেবেছিলেন মুক্ত বাংলাদেশে তার সন্তান অনাহারে থাকবে না। যে নারী রাস্তায় নেমে সমান তালে লড়েছেন পুরুষের পাশাপাশি, জীবন দিয়েছিলেন যাদের অনেকে, তারা কি এমন এক সমাজের স্বপ্ন দেখেননি, যেখানে তাদেরও মাথা উঁচু করে বাঁচার অধিকার থাকবে?

পাহাড় কিংবা সমতল থেকে যে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর সদস্যরা এসে দাঁড়িয়েছিলেন জুলাইয়ের রক্তস্নাত রাজপথে, তারাও কি সমান অধিকারের স্বপ্ন দেখেননি? মাদ্রাসার যে শিক্ষার্থী লড়াইয়ে মাঠে এসে দাঁড়িয়েছিল ইংরেজি মাধ্যমে পড়া শিক্ষার্থীর পাশে, তারাও কি সমাজে সমান সুযোগ আর অধিকার পাওয়ার স্বপ্ন দেখেননি?

জুলাই অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে বিস্মৃতি আর অবহেলার অন্তরাল থেকে কাজী নজরুল ইসলামকে নতুন করে তুলে ধরা হয়েছে আমাদের সামনে। এদেশের তারুণ্যের মুক্তির সংগ্রামে শক্তি দিয়েছে তার গান-কবিতা। দেয়ালে দেয়ালে নজরুলের লেখনী স্বপ্ন দেখিয়েছে নতুন বাংলাদেশের। আজকের প্রেক্ষাপটে মনে পড়ছে তার অমর সৃষ্টি ‘সাম্যবাদী’ কবিতার কথা।

‘গাহি সাম্যের গান-
যেখানে আসিয়া এক হয়ে গেছে সব বাধা-ব্যবধান
যেখানে মিশছে হিন্দু-বৌদ্ধ-মুস্‌লিম-ক্রীশ্চান।
গাহি সাম্যের গান!’

জুলাইয়ের উত্তাল দিনগুলো সব বাধা-ব্যবধান ঘুচিয়ে সবাইকে এক কাতারে এনেছিল বলেই স্বৈরাচার হটাতে পেরেছি আমরা। ৫ অগাস্টের পর দেশে না ছিল পুলিশ, না ছিল কোনো সরকার। কিন্তু তারপরও সবাই মিলে অরাজকতা ঠেকিয়েছি।

ঢাকার রাস্তায় ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ করেছে স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। পাড়ায় মহল্লায় কমিটি করে ডাকাতি ঠেকিয়েছে এলাকার মানুষ। থানা থেকে লুট করা অস্ত্র উদ্ধার করে দিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীরা। এ সবই আমাদের অর্জন। গণপিটুনির মতো অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনাও ঘটেছে এই সময়। কিন্তু তার বিরুদ্ধেও আওয়াজ তুলেছে দেশের মানুষ।

যার সাথে মতের মিল হচ্ছে না, তাকে একেবারে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়ার রাজনীতি যারা এখনো করে চলেছেন, তাদের আওয়ামী লীগের মতো দমন নীতির ফলাফল দেখার করার সময় এসেছে।

সব ছাপিয়ে মুক্ত ১০০ দিন পর প্রকট হয়ে দেখা দিচ্ছে আন্দোলনে অংশ নেওয়া বিভিন্ন শক্তির মধ্যে আলোচনার অভাব। সন্দেহ নেই যে, এই আন্দোলনে স্বৈরাচার হাসিনাকে সরাতে যারা এক হয়েছিলেন তাদের মধ্যে নানা রাজনৈতিক মতাদর্শ রয়েছে। কেউ জাতীয়তাবাদী, কেউ ইসলামি, কেউ সমাজতন্ত্রী রাজনৈতিক হয়ে মাঠে ছিলেন দশকের পর দশক জুড়ে।

পনের বছর এদের কেউই সভা-সমাবেশ তো দূরে থাক, মন খুলে কথা পর্যন্ত বলতে পারেনি, পাছে ফোন আলাপ ফাঁস হয়ে যায়। জুলাইয়ের বড় অর্জন সে ভয় দূর করতে পারা। প্রতিদিন শুধু ঢাকা শহরেই অনেক সভা-সেমিনার হচ্ছে। তাতে স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশ নিচ্ছেন নানা শ্রেণি-পেশার মানুষ। অভ্যুত্থানে অংশ নেওয়া বিভিন্নজন তাদের দর্শন আর রাজনীতির কথা জানাচ্ছেন সবাইকে। এ সবই ইতিবাচক। এই ভিন্নমত প্রকাশ গণতন্ত্রের অন্যতম অনুষঙ্গ।

সমস্যাটা হচ্ছে অন্য জায়গায়। শেখ হাসিনার ফ্যাসিবাদের সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য হলো ভিন্নমত দমনে, তাদের নিশ্চিহ্ন করতে সর্বশক্তি নিয়োগ করা। বিএনপি কিংবা জামায়াতকে নিশ্চিহ্ন করতে চেষ্টার কোনো ত্রুটি রাখেনি আওয়ামী লীগ। কিন্তু দিন শেষে আওয়ামী লীগ নিজেই আজ বিলুপ্তির দ্বারপ্রান্তে।

কথা হলো, সেখান থেকে শিক্ষা নিচ্ছে ক’জন? যার সাথে মতের মিল হচ্ছে না, তাকে একেবারে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়ার রাজনীতি যারা এখনো করে চলেছেন, তাদের আওয়ামী লীগের মতো দমন নীতির ফলাফল দেখার করার সময় এসেছে।

বাংলাদেশে যেমন শত-নদীর স্রোতধারা এসে মিশেছে, তেমনি মিশেছে বহু সভ্যতা, বহু জাতি, বহু ধর্ম। তাই এ দেশের মানুষের মধ্যে, মানুষের চিন্তার মধ্যে বৈচিত্র্য থাকবে, সেটাই স্বাভাবিক। এই বৈচিত্র্য ধরে রেখে, সবার সহাবস্থান নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব।

জুলাই পরবর্তী সময়ে সবার আগে প্রয়োজন ভিন্নমতকে দমন করার যে প্রয়াস সেটা রুখে দেওয়া। সবাই যার যার মত প্রকাশ করতে পারবেন। অন্যের মত জানার পর, কোনটা তিনি ঠিক মনে করেন না, তাও বলতে বাধা থাকা উচিত নয়। কিন্তু ঘৃণা কিংবা বিদ্বেষ প্রচার, সুস্থ সমাজের লক্ষণ হতে পারে না।

যারা কোনো একটি নির্দিষ্ট বিষয় নিয়ে জোর গলায় কথা বলছেন, কাজ করছেন, তারা সংখ্যায় কম হলেও তাদের প্রভাব সার্বিক রাজনীতিতে বেশি। তাই অনেক সময় অতি অল্প সংখ্যক মানুষের ঘৃণার প্রচার যতটা দেখা যায়, তার প্রতিবাদ ততটা চোখে পড়ে না। কিন্তু ঘৃণার প্রচারের মুখে চুপ করে থাকলে, ঘৃণারই জয় হয়, প্রেমের নয়।

জুলাইয়ে আমরা সবাই পথে নেমেছিলাম স্বৈরশাসনের অবসানের জন্য। স্বৈরাচারের পতনের পর আমরা সবাই মিলেই নতুনের স্বপ্ন দেখেছি। অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে আমরা সবাই পৌঁছে দেওয়ার চেষ্টা করেছি আমাদের প্রত্যাশার কথা। প্রত্যাশা পূরণে ধীরগতি যে আছে সে ব্যাপারেও সন্দেহ নেই। কিন্তু সরকারের কাছে প্রত্যাশার কথা জানিয়ে আমরা যদি সবাই বাড়ি গিয়ে বসে থাকি, তাহলে কিন্তু মাঠে তাদের আওয়াজই পাওয়া যাবে যারা সংখ্যায় অনেক কম হয়েও, তুলনামূলকভাবে বেশি সংগঠিত।

লেখার শুরুতে যে ভিন্ন ভিন্ন মানুষের স্বপ্নের কথা বলছিলাম, তাদের স্বপ্ন ভিন্ন হলেও, তাদের কথা বলার জন্য একটা পাটাতন তৈরি করা জুলাই অভ্যুত্থানের পর সবচেয় বড় কাজ। সবাই মিলেই ঠিক করা প্রয়োজন কার কতটুকু দাবি আজকের বাংলাদেশে পূরণ করা যাবে, আর কতটুকু তুলে রাখতে হবে ভবিষ্যতের জন্য।

এই প্রক্রিয়ায় মতভেদ আসতে পারে, কিন্তু ঘৃণার চর্চা যেকোনো মূল্যে পরিহার করতে হবে। ‘সাম্যবাদী’ কবিতার ভাষাতেই বলা চলে

‘কে তুমি পার্সি জৈন? ইহুদি? সাঁওতাল, ভিল, গারো?
কনফুসিয়াস? চার্বাক চেলা? বলে যাও, বল আরও!
—বন্ধু, যা খুশি হও,
পেটে পিঠে কাঁধে মগজে যা খুশি পুঁথি ও কেতাব বও,
কোরান-পুরাণ-বেদ-বেদান্ত-বাইবেল-ত্রিপিটক-
জেন্দাবেস্তা-গ্রন্থসাহেব পড়ে যাও, যত শখ
কিন্তু, কেন এ পণ্ডশ্রম, মগজে হানিছ শূল?
দোকানে কেন এ দর কষাকষি?-পথে ফুটে তাজা ফুল!’

আমাদের যার যার ধ্যানধারণা নিয়ে দোকানে দর কষাকষি না করে, আমরা তো পারি পথের তাজা ফুলের সুবাস নিতে। জুলাইয়ের অভ্যুত্থানের পর নিঃসন্দেহে রাষ্ট্রব্যবস্থার আমূল সংস্কারের অনেক বড় একটা সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। দেশের সবচেয়ে নিগৃহীত, অবহেলিত জনগোষ্ঠীই জুলাইয়ের সংগ্রামে সবচেয়ে বেশি ত্যাগ স্বীকার করেছেন। যারা শহীদ হয়েছেন তাদের বড় অংশই এসেছেন সমাজের প্রান্তিক জনগোষ্ঠী থেকে।

দেশের সবচেয়ে নিগৃহীত, অবহেলিত জনগোষ্ঠীই জুলাইয়ের সংগ্রামে সবচেয়ে বেশি ত্যাগ স্বীকার করেছেন। যারা শহীদ হয়েছেন তাদের বড় অংশই এসেছেন সমাজের প্রান্তিক জনগোষ্ঠী থেকে।

এমন অনেক রিকশাচালক আর শ্রমিক চোখ হারিয়েছেন, কিংবা অঙ্গ হারিয়েছেন, যারা ছিলেন তাদের পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম। তাই সমাজের অবস্থাপন্ন অংশের চেয়ে জুলাই অভ্যুত্থানে যে মূল্য এ দেশের শ্রমজীবী মানুষ দিয়েছেন তা অনেক বেশি। কিন্তু যখন সংস্কারের প্রশ্ন ওঠে তখন এই ‘সর্ব-অবমানিত’ জনগোষ্ঠীর জীবন ঘনিষ্ঠ বিষয়কে প্রাধান্য না দিয়ে এমন সব বিষকে সামনে নিয়ে আসা হয়, যা নিয়ে বিতর্ক অনিবার্য।

ধর্ম, জাতীয়তা, সংস্কৃতির মতো নানা ভাবগত বিষয়ে মতপার্থক্য ও বিরোধ নতুন নয়। এ প্রশ্নগুলোর সমাধানের বহু আগে প্রয়োজন এ দেশের মানুষের ভাত-কাপড়ের নিশ্চয়তা দেওয়া। প্রয়োজন স্বাস্থ্য-শিক্ষার মতো মৌলিক অধিকারগুলো মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়ার।

অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের হাতে অসীম সময় নেই। যত সময় গড়াবে, রাজনৈতিক দলগুলোর পক্ষ থেকে নির্বাচনের জন্য চাপও বাড়বে। সেটা যে একেবারে অযৌক্তিক তাও বলার সুযোগ নেই। তাই সবার আগে ঠিক করতে হবে কোন কাজগুলোর প্রশ্নে সবাই খুব সহজে একমত হতে পারে এবং কোন কাজগুলো এই সরকারের মেয়াদে করা সম্ভব। এই মৌলিক প্রশ্নে অগ্রাধিকার ঠিক করা গেলে অনেক সমস্যারই সমাধান করা যাবে।

বাংলাদেশের মানুষ এই নিয়ে দুইবার দেশটাকে নতুন করে গড়ার সুযোগ পেল। ১৯৭১-এ মহান মুক্তিযুদ্ধের পর প্রথম দফা সুযোগ পেয়েছিল। তা কতটা হয়েছে আমাদের সবারই জানা। তাই প্রত্যেকের জায়গা থেকে আমাদের সজাগ থাকতে হবে।

সব কাজ সরকারের পক্ষে করা সম্ভব নয়। এই সরকারকে ক্ষমতায় আনার পেছনে যেমন আমাদের সবার অবদান আছে, তেমনি একে ঠিক পথে রাখার কাজটাও আমাদের সবারই মিলেমিশে করতে হবে। একটা জাতির জীবনে এমন সুযোগ বারবার আসে না।

মানজুর-আল-মতিন ।। আইনজীবী, সুপ্রিম কোর্ট