ছবি : সংগৃহীত

'সংস্কৃতি হোক জনগণের ইতিহাস রচনায় বিশ্বাসী'—এটি একটি নাট্যদলের স্লোগান। কারক নাট্য সম্প্রদায়ের কর্ণধার শংকর সাঁওজাল এই স্লোগানটা দলের হয়ে লিখলেন এবং নাট্যদলটি মাথায় পেতে নিলো।

বাংলাদেশের প্রতিটি নাট্যদলের নিজস্ব স্লোগান আছে সেইসব স্লোগান একসাথে করে লিপিবদ্ধ করলে হয়তো দেখা যাবে বাংলাদেশের সংস্কৃতির চর্চার নানা রূপ। সাংস্কৃতিক চর্চার মধ্যে নাচ, গান, নাটক, যাত্রাই কি শুধু? যদি বলি না। তাই কথায় কথা আসে একটা পরিবারের মধ্যে যে সাংস্কৃতিক চর্চা হয় সেটিই প্রতিফলিত হয় সমাজের মধ্যে।

পৃথিবীতে মানুষকে বেঁচে থাকতে হলে তাকে খেতে হয়, পোশাক পরতে হয়, সমাজের সাথে চলতে হলে কিছু দায়বদ্ধতা থাকে, সবই নিত্যদিনের একটা অংশ। আর সাংস্কৃতিক চর্চা সে তো শুধু নিজের জন্য নয়, তা দিয়ে একটি দেশকে চেনা যায় তার দেশের সাংস্কৃতিক চর্চার ওপর।

সাংস্কৃতিক চর্চার মধ্য দিয়ে চিন্তার প্রতিফলন ঘটে সমাজের আর সেখান থেকেই সৃষ্টি হয় লালন, মাইকেল, রবীন্দ্রনাথ, নজরুল। গড়ে ওঠে প্রতিবাদের ভাষা, প্রতিরোধের ভাষা। সাংস্কৃতিক আন্দোলনের মধ্য দিয়ে সৃষ্টি হয় সমাজ কাঠামো। প্রশ্ন উঠেছে, সাংস্কৃতিক চর্চা একটি জাতির জন্য কেন দরকার বা প্রয়োজন অথবা রাষ্ট্রের দায়বদ্ধতা কতটুকু সাংস্কৃতিক চর্চার পরিসর বাড়ানোর ক্ষেত্রে?

সম্প্রতি একটা ঘটনা আমাদের আতঙ্কিত করে। বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির জাতীয় নাট্যশালার মঞ্চে ‘দেশ নাটক’-এর প্রযোজনা ‘নিত্যপুরাণ’ নাটক মঞ্চস্থ হওয়ার সময় মাঝপথে তা বন্ধ করতে বাধ্য করা হয়।

২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থান হওয়ার পরে রাষ্ট্রের অবকাঠামো পরিবর্তিত হয়েছে। এই পরিবর্তনের সূত্র ধরে একজন নাট্যকর্মীর ব্যক্তিগত কার্যকলাপ এসে পড়েছে দলের ওপর (নাট্যদল) আর তারই প্রভাব পড়ছে রাষ্ট্রের ওপর।

সাংস্কৃতিক চর্চার মধ্য দিয়ে চিন্তার প্রতিফলন ঘটে সমাজের আর সেখান থেকেই সৃষ্টি হয় লালন, মাইকেল, রবীন্দ্রনাথ, নজরুল। গড়ে ওঠে প্রতিবাদের ভাষা, প্রতিরোধের ভাষা।

শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক নাটক বন্ধ করার ঘোষণা দিলেন এমনটাই আমরা জেনেছি, কিন্তু দলের প্রধানের সাথে আলাপ করে যে বন্ধের ঘোষণা দেওয়া হয়েছে তা প্রকাশের অন্তরালে। ইতিমধ্যে সৈয়দ জামিল আহমেদের বক্তব্য অনেকেই শুনেছি। তারপরেও নাট্যদল ও সাংস্কৃতিক কর্মীর মধ্যে ক্ষোভ জন্মেছে নাটক কেন বন্ধ করা হলো? তাহলে কি আমরা সেই অতীতের দিকেই হাঁটছি?

সৈয়দ জামিল আহমেদ বলছেন—আজকে অনেকেই অনেক মন্তব্য করছেন, কিন্তু সেই মুহূর্তে পাশে এসে দাঁড়াননি কেন? তার কথায় এমনটাই প্রকাশ পায় যে নাটকের মানুষ পাশে থাকলে হয়তো শক্তি বাড়তো। দূর থেকে কী হবে? আমার পাশে এসে দাঁড়ান। তাহলে আমি শক্তি পাবো। এমনটাই শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালকের কথা।

ইতিহাস তো কথা বলে, বাংলাদেশ নামটি হওয়ার আগে ১৯৪৭ থেকে ১৯৭০ সময়কালে পূর্ববঙ্গ তথা পূর্ব পাকিস্তানের সাংস্কৃতিক চর্চার সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট বিবেচনায় ১৯৪৭ থেকে ১৯৭১ কালপূর্বে সাংস্কৃতিক চর্চায় ধরা দিয়েছে তৎকালীন বাঙালি জাতির সংগ্রাম মুখর জীবন সংগ্রাম।

১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন, ১৯৫৪ সালের ষড়যন্ত্র, পাকিস্তানের সামরিক আইন, ১৯৫২ সালের গণঅভ্যুত্থান এবং স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রত্যক্ষ প্রভাবে এ সময়কার সাংস্কৃতিক চর্চায় বাংলার নিজস্ব আঙ্গিক নির্মাণের প্রাচ্য ঐতিহ্য অনুসন্ধান সূচিত হয়ে গিয়েছিল।

১৯৫২ সালের বাংলা ভাষা আন্দোলনের পটভূমিকায় প্রতিবাদী সাংস্কৃতিক চর্চায় বাংলাদেশের লেখকরা সর্বাপেক্ষা উল্লেখযোগ্য সাহিত্য রচনা করেন—একদিকে গান, অন্যদিকে নাটক। সেইসব রচনায় উপস্থাপিত হয় ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা, সামাজিক গোঁড়ামি, মিথ্যা আভিজাত্যবোধ, ধর্মীয় গোঁড়ামি ও অসহিষ্ণুতার বিরুদ্ধে উদার মানসিকতার স্বপক্ষে উদাত্ত সুর ধ্বনিত হয়েছে।

একটু উদাহরণ দিয়ে বলা যেতেই পারে যে—রবীন্দ্রনাথের বিখ্যাত কাব্য নাটক ‘বিসর্জন’। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে শহীদ মুনীর চৌধুরীর একাঙ্কিকা নাটক ‘মানুষ’। অন্যদিকে মুকুন্দ দাসের বিখ্যাত গান ‘বান এসেছে মরা গাঙে বাইতে হবে নাও তোমরা এখনো ঘুমাও...’ এমন গান মানুষকে রাজনৈতিকভাবে সচেতন করে, সমাজের মেরুদণ্ডে আঘাত করে।

প্রশ্ন উঠেছে, সাংস্কৃতিক চর্চা একটি জাতির জন্য কেন দরকার বা প্রয়োজন অথবা রাষ্ট্রের দায়বদ্ধতা কতটুকু সাংস্কৃতিক চর্চার পরিসর বাড়ানোর ক্ষেত্রে?

যখন রাষ্ট্রের কাঠামোর দিকে আঙুল তুলে নাট্যকার দীনবন্ধু মিত্র রচনা করেন প্রতিবাদী চেতনায় ‘নীলদর্পণ’ নাটক তখনই পুষ্ঠু হয়ে ওঠে সামাজিক ও অর্থনৈতিক শোষণের বিরুদ্ধে।

আজ আমরা বারবার ভুলে যাচ্ছি তারিখের কথা, তবে এই তারিখটি পৃথিবীর অন্য দেশের জন্য একটি তারিখ বলে প্রযোজ্য কিন্তু বাংলাদেশের জন্য একুশে ফেব্রুয়ারি শুধুমাত্র একটি তারিখ নয়। একুশে ফেব্রুয়ারি মানে রক্তমাখা একটি সংগ্রামের দিন। শপথের একটি লাল দিন।

বাংলাদেশের জনগণের কাছে প্রাণের, বিবেকের, জাতিসত্তার প্রতীক। বাংলাদেশের ভূখণ্ডটি খণ্ডিত হয়েও একক, স্বাধীন। আর তাই বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক চর্চায় নাটক, গান, কবিতা, গল্প  উপন্যাস, রাজনীতি, প্রেম, নিসর্গ, ধর্ম, নাগরিক জীবন, সংশয়, বিষাদ এসবের মধ্যে উত্তর  খোঁজে ইতিহাসে জীবনচিত্রে, পুঁথিতে, মধ্যযুগের কাহিনীতে, বাংলার পাঁচালীতে, কথকতায়, দেশের ঐতিহ্যের সংস্কৃতিতে।

এজন্যই বাংলাদেশের সংস্কৃতি চর্চা অতীব জরুরি ‘নাটক মোদের অধিকার, রুখবে নাটক সাধ্য কার!’

ড. আরিফ হায়দার ।। অধ্যাপক, নাট্যকলা বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়