রোজিনার মতো অনুসন্ধানী সাংবাদিকেরা কী করেন?
অনুসন্ধানী সাংবাদিকরা কী করেন? খুব সহজ করে বললে, গোপন সত্য উন্মোচন করেন। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, কারা লুকিয়ে রাখেন গুরুত্বপূর্ণ এই তথ্য? প্রভাবশালীরা। কেন? কারণ প্রকাশ পেলে বিপদে পড়বে, নিজের স্বার্থ ক্ষুণ্ন হবে। আর অনুসন্ধানী সাংবাদিকরা জনস্বার্থে সেটা খুঁজে বের করেন।
সাংবাদিকের জন্য সত্য খুঁজে বের করা কখনোই সহজ হয় না। পথটা কঠিন। খুব কঠিন। ঝুঁকিপূর্ণও বটে। একজন সাংবাদিকের অনুসন্ধানে নামার আগে এই ঝুঁকি বিবেচনায় নিতে হয়। মাঠপর্যায়ে কোনো তথ্য জোগাড় করতে কি ধরনের ঝুঁকি আছে, প্রথমেই তা খুঁজে বের করতে হয়। তা না হলে বড় বিপদে পড়ার আশঙ্কা থাকে।
বিজ্ঞাপন
ধরুন, দেশে মাদকের বিস্তার নিয়ে প্রতিবেদন করতে গেলে, একজন সাংবাদিককে স্পটগুলোতে যেতে হবে। সেখানে গিয়ে পরিচয় দিলে নিরাপদে ফিরতে পারবেন সেই নিশ্চয়তা নেই! তখন সাংবাদিককে ছদ্মবেশ ধারণ করতে হয়। বড় কোনো সন্ত্রাসী কিংবা জঙ্গির সাক্ষাৎকারেও ঝুঁকি অনেক বেশি। পরিকল্পনা করে এসব অনুসন্ধানে ঝুঁকি কমানো সম্ভব। কিন্তু ঝুঁকি কমাতে হলে জানতে হবে আগে, ঝুঁকিটা কোথায় কোথায় আছে।
দুর্নীতি নিয়ে অনুসন্ধানেও ঝুঁকি আছে। তবে মাত্রাটা কিছুটা কম। কারণ দুর্নীতিবাজরা সমাজে প্রতিষ্ঠিত। তারা তাদের সম্পদ ধরে রাখতে চান। তাই সবকিছু ‘ম্যানেজ’ করে চলতে চান। সাংবাদিক গেলেও মারমুখী না হয়ে প্রথমে ‘ম্যানেজ’ করার চেষ্টা করেন। আমার অভিজ্ঞতা তাই বলে।
‘ম্যানেজ’ না হলে প্রভাব খাটান, প্রতিবেদনটি বন্ধ করার উপায় খোঁজেন। তাই এই ধরনের অনুসন্ধানে জীবনের ঝুঁকি ততটা নেই। ফলে একজন অনুসন্ধানী সাংবাদিকের নিরাপাত্তা পরিকল্পনাও ভিন্ন হয়। তাদের মূল লক্ষ্য থাকে, যে দুর্নীতিটি হয়েছে, তা প্রমাণে প্রচুর নথিপত্র জোগাড় করা।
সাংবাদিক রোজিনা ইসলামকে কারাগারে যেতে হয়েছে। কারণ তিনি সচিবালয়কে নিরাপদ ভেবেছেন! একা চলে গিয়েছেন সেখানে, আমলার রুমে। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনি গোপন নথির ছবি তুলেছেন এবং সেগুলো সরিয়ে নিতে চেয়েছেন।
কীভাবে সেই নথি জোগাড় করেন একজন অনুসন্ধানী সাংবাদিক? প্রথমে নথিটি চিহ্নিত করেন। অর্থাৎ কোন নথিটি হলে এই দুর্নীতিটি প্রমাণ করা সম্ভব। তারপর সেটি কোথায় আছে, কার কাছে গেলে পাবেন—তা জেনে নেন। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সেই ব্যক্তিটি নথি দিতে চান না। কোনো না কোনোভাবে এড়িয়ে যান। তখন সাংবাদিককে যেতে হয় বাঁকা পথে।
নথিটি হাতে পাওয়ার জন্য কোনো না কোনো উপায় খুঁজতে হয়। এমন ভিন্ন পথে যেতে কিছু নীতি-নৈতিকতাও সাংবাদিককে মানতে হয়। জনস্বার্থের মাত্রাটা বিবেচনায় আনতে হয়। সহজ করে বললে, যদি প্রতিবেদনটি প্রকাশ পায়, দুর্নীতিটি প্রমাণ করা যায় তাহলে মানুষের বড় উপকার হবে, এমন বিবেচনায় তখন একজন অনুসন্ধানী সাংবাদিকের কাছে তথ্যটি হাতে পাওয়ার উপায়ের চেয়েও তথ্যটি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। রাষ্ট্র ও মানুষের কল্যাণ বড় হয়ে দেখা দেয়। অনুসন্ধানী সাংবাদিক ভুলে যান তার নিরাপত্তার কথা।
ইতিহাসে বড় সব অনুসন্ধানী প্রতিবেদন দেখলে নথির গুরুত্ব কতটা, তা সহজে বুঝতে পারবেন। আলোচিত পানামা পেপারস কেলেঙ্কারির কথাই ভাবুন। ফাঁস করা হয়েছিল এক কোটি ১৫ লাখ গোপন নথি। সাড়া পড়েছিল পৃথিবীব্যাপী।
এত কথা বলার একটাই উদ্দেশ্য, বোঝানো, একটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে, একটি দুর্নীতি প্রমাণে নথি জোগাড়ে একজন অনুসন্ধানী সাংবাদিক কেন হন্যে হয়ে ঘুরে। কেন তাকে নথির পেছনে দিনরাত এক করে পড়ে থাকতে হয়।
তবে নথি খুঁজতে গিয়ে দেশে কোনো সাংবাদিক বিপদে পড়েছেন, এমন ঘটনা বিরল। নথি ধরে সাক্ষাৎকার নিতে গিয়ে নির্যাতনের শিকার কম-বেশি সব অনুসন্ধানী সাংবাদিকের ক্ষেত্রে ঘটে।
একটি অভিজ্ঞতার কথা বলি। আমি তখন বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল মাছরাঙা টেলিভিশনে কর্মরত। তাদের জন্য করা ‘অনুসন্ধান’ অনুষ্ঠানের একটা পর্বে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের অনিয়ম-দুর্নীতির অনুসন্ধান করতে গিয়ে একটি নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়ের চেয়ারম্যানের সাক্ষাৎকার নিতে গিয়েছিলাম আমরা। দুর্নীতির নথি দেখানোর পর তিনি তার দপ্তরে তিন ঘণ্টা অবরুদ্ধ করে রেখেছিলেন আমাদের। তিনি এতটাই মারমুখী ছিলেন যে, ক্যামেরা ভেঙে, গায়ে হাত তুলেও শান্ত হননি। পুলিশ ডেকে এনেছিলেন, চাঁদাবাজির মামলা দেওয়ার জন্য। সাক্ষাৎকার নিতে গেলে এমন বিপদ হতে পারে সেই আশঙ্কা আগেই জেনেছিলাম। তাই নিরাপত্তার কথা পরিকল্পনা করেছিলাম। সেই যাত্রায় বেঁচেও ফিরেছিলাম।
যারা দুর্নীতি প্রতিবেদন করেন, তারা কোনো না কোনো উপায়ে, লুকিয়ে তথ্য কিংবা নথি জোগাড় করেন। আমিও করেছি। নথি দিয়ে দুর্নীতির প্রমাণ করেছি। রোজিনাও কম করেনি। দিনের পর দিন করেছে।
কিন্তু প্রথম আলোর অনুসন্ধানী সাংবাদিক রোজিনা ইসলামকে কারাগারে যেতে হয়েছে। কারণ তিনি সচিবালয়কে নিরাপদ ভেবেছেন! একা চলে গিয়েছেন সেখানে, আমলার রুমে। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনি গোপন নথির ছবি তুলেছেন এবং সেগুলো সরিয়ে নিতে চেয়েছেন।
এই কথিত অভিযোগে দুষ্ট সব অনুসন্ধানী সাংবাদিক। কারণ যারা দুর্নীতি প্রতিবেদন করেন, তারা কোনো না কোনো উপায়ে, লুকিয়ে তথ্য কিংবা নথি জোগাড় করেন। আমিও করেছি। নথি দিয়ে দুর্নীতির প্রমাণ করেছি। রোজিনাও কম করেনি। দিনের পর দিন করেছে। এমন নথি দিয়ে রোজিনা কী করে, কত মানুষের উপকার হয়, কীভাবে দুর্নীতি বন্ধ হয়—যারা পত্রিকা পড়েন তাদের অজানা থাকার কথা নয়।
এই করোনাকালীন সময়েও স্বাস্থ্য বিভাগের দুর্নীতি উন্মোচনে যতটা সাহস রোজিনা দেখিয়েছেন অন্য কেউ তা দেখিয়েছেন কিনা আমার জানা নেই। তাই ওই মন্ত্রণালয়ে তার ‘শত্রু’র অভাব নেই! বাস্তবে সেখানে কী ঘটেছে, কীভাবে ঘটেছে, সেটি কি পরিকল্পিত ছিল কিনা—আমরা তা এখনও জানি না। তবে রোজিনার মতো একজন সাংবাদিককে যখন কারাগারে পাঠানো হয় তখন দেশের অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা কতটা হুমকির মুখে পড়ে তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
রোজিনাকে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের একটি কক্ষে পাঁচ ঘণ্টারও বেশি সময় ধরে আটকে রাখা হয়। সে সময় রোজিনা কতটা অসহায় ছিল—ছবি, ভিডিওতে তা স্পষ্ট।
‘চোর’ ধরলে যেমন আচরণ করা হয় তেমনটাই করেছেন উপস্থিত সরকারি কর্মকর্তারা। এতটাই মারমুখী ছিলেন, রোজিনার গলা পর্যন্ত চেপে ধরেছিলেন। আমার কাছে উদ্বেগের বিষয় হলো সেটি। দিনে দিনে এই আমলারা, যারা অনিয়ম-দুর্নীতি করছেন, তারা অনুসন্ধানী সাংবাদিকের জন্য মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠছেন।
অনুসন্ধানী প্রতিবেদন করতে গেলে সাংবাদিকদের জন্য ঝুঁকির তালিকায় এখন ‘দুর্নীতিবাজ আমলা’ ওপরের দিকেই থাকবেন! পরিকল্পনার সময় সেটি মাথায় রাখতে হবে। রোজিনা হয়তো এই বিবেচনাটি করেননি!
বদরুদ্দোজা বাবু ।। অনুসন্ধানী সাংবাদিক