ছবি : সংগৃহীত

২০২৪ সালের মার্কিন নির্বাচন সামনে রেখে যুক্তরাষ্ট্রে রাজনৈতিক উত্তেজনা তুঙ্গে। এ নির্বাচনে প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হিসেবে রিপাবলিকান ডোনাল্ড ট্রাম্প এবং ডেমোক্র্যাটিক পার্টির প্রার্থী বর্তমান ভাইস প্রেসিডেন্ট কমলা হ্যারিসের মধ্যে প্রতিযোগিতা চলছে। যুক্তরাষ্ট্রের আগামী প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ভোটাররা ৫ নভেম্বর ভোট দিয়ে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত করবেন।

এবার নির্বাচনটি ২০২০ সালের নির্বাচনের পুনরাবৃত্তি হিসেবে ধারণা করা হলেও জুলাই মাসে বর্তমান প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন তার পুনঃনির্বাচনী প্রচারণা বন্ধ করে ভাইস-প্রেসিডেন্ট কমলা হ্যারিসকে সমর্থন জানানোয় পাল্টে গেছে নির্বাচনের প্রেক্ষাপট। এবার বড় প্রশ্ন হলো—যুক্তরাষ্ট্র কি তার প্রথম নারী প্রেসিডেন্ট পেতে যাচ্ছে, নাকি দ্বিতীয়বারের মতো ডোনাল্ড ট্রাম্পের শাসন দেখতে যাচ্ছে?

২০২৪ সালের মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ঘনিয়ে আসা এই মুহূর্তে ডোনাল্ড ট্রাম্প এবং কমলা হ্যারিস, উভয়ই নিজ নিজ প্রচারণার তৎপরতা বাড়িয়ে তুলেছেন। গুরুত্বপূর্ণ ব্যাটলগ্রাউন্ড হিসেবে পরিচিত জর্জিয়া, মিশিগান এবং নর্থ ক্যারোলাইনায় তারা প্রতিনিয়ত প্রচারণা চালাচ্ছেন।

প্রত্যেক ভোটারকে তাদের পক্ষে আনতে এবং সামান্যতম সুবিধা অর্জন করতে উভয় প্রার্থীই চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। তবে এই নির্বাচনে, শুধু বক্তব্য নয়, প্রার্থীদের ব্যক্তিগত আচার-আচরণ এবং অতীত কর্মকাণ্ডও ভোটারদের সিদ্ধান্তকে প্রভাবিত করছে।

হ্যারিস প্রার্থিতার ঘোষণা দেওয়ার পর থেকেই জনমত জরিপে ট্রাম্পের ওপর সামান্য হলেও এগিয়ে আছেন। আগস্ট মাসের শেষের দিকে তার জনপ্রিয়তা প্রায় চার শতাংশ বাড়ে। সেপ্টেম্বর ও অক্টোবরের শুরুতে এই জনপ্রিয়তা স্থিতিশীল থাকলেও শেষের দিকে তা কিছুটা কমে এসেছে।

তবে, জাতীয় পর্যায়ের জনমত জরিপ যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনী ফলাফলের সঠিক পূর্বাভাস দিতে পারে না। কারণ দেশটির নির্বাচনী ব্যবস্থায় ইলেক্টোরাল কলেজ ব্যবস্থায় নির্ধারিত হয় কে হবে পরবর্তী প্রেসিডেন্ট। ইলেক্টোরাল কলেজে ৫৩৮টি ভোটের মধ্যে যিনি ২৭০ ভোট পাবেন তিনিই প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হবেন। যুক্তরাষ্ট্রের ৫০টি অঙ্গরাজ্যের অধিকাংশই সাধারণত একটি নির্দিষ্ট দলকেই ভোট দেয়। ফলে মাত্র কয়েকটি রাজ্যেই উভয় প্রার্থীর জয়ের সম্ভাবনা থাকে। এই রাজ্যগুলো 'দোদুল্যমান' বা 'সুইং স্টেট' বলা হয় এবং সেগুলোই নির্বাচনের মূল লড়াইয়ের ময়দান।

বর্তমানে অ্যারিজোনা, জর্জিয়া, মিশিগান, নেভাদা, নর্থ ক্যারোলাইনা, পেনসিলভেনিয়া ও উইসকনসিন—এই সাতটি দোদুল্যমান রাজ্যে উভয় প্রার্থীর মধ্যে জনপ্রিয়তায় খুব সামান্য পার্থক্য রয়েছে। জনমত জরিপে দেখা গেছে যে, এই রাজ্যগুলোয় হ্যারিস এবং ট্রাম্পের জনপ্রিয়তার ফারাক এতটাই কম, কোন প্রার্থী এগিয়ে আছেন তা বলা কঠিন।

প্রত্যেক ভোটারকে তাদের পক্ষে আনতে এবং সামান্যতম সুবিধা অর্জন করতে উভয় প্রার্থীই চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। তবে এই নির্বাচনে, শুধু বক্তব্য নয়, প্রার্থীদের ব্যক্তিগত আচার-আচরণ এবং অতীত কর্মকাণ্ডও ভোটারদের সিদ্ধান্তকে প্রভাবিত করছে।

জরিপগুলোর ত্রুটি বিচ্যুতি তিন থেকে চার শতাংশ পর্যন্ত হতে পারে, ফলে বাস্তবে দুই প্রার্থীর অবস্থান জরিপে দেখানো অবস্থার চেয়ে ভিন্নও হতে পারে। মিশিগানে আরব আমেরিকান সম্প্রদায়ের ভোট খুবই গুরুত্বপূর্ণ এবং কমলা হ্যারিস তাদের মনোযোগ কেড়ে নিতে সেখানে বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছেন।

ইসরায়েলের গাজা এবং লেবাননের ওপর চালানো সামরিক অভিযানগুলোর ‘ধ্বংসাত্মক’ প্রভাব সম্পর্কে তিনি কথা বলেছেন। এই ধরনের বক্তব্য দিয়ে হ্যারিস ওই সম্প্রদায়ের প্রতি সহানুভূতি দেখাতে চাইলেও অনেক আরব আমেরিকান মনে করছেন, শুধু সহানুভূতিশীল ভাষা যথেষ্ট নয়; বরং প্রয়োজন আরও সুসংহত ও কার্যকর পদক্ষেপ।

আরব আমেরিকানরা হ্যারিসের বক্তব্যের প্রশংসা করলেও, তারা প্রশ্ন তুলছেন তার আসল পদক্ষেপের বিষয়ে। তারা মনে করছেন, এই সম্প্রদায়ের বাস্তব সমস্যাগুলো সমাধানে হ্যারিসকে আরও বেশি সরাসরি নীতিমালা এবং কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে।

২০১৬ সালে নির্বাচনের কয়েকদিন আগেই অনেক ভোটার তাদের মত পরিবর্তন করেছিলেন। এছাড়া, উচ্চশিক্ষিত ভোটাররা জরিপে অধিক প্রতিনিধিত্ব করায় হিলারি ক্লিনটনের সমর্থন বেশি দেখানো হয়েছিল। ২০২০ সালের নির্বাচনের জরিপেও ভুল ছিল, যেখানে বলা হয়েছিল যে, ট্রাম্প সমর্থকেরা জরিপে অংশ নিতে আগ্রহী ছিলেন না।

বিশেষজ্ঞরা এটিও উল্লেখ করেন যে, মহামারির সময় এই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ায় এবং রেকর্ড ভোটার অংশগ্রহণের কারণে প্রচুর চ্যালেঞ্জ ছিল। তবে, ২০২২ সালের মধ্যবর্তী নির্বাচনে জরিপগুলো মোটামুটি সফল প্রমাণিত হয়েছিল। বিশ্লেষকদের মতে, জরিপে যথেষ্ট পরিবর্তন আনা হয়েছে এবং সম্ভাব্য ত্রুটিগুলো হ্রাস করার জন্য বেশকিছু পদক্ষেপও নেওয়া হয়েছে।

মধ্যপ্রাচ্যের ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংকট এবং ইউক্রেন যুদ্ধও এই নির্বাচনের ফলাফলের ওপর প্রভাব ফেলতে পারে। ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংঘাত অনেক আমেরিকান ভোটারের আবেগকে প্রভাবিত করেছে, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের ইহুদি এবং মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে। মধ্যপ্রাচ্যের এই সংকট প্রার্থী নির্বাচনে ভোটারদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারে।

একইভাবে, ইউক্রেন সংকটও হ্যারিস এবং ট্রাম্পের জন্য চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে। বাইডেন প্রশাসন ইউক্রেনকে সমর্থন দেওয়ার পক্ষপাতী এবং এই কারণেই কমলা হ্যারিস ইউক্রেনের পক্ষে সমর্থন জানিয়েছেন। তবে, ট্রাম্প প্রশাসন বরাবরই ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ নীতি অনুসরণে জোর দিয়েছে।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মোট জনসংখ্যার তুলনায় মুসলিম জনগোষ্ঠী সংখ্যালঘু হলেও তাদের অবস্থান নির্বাচনের ক্ষেত্রে প্রভাব ফেলতে পারে। মুসলিম ভোটারদের সমর্থন বিশেষ করে ডেমোক্র্যাটিক প্রার্থীদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। মুসলিম জনগোষ্ঠী ডেমোক্র্যাটিক পার্টির প্রতি কিছুটা ঝুঁকে থাকলেও ২০২৪ সালের নির্বাচনে তাদের ভোটকে কোনো পক্ষই অবহেলা করতে পারবে না। ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংকটের মতো আন্তর্জাতিক ইস্যুগুলোর জন্য মুসলিম ভোটারদের সংবেদনশীলতা থাকতে পারে।

কমলা হ্যারিস যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ এবং ভারতীয় বংশোদ্ভূত নারী হিসেবে ভাইস-প্রেসিডেন্ট পদে আসীন হওয়ার পরই অনেকের নজরে এসেছেন। তিনি শক্তিশালী কর্মসূচি নিয়ে ভোটারদের মনোযোগ আকর্ষণ করেছেন। হ্যারিস তার প্রচারণায় শ্রম অধিকার, স্বাস্থ্যসেবা সংস্কার এবং জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলার ওপর জোর দিয়েছেন, যা তরুণ ভোটারদের মাঝে সাড়া ফেলেছে।

অন্যদিকে ডোনাল্ড ট্রাম্প তার ‘মেক আমেরিকা গ্রেট এগেইন (Make America Great Again)’ স্লোগান নিয়ে রিপাবলিকান ভোটারদের মাঝে শক্তিশালী অবস্থান ধরে রেখেছেন। তিনি জোর দিয়ে বলেছেন যে, তিনি ‘অভিজাতদের বিরুদ্ধে’ সাধারণ মানুষের পক্ষে লড়ছেন। ট্রাম্পের সমর্থকরা তার বিরুদ্ধে হওয়া রাজনৈতিক বিতর্ক ও বিচারকে রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র হিসেবে দেখে এবং তারা তাকে দেশের পুনরুদ্ধারকারী হিসেবে মনে করেন।

মার্কিন নির্বাচনে অভিবাসী ভোটারদের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। অভিবাসী জনগোষ্ঠী, বিশেষ করে লাতিনো ও এশীয় ভোটাররা, যুক্তরাষ্ট্রের ভোটার হিসেবে নিজেকে প্রমাণ করেছেন এবং আগামী নির্বাচনে তাদের প্রভাব ক্রমেই বাড়ছে।

২০১৬ সালে নির্বাচনের কয়েকদিন আগেই অনেক ভোটার তাদের মত পরিবর্তন করেছিলেন। এছাড়া, উচ্চশিক্ষিত ভোটাররা জরিপে অধিক প্রতিনিধিত্ব করায় হিলারি ক্লিনটনের সমর্থন বেশি দেখানো হয়েছিল....

ট্রাম্প প্রশাসনের কঠোর অভিবাসন নীতি ও ডেমোক্র্যাটিক পার্টির তুলনামূলক উদার অবস্থানের কারণে অনেক অভিবাসী ট্রাম্পের বিপক্ষে থাকতে পারেন। তৃতীয় দলের প্রার্থীরাও এ নির্বাচনে কিছুটা প্রভাব ফেলতে পারে। কয়েকটি রাজ্যে নিরপেক্ষ এবং স্বাধীন প্রার্থীরা কিছু ভোট কেড়ে নিতে পারে। যদিও মূল লড়াই ট্রাম্প এবং হ্যারিসের মধ্যেই হবে, কিছু নিরপেক্ষ ভোটার প্রভাব ফেলতে পারে যা সংকটপূর্ণ দোদুল্যমান রাজ্যগুলোয় ফলাফল নির্ধারণে সহায়ক হতে পারে।

জাতীয় পর্যায়ের জনমত জরিপে এগিয়ে থাকা অনেক ক্ষেত্রেই মোট ভোটের নির্দেশনা দেয়, তবে তা ইলেক্টোরাল কলেজের ফলাফলের ওপর প্রভাব ফেলে না। এই কারণে হ্যারিস বা ট্রাম্প উভয়ের জয় নিশ্চিত করতে হবে দোদুল্যমান রাজ্যগুলোয়। নির্বাচনের চূড়ান্ত ফলাফলের জন্য আমেরিকান ভোটারদের হৃদয় ও মন জয় করতে হবে।

যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচন সবসময়ই একটি জটিল প্রক্রিয়া এবং এবারের নির্বাচনেও অনিশ্চয়তা বজায় রয়েছে। হ্যারিসের মতো একজন নারী প্রার্থী যেখানে ইতিহাস তৈরি করতে যাচ্ছেন, সেখানে ট্রাম্প তার সমর্থন ঘাঁটির ওপর নির্ভর করে আবারও প্রেসিডেন্ট পদে ফিরে আসতে চাইছেন।

উভয় প্রার্থীর ভিন্ন ভিন্ন প্রচারণার কৌশল থাকা সত্ত্বেও, নির্বাচন কার পক্ষে থাকবে তা এখনো নির্ধারণ করা কঠিন। ট্রাম্পের কঠোর ভাষা ও আক্রমণাত্মক মনোভাব তার সমর্থকদের উজ্জীবিত করেছে, তবে এর ফলে কিছু জনগোষ্ঠীর মধ্যে অসন্তোষও দেখা দিয়েছে।

অন্যদিকে, হ্যারিস বৈচিত্র্যময় জনগোষ্ঠীকে টানতে চাইলেও, অনেকেই তার বক্তব্যকে যথেষ্ট মনে করছেন না। নির্বাচনের শেষ মুহূর্তের লড়াইয়ে উভয় প্রার্থীই ভোটারদের আস্থা অর্জনের চেষ্টা করছেন, যা আমেরিকার ভবিষ্যতের ওপর প্রভাব ফেলবে।

অধ্যাপক ড. সুজিত কুমার দত্ত ।। সাবেক সভাপতি, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়