ছবি : সংগৃহীত

কেস ১
শিশুটির বয়স ৩ বছর। ছোট ছোট শব্দ বলতে পারে কিন্তু স্পষ্ট করে কথা বলতে পারে না। সবচেয়ে বড় বিষয় হলো জিরো কমিউনিকেশন স্কিল। এর মানে হলো শিশুকে কোনো প্রশ্ন করলে সে তার উত্তরে প্রশ্নটি পুনরাবৃত্তি করে, কিন্তু উত্তর হিসেবে তার নিজের কথা বলতে পারে না।

এই শিশুটির অভিভাবক বেশ যত্ন করে শিশুকে সংখ্যা এবং অক্ষর মুখস্থ করিয়েছেন কিন্তু ঠিক কীভাবে কথাবার্তা চালিয়ে যেতে হয়, প্রশ্ন করতে হয়, উত্তর দিতে হয় সে বিষয়ে বিশেষ মনোযোগ দেননি। একই সাথে অভিভাবক এও নিশ্চিত করেছেন কাজের চাপে শিশুকে অনেক সময় ধরে অনলাইন কনটেন্ট দেখার সুযোগ তিনি দিয়েছেন একটানা! 

কেস ২

এই শিশুটির বয়স ৪ বছর ১০ মাস। বয়স এবং উচ্চতার তুলনায় স্বাস্থ্য বেশ ভালো। কথা একেবারেই বলতে পারে না। শিশুর অভিভাবকের সাথে কথা বলার সময় জানা গেল বাবা-মা দুজনেই চাকরি করেন। সারাদিন সময় দিতে পারেন না। অনেকটা সময় অনলাইন বেজড ম্যাটেরিয়েল দেখে সময় কাটে তার। মাঝে মাঝে চাকরি সামলিয়ে শিশুকে কারও কাছে নিরাপদে রেখে আসার জন্য রীতিমতো যুদ্ধ করতে হয় তাকে।

শিশু এ বয়সে এখনো দাঁত দিয়ে চিবিয়ে খাওয়া অভ্যাস করতে পারেনি। অভিভাবকের সাথে কথা বলার সময় যখন শিশু খেলনার জন্য বায়না করে জিনিসপত্র ছুঁড়ে ফেলছিল তখন অভিভাবক বলছিলেন, ‘ইটস ওকে! ইটস ওকে!’ দেখা গেল শিশুটি ইতিবাচকভাবে অভিভাবকদের সাড়া দিচ্ছে না।

কেস ৩

বাবা-মা দুজনেই প্রকৌশলী। শিশুটির বয়স ৪ বছর। ওকে নিয়ে যখন বাবা-মা ‘শৈশব’-এ আসেন তখন ওকে স্থির রাখতে গিয়ে দুজনেই হিমশিম খাচ্ছিলেন। দুজনেই বেশ উদ্বিগ্ন সন্তানের ভবিষ্যৎ নিয়ে। ছেলেটির মুঠোফোনের প্রতি বেশ নেশা তৈরি হয়েছে। কিছু সময় মুঠোফোন ব্যবহার করতে না পারলে কান্না শুরু করে, মেজাজ খারাপ করে ফেলে এবং কিছু একটা নেই বা সে পাচ্ছে না এমন একটা অস্থিরতা দেখা যেতে থাকে! শিশুর কমিউনিকেট করার দক্ষতা বেশ দুর্বল।

কেস ৪

বাবা বাইরে কাজ করেন এবং মা বাড়িতেই শিশুর গোটা সময় দেখাশোনা করেন। শিশুর বয়স সাড়ে ৩ বছর। শিশুটির বাংলা বলার ধরন ইংরেজি উচ্চারণের মতো। খুব ছোট থেকে ইংরেজি কার্টুন দেখা হয়েছে। বাড়ির সদস্যদের সাথে কমিউনিকেশন হয়েছে কম। একমাত্র ছেলে। তাই চাইবার আগেই সে অনেক কিছু পেয়ে গেছে। কাজেই চাওয়ার অভ্যাস তার মধ্যে তৈরি হয়নি। ইংরেজি উচ্চারণে বাংলা বলার চেষ্টা করার কারণে বড়দের সাথে তার কমিউনিকেশন এর জায়গা সুদৃঢ়ভাবে গড়ে ওঠেনি।

এখনকার আলফা জেনারেশনের মধ্যে টেলিভিশন দেখা অতটা জনপ্রিয় নয়। তার একটা বড় কারণ ওদের বাবা-মা টেকনোলজি হিসেবে টেলিভিশনের চেয়ে মুঠোফোন অধিক ব্যবহার করেন এবং শিশুরা এটা দেখে।

কেস ৫

শিশুর বাবা এবং মা দুজনেই কর্মজীবী। শিশুর বয়স ২ বছর ১০ মাস। শিশুর বাড়িতে তার বাবা-মা ছাড়াও নানা ও নানি আছেন। বাড়ির পরিবেশে বাবা-মা ইন্টারনেট ভিত্তিক কনটেন্ট একেবারেই দেন না কিন্তু নানা ও নানির সাথেও বেশ কিছুটা সময় কাটানোর ফলে শিশু ইন্টারনেট ভিত্তিক কনটেন্ট ব্যবহারের সুযোগ পেয়ে যায়। এক্ষেত্রে দেখা যায় যে ইন্টারনেটে শিশু কী কনটেন্ট দেখছে তা শিশুর নানা অথবা নানি ফিল্টার করতে পারছেন না। কাজেই শিশু না চাইতেও অনাকাঙ্ক্ষিত কনটেন্ট-এর প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠছে।

উপরের কেসগুলো সংগ্রহ করা হয়েছে একটি খেলার স্কুলে আগত বিভিন্ন অভিভাবকদের সাথে কথা বলার মাধ্যমে। এটা ছিল খেলা শুরু করার আগে শিশুদের প্রাথমিক অবস্থা। পরবর্তীতে খেলার মাধ্যমে শিশুদের ডেভেলপমেন্ট নিয়ে বিশেষভাবে কাজ করা হয়েছে। তবে এটা স্পষ্ট যে, অতিরিক্ত মাত্রায় ইন্টারনেট ভিত্তিক কনটেন্ট ব্যবহারের কারণে শিশুরা ভার্চুয়াল জগতের বাইরে বাস্তব জগতে স্বাভাবিক যোগাযোগ করতে ব্যর্থ হচ্ছে অথবা সহজভাবে করতে পারছে না। একই সাথে কনটেন্ট বাছাই ও নির্বাচনের ক্ষেত্রেও বাড়ির সদস্যরা ভূমিকা রাখতে পারছে না, এ বিষয়ে স্পষ্ট ধারণা না থাকার কারণে।

একটি অনলাইন ভিত্তিক সমীক্ষার মাধ্যমে কিছু অভিভাবকের কাছ থেকে তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে যে, শিশুদের জন্য উপযোগী কনটেন্ট টেলিভিশনে যথাযথভাবে পাওয়া যায় কি না বা শিশুরা টেলিভিশন দেখে কি না বা শিশুরা টেলিভিশনের কোনো বিশেষ পছন্দের চ্যানেল খুঁজে পেয়েছে কি না।

সমীক্ষার ফলাফল হিসেবে দেখা গেল, এখনকার আলফা জেনারেশনের মধ্যে টেলিভিশন দেখা অতটা জনপ্রিয় নয়। তার একটা বড় কারণ ওদের বাবা-মা টেকনোলজি হিসেবে টেলিভিশনের চেয়ে মুঠোফোন অধিক ব্যবহার করেন এবং শিশুরা এটা দেখে। তারা যেটা বেশি ব্যবহার করতে দেখে, ঠিক সেটার প্রতিই বেশি আগ্রহ প্রকাশ করে। এখন এক্ষেত্রে অভিভাবকেরা বিশেষভাবে উল্লেখ করেছেন যে টেলিভিশনে শিশুদের উপযোগী কনটেন্ট অনুপস্থিত।

ইংরেজি চ্যানেলগুলো রিপ্লেসমেন্ট হিসেবে মোবাইলে ইন্টারনেট ভিত্তিক কনটেন্টগুলো ব্যবহার হচ্ছে এবং বাংলার ক্ষেত্রে দুরন্ত চ্যানেল থাকলেও সবাই যে এই চ্যানেল দেখেন বা শিশুদের দেখান এমন কোনো সুস্পষ্ট তথ্য পাওয়া যায়নি। অথচ আমার ব্যক্তিগত অভিমত হলো যেহেতু মুঠোফোনে কনটেন্ট ফিল্টার হয় না সেক্ষেত্রে টেলিভিশনের বাংলাসহ অন্যান্য চ্যানেল যেমন জিওগ্রাফি, কার্টুন ইত্যাদি শিশুদের দেখার জন্য দেওয়া ভালো হয় কারণ এক্ষেত্রে কনটেন্ট ফিল্টার করার প্রয়োজন পড়ে না।

শিশুদের জন্য কনটেন্ট লাগবেই। শিক্ষা এবং শেখানোর জন্য লাগবে, কোয়ালিটি টাইম-এর একটা অংশ হিসেবে লাগবে, আধুনিক সময়ের সাথে হালনাগাদ রাখতে প্রয়োজন হবে, প্রয়োজন হবে টেকনোলজির নানা উপকারিতা সম্পর্কে জানতে, প্রয়োজন হবে নানা রকমের সৃজনশীল কনটেন্ট সম্পর্কে জানতে।

এর মধ্যে ছবি আঁকা, রান্না শেখা, কাগজ কেটে কিছু বানানো, অরিগামি নিয়ে কাজ, সায়েন্স এক্সপেরিমেন্ট সম্পর্কে জানাসহ অনেক অনেক কিছু! সমস্যা হলো কতটা সময় দেখবে?

সারাদিনে নির্দিষ্ট সময় শিশুকে দিতে হবে আর সেই সময়টা হতে হবে শিশুর বয়সের ওপর ভিত্তি করেই। ইন্টারনেটে অসংখ্য কনটেন্ট আছে ঠিক কোন কনটেন্ট শিশুর জন্য সঠিক সেটাও জানা প্রয়োজন। কাজেই ইন্টারনেট সম্পর্কে আলাদা করে জানাশোনা না থাকলে অভিভাবকদের সরাসরি শিশুদের ওপরে কনটেন্ট নির্বাচনের বিষয়টি হতে পারে আত্মঘাতী।

এখন মুঠোফোনকে কেবলমাত্র একমাত্র টেকনোলজি হিসেবে ব্যবহার করার দিক থেকেও সরে আসতে হবে। অনেকগুলো অপশন রাখা ভালো সিদ্ধান্ত। দিনের একটা নির্দিষ্ট সময় যেকোনো অনুষ্ঠান সবাই মিলে টেলিভিশনে দেখার চর্চা ইতিবাচক হবে বলেই আমি নিজে আমার বাড়ির পরিবেশে হাতেকলমে গবেষণা করে দেখেছি। এছাড়া আরও নানা রকমের টেকনোলজি শিশুদের সাথে বাড়ির সদস্যরা ভাগাভাগি করে নিতে পারে। যেমন ম্যাগনিফাইং গ্লাস, প্রিজম, দুরবিন, কম্পিউটার, ল্যাপটপ বা ট্যাব ইত্যাদি।

সারাদিনে নির্দিষ্ট সময় শিশুকে দিতে হবে আর সেই সময়টা হতে হবে শিশুর বয়সের ওপর ভিত্তি করেই। ইন্টারনেটে অসংখ্য কনটেন্ট আছে ঠিক কোন কনটেন্ট শিশুর জন্য সঠিক সেটাও জানা প্রয়োজন।

কাজেই অপশন খোলা রাখতে হবে। মূল বিষয়টি হলো জানা। আগে জানতে হবে কোনটা কেন, কার জন্য বা কেন নয় বা কতটুকু! শিশুকে বড় করে তুলতে চারপাশের পরিবেশ সম্পর্কে মাত্রা চেতনা অভিভাবকদের নিজেদের না থাকলে শিশুর মধ্যে মাত্রা চেতনা গড়ে ওঠার আশা করাটা সমীচীন হবে না।

আপাত দৃষ্টিতে মনে হতে পারে একটা মুঠোফোন বা টেলিভিশন শিশুকে দিয়ে দেই। চুপ করে বসে থাকবে। নড়বে না। অভিভাবক হিসেবে নিজেকে শ্রম দিতে হচ্ছে না। শিশু নিজে নিজেই রাইমস বা ছড়া শিখে যাচ্ছে! কী দারুণ! কিন্তু এই অল্প শ্রমের মাধ্যমে অধিক ফল লাভের বাসনা গুড়েবালি হয় যখন শিশু কথা বলতে শেখে, ছড়া শেখে কিন্তু কমিউনিকেট করতে শেখে না!

কাজেই এ জায়গাটা নিয়ে বিশেষভাবে চিন্তা করার প্রয়োজন আছে। ছোট ছোট শিশুদের জন্য টেকনোলজির ব্যবহার ও মাত্রা সম্পর্কে জানা একটা জটিল এবং বড় ভাবনা! অভিভাবক হিসেবে শিশুদের নিয়ে কতভাবে উদ্বিগ্ন থাকি আমরা! তাই এ জায়গাটা নিয়েও আমাদের বিশেষ ভাবনা থাকুক, তৈরি হোক। প্রিয় অভিভাবক, আপনারা ভাবছেন তো টেকনোলজির যথাযথ ব্যবহার নিয়ে?

ফারহানা মান্নান ।। প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান নির্বাহী, শৈশব; শিক্ষা বিষয়ক লেখক ও গবেষক