ছবি : সংগৃহীত

গণতন্ত্র বর্তমান বিশ্বে সবচেয়ে সুশ্রাব্য এবং রাজনীতিতে বহুল ব্যবহৃত একটি শব্দ। এটি এমন একটি প্রচলিত ও সর্বজনীনভাবে সবার কাছে গ্রহণযোগ্য শাসনব্যবস্থা, যেখানে জনগণই প্রকৃত ক্ষমতার অধিকারী এবং তাদের ইচ্ছা ও মতামতের ভিত্তিতেই সরকার পরিচালিত হয়।

গণতন্ত্রের খুবই গুরুত্বপূর্ণ কিছু বৈশিষ্ট্য রয়েছে, যার মধ্যে স্বাধীন ও নিরপেক্ষ নির্বাচন, মত প্রকাশের স্বাধীনতা, আইনের শাসন এবং মানবাধিকার ও স্বাধীনতা ভোগ অন্যতম। তবে বাস্তবিক অর্থে, এইসব বৈশিষ্ট্যের যথাযথ বাস্তবায়ন আমরা প্রত্যক্ষ করতে পারি না এবং তা সম্ভব হয়েও উঠে না, যদিও এটা খুব জরুরি। কিন্তু কেন তা সম্ভব হয়ে ওঠে না?

বাংলাদেশের মতো রাষ্ট্রগুলো কেন গণতন্ত্র সফলভাবে প্রতিষ্ঠা করতে পারছে না? কেনইবা কোনোদিন পারেনি? স্বাধীনতার অর্ধশতাব্দী পেরিয়ে গেলেও আমাদের দেশে কোথায় গণতন্ত্র? আমরা প্রায়ই স্বপ্ন দেখি এবং কথিত বুদ্ধিজীবীদের মার্কিন আদলে শাসনতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আহ্বান করতে শুনি। তবে বাস্তবতা বিশ্লেষণের সময় হয়তো সংবাদকর্মীরা দেন না, কিংবা তারাও যথেষ্ট পরিমাণে ধৈর্য ধারণ করতে পারেন না।

এমনও হতে পারে যে, বাংলাদেশে বসবাসরত জনগণ আসলে গণতন্ত্র কখনোই চায়নি। আবার এমনও হতে পারে যে, আপনি শুনলেন আপনার এলাকায় নতুন একটি রেস্তোরাঁ হয়েছে, যেখানে সুস্বাদু বিদেশি খাবার পাওয়া যায়। চারিদিকে তার প্রশংসা শোনা যাচ্ছে। আপনি উৎসাহ নিয়ে সেটি খেতে গেলেন। খেলেনও। কিন্তু কেন যেন তা আপনার মন ভরলো না।

আপনার জন্ম থেকে গড়ে ওঠা খাদ্যাভ্যাসের স্বাদ সেই খাবারটির সঙ্গে মেলেনি। অথচ এটি ইতিমধ্যেই সামাজিক স্বীকৃতি পেয়েছে এবং মর্যাদার প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছে। এর সমালোচনা করলে হয়তো সামাজিকভাবে প্রত্যাখ্যাত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। বাংলাদেশের গণতন্ত্রের বিষয়টি কিছুটা এমনই।

ইমানুয়েল কান্ট (Immanuel Kant) ও জন স্টুয়ার্ট মিল (John Stuart Mill)-এর মতো দার্শনিকেরা মানুষকে কখনোই মাধ্যম হিসেবে নয়, বরং উদ্দেশ্য হিসেবে দেখেছেন। অর্থাৎ, মানুষ চায় না যে সে নিজে কারও স্বার্থে ব্যবহৃত হোক। তারা চায়, তাদের পারিপার্শ্বিকতায় তাদের মতামতের প্রতিফলন ঘটুক।

হয়তো সব মতামত গ্রহণ করা সম্ভব নয়, কিন্তু এমন একটি গণতান্ত্রিক পরিবেশ থাকা উচিত যেখানে সবাই মত প্রকাশের স্বাধীনতা ভোগ করতে পারে এবং সেই মতামত গুরুত্ব সহকারে শোনা হয়। প্রশ্ন জাগে, বাংলাদেশের সুদীর্ঘ ইতিহাসে কখনো এদেশের মানুষ কোনো শাসক বা রাজনৈতিক দলের দ্বারা ব্যবহৃত হয়নি? ক্ষমতালোভী শাসক ও রাজনৈতিক দলগুলোর স্বার্থে ব্যবহৃত হওয়ার উদাহরণ বাংলার ইতিহাসে খুবই পরিচিত।

দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে যে পরিমাণ ক্ষোভ ও অভিযোগ প্রকাশ করতে দেখা যায়, রাজনৈতিক অধিকার নিয়ে কি তারা ততটাই উদ্বিগ্ন?

সম্প্রতি আমাদের অভিজ্ঞতা বলছে, প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচন এবং সর্বজনীন ভোটাধিকার ক্ষুণ্ন হওয়ার বিষয়টি আমাদের দেশের জনগণকে খুব একটা উদ্বিগ্ন করেনি। তাদের মধ্যে ভোট প্রদানের ব্যাপারে গভীর আগ্রহ লক্ষ্য করা যায়নি; বরং তারা নির্বাচন থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। তাহলে কি বিষয়টি এমন দাঁড়ায় যে, বাংলার মানুষ ভোটাধিকারকে তাদের মৌলিক চাহিদা হিসেবে দেখে না?

দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে যে পরিমাণ ক্ষোভ ও অভিযোগ প্রকাশ করতে দেখা যায়, রাজনৈতিক অধিকার নিয়ে কি তারা ততটাই উদ্বিগ্ন? তাহলে কি ধরে নিতে হবে, এদেশের মানুষ এখনো গণতান্ত্রিক অধিকারকে মৌলিক চাহিদা হিসেবে বিবেচনা করে না? অথবা, এমনও হতে পারে যে সামাজিক ন্যায়বিচারের মতো জটিল বিষয়গুলো এখনো তাদের বোধগম্য নয়।

এখানে অন্যের রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহৃত হওয়াকে মানুষ এখনো অসম্মানের চোখে দেখে না। হতে পারে, এদেশের মানুষের মাঝে এক ধরনের গোষ্ঠীগত মানসিকতা বা ডোরম্যাট সিনড্রম (Doormat syndrome) রয়েছে। যারা এই মানসিকতা বা ধারণা সম্পর্কে তারা জানেন না, তাদের উদ্দেশ্যে বলা যায়, ডোরম্যাট অর্থাৎ পাপোশ হলো এমন কিছু যেখানে পা মোছা হয়। ডোরম্যাট সিনড্রম অর্থ হলো—এমন একজন ব্যক্তি, যিনি অন্যের স্বার্থে ব্যবহৃত হতে বা পদদলিত হতে আপত্তি করেন না।

এ বিষয়টি আরেকটি দৃষ্টিকোণ থেকেও ব্যাখ্যা করা যায়। সক্রেটিস (Socrates), প্লেটো (Plato), রুশো (Jean-Jacques Rousseau), এমনকি জন রলস (John Rawls)-এর মতো আধুনিক দার্শনিকেরা বারবার বলেছেন, সামাজিক ন্যায়বিচারই প্রকৃত ন্যায়বিচার। তাদের মতে, সর্বজনীন ভোটাধিকার প্রয়োগের মাধ্যমে রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় সবার অংশগ্রহণ নিশ্চিত হয় এবং এর ফলে ক্ষমতার ভারসাম্য প্রতিষ্ঠিত হয়। ক্ষমতার ভারসাম্য প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য হলো একটি নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর হাতে ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত না হওয়া।

অথচ বাংলাদেশের কথিত সফল নির্বাচনগুলো বারবার ধনিকতন্ত্রের রূপ নিয়েছে। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, যা মানুষের নাভিশ্বাস তুলে রেখেছে এবং রাজনৈতিক অধিকারকে সৌখিন হিসেবে প্রতীয়মান করেছে, সেটিও এই সামাজিক ন্যায়বিচারের অভাবের কারণেই। এই অভাব আবার রাজনৈতিক সচেতনতার অভাব থেকেই উদ্ভূত। এটি এক নিষ্ঠুর চক্র।

এই চক্রের সঙ্গে প্রখ্যাত রাষ্ট্রবিজ্ঞানী পলিবিয়াস (Polybius)-এর রাজনৈতিক ব্যবস্থা চক্র (Anacyclosis) মিলে যায়। পলিবিয়াসের মতে, এই চক্রটি রাজতন্ত্র দিয়ে শুরু হয়, যেখানে একজন সৎ ও শক্তিশালী নেতা জনগণের কল্যাণে শাসন করেন। কিন্তু সময়ের সঙ্গে শাসন দুর্নীতিগ্রস্ত হয়ে স্বৈরতন্ত্রে পরিণত হয়। জনগণের বিদ্রোহের মাধ্যমে তা ভেঙে পড়ে এবং অভিজাততন্ত্রের উদ্ভব ঘটে।

এরপর এই ব্যবস্থাও অলিগার্কি বা স্বৈরতন্ত্রে রূপ নেয়, যেখানে ক্ষমতাধর গোষ্ঠী নিজেদের স্বার্থে শাসন করে, যা এক সময় জনগণের দ্বারা প্রত্যাখ্যাত হয়। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হলেও এক পর্যায়ে তা জনতার উচ্ছৃঙ্খল শাসনে পরিণত হয় এবং অরাজকতা সৃষ্টি হয়।

তারপর আবার একজন শক্তিশালী নেতার প্রয়োজন হয়, এবং রাজতন্ত্রের পুনরুত্থান ঘটে। এই নেতার রূপ অনেকটা জনতুষ্টিবাদী নেতা (পপুলিস্ট) বা জননায়ক (ডেমাগগ)-এর মতো যিনি জনগণের আবেগ, ভয় বা পূর্বাগ্রহ কাজে লাগিয়ে সাধারণত বাস্তবসম্মত নীতির চেয়ে জনপ্রিয় স্লোগান দিয়ে ও প্রলোভন দেখিয়ে তাদের সমর্থন আদায় করেন।

পলিবিয়াসের মতে, এই চক্রটি রাজতন্ত্র দিয়ে শুরু হয়, যেখানে একজন সৎ ও শক্তিশালী নেতা জনগণের কল্যাণে শাসন করেন। কিন্তু সময়ের সঙ্গে শাসন দুর্নীতিগ্রস্ত হয়ে স্বৈরতন্ত্রে পরিণত হয়। জনগণের বিদ্রোহের মাধ্যমে তা ভেঙে পড়ে এবং অভিজাততন্ত্রের উদ্ভব ঘটে।

বাংলাদেশের রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের ধারাবাহিকতা এই চক্রের সঙ্গে মিলে যায়। এখন যেহেতু ক্ষমতা রাজনৈতিক দলের হাতে নয়, অন্যদের হাতে, তার মানে কি আমরা আবার আরেকটি স্বৈরাচারী ডেমাগগের উত্থান দেখতে যাচ্ছি? তাহলে আমাদের স্বপ্নের গণতন্ত্রের কী হবে?

আমার মনে হয়, যদি গণতন্ত্র চাই, তবে সত্যিকারের গণতন্ত্রের জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। যখন গণতন্ত্র পাওয়া যাবে, তখন এর দায়ভার গ্রহণ করতে হবে। রাজপথে দাবি আদায়ে সক্রিয় না হয়ে আইনসভায় আওয়াজ তোলার মানসিকতা গড়ে তুলতে হবে।

যেদিন আমরা এই মনোভাব গড়ে তুলব, সেদিনই গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা হবে। সংবিধান নিজেই খাঁটি ও নির্ভেজাল হয়ে উঠবে। পেঁয়াজের দাম কমাতে লোক দেখানো অভিযান চালানোর প্রয়োজন হবে না, কারণ সর্বত্র রাজনৈতিকভাবে সচেতন মানুষ বিরাজ করবে, যাদের বোকা বানানো সম্ভব হবে না।

ড. এ কে এম মাহমুদুল হক ।। অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়