ছবি : সংগৃহীত

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে একটি ভিডিও ক্লিপ ঘুরে বেড়াচ্ছে সবার ওয়ালে ওয়ালে। শুরুতেই দেখা যাচ্ছে ‍টানা দ্বিতীয়বার সাফ শিরোপা জয়ের অন্যতম দুই কারিগর ঋতুপর্ণা চাকমা ও রূপনা চাকমা নাচ করছেন তুমুল উচ্ছ্বাসে। আর মুখে বলছেন, ‘চ্যাম্পিয়ন, চ্যাম্পিয়ন …’, ‘ইয়ো’, ‘ইয়ো’।

এর অল্প কিছুক্ষণ পর দুই চাকমা নন্দিনীর সঙ্গে নাচে যোগ দেন সদ্য সাফ বিজয়ী দলের ডিফেন্স জেনারেলখ্যাত মাসুরা পারভিন। একইভাবে ‘চ্যাম্পিয়ন’, ‘চ্যাম্পিয়ন’ বলতে থাকেন মাসুরা। পাহাড়–সমতলে কোনো ভেদ নাই। কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে দেশের জন্য লড়াই করতে হবে, এই সত্যাটিই নতুন করে স্মরণ করিয়ে দিলেন আমাদের চ্যাম্পিয়ন কন্যারা।

বাংলাদেশ মানেই যেন ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বিভেদ আর বিভক্তির জনপদ। রাজনৈতিক তো বটেই এই বিভাজনের অন্যতম অনুষঙ্গ আঞ্চলিকতাও। পাহাড় অশান্ত, বাঙালি–পাহাড়ি দ্বন্দ্ব, পাহাড়ে ভাতৃঘাতি যুদ্ধ, এগুলো প্রায়ই দেখা যায়। পরস্পরকে দোষারোপ করা, অভিযোগ পাল্টা অভিযোগ, এগুলো যেন আমাদের রক্তের সঙ্গে মিশে আছে।

এত বিভক্তির জনপদ, এক হয়ে উঠবে কীভাবে, এ প্রশ্নের যেন কোনো উত্তর হয় না। সেইদিক থেকে বলা যেতে পারে বাংলাদেশ নারী ফুটবলাররা জন্ম দিয়েছে নতুন সাংস্কৃতিক বিপ্লবের। গড়ে তুলেছে বহুত্বের এক বিনে সুতোর মালা।

পুরো দেশকে পরিণত করেছে পাহাড়-সমতল সর্বোপরি শ্রেণি-ধর্ম-বর্ণ–ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীদের মিলনমেলায়। নিজেদের জীবনীশক্তির সবটুকু ঢেলে দিয়ে লাল-সবুজের বিজয় কেতন ওড়ানোর নতুন দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে আমাদের নারী ফুটবলাররা। এক কথায়, আমাদের নারী ফুটবল ‍দল হয়ে উঠেছে জাতীয় ঐক্যের প্রতীক।

২০২৪ সালের সাফ আসরে বাংলাদেশ কতটা প্রতিকুল অবস্থার মধ্যে ছিল বোধকরি তার কোনো সীমা পরিসীমা নেই। ২০২২ সালের শিরোপা জয়ের পর কার্যত ঝড় বয়ে গেছে নারী ফুটবল দলের ওপর দিয়ে। মাসের পর মাস ক্যাম্প আর অনুশীলন করে গেলেও আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলার সুযোগ মেলেনি মেয়েদের।

এর মধ্যে ২০২৩ সালে মিয়ানমারে টুর্নামেন্ট খেলার সব আয়োজন চূড়ান্ত হওয়ার পরও খেলতে যেতে পারেনি মেয়েরা। হোটেল আর প্লেন ভাড়ার টাকার অভাবে মিয়ানমারে খেলা বাতিল করা হয়েছে। ক্ষোভে দুঃখে জাতীয় দল থেকে অবসরে চলে যান বেশ কয়েকজন ফুটবলার। অথচ এদের বয়স ছিল মাত্র ২০ থেকে ২২ এর মধ্যে। এই অকাল অবসরে চলে যাওয়াদের মধ্যে ছিলেন গত আসরের ৪ গোল করা ফরোয়ার্ড সিরাত জাহান স্বপ্না, দেশসেরা ডিফেন্ডার খ্যাত আঁখি খাতুন।

নিজেদের জীবনীশক্তির সবটুকু ঢেলে দিয়ে লাল-সবুজের বিজয় কেতন ওড়ানোর নতুন দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে আমাদের নারী ফুটবলাররা। এক কথায়, আমাদের নারী ফুটবল ‍দল হয়ে উঠেছে জাতীয় ঐক্যের প্রতীক।

জাতীয় দলের এমন একটা ঘর ভাঙার সময়ে বড় আঘাত হয়ে আসে কোচের পদ থেকে গোলাম রব্বানী ছোটনের চলে যাওয়া। যথাযথ মূল্যায়ন না পেয়ে নারী ফুটবলের কোচ থেকে পদত্যাগ করেন তিনি। অথচ বাংলাদেশ নারী ফুটবল আর ছোটন যেন একে অপরের সমার্থক। নিজের সবটুকু আবেগ–ভালোবাসা দিয়ে নিজ সন্তানের মমতায় প্রত্যন্ত অঞ্চলের কাদামাটিসম মেয়েদের খাঁটি সোনা বানিয়েছেন ছোটন।

এত বড় ধাক্কা সামলে মাত্র এক বছরের মধ্যে মেয়েরা আরেকটি সাফে সর্বোচ্চ সাফল্য পাবে কিনা বড় হয়ে ওঠে সেই প্রশ্নটিই। একে তো দলের বেশ কয়েকজন অপরিহার্য প্লেয়ার নেই, তার সঙ্গে যোগ হয়, আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলার সুযোগ না পাওয়া। তারপরও মেয়েদের অদম্য ইচ্ছার কাছে হার মেনেছে সব খামতি, ঘাটতি।

এই যে হার না মানা অদম্য ইচ্ছা এর মূলে ঐক্য, কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়াইয়ের প্রতিজ্ঞা। তাতেও কী রেহাই পেয়েছে? অন্তর্কলহে জড়িয়ে পড়া, ব্লেম গেম দেওয়া, এগুলো থেকে আমরা মুক্ত হবো কীভাবে? নেপালে সাফ মিশনে মাঠের লড়াইয়ে নামতেই শুরু হয়ে গেল যত সব কুট–কাঁচালি। আর এগুলো সব হয়েছে মাঠের বাইরে।

বড়দের সর্বনাশা ‘ইগো’ তৈরি করে এক টালমাটাল পরিস্থিতি। এমন দুঃসময়ে দলীয় ঐক্য ধরে রাখার জন্য প্রাণপাত করেন আমাদের মেয়েরা। তাদের জোরালো ভূমিকার কারণে সরে যায় দুঃস্বপ্নের কালো মেঘ। হেসে ওঠে মেঘমুক্ত ঝকঝকে রোদ। দলীয় ঐক্য অটুট রাখার জন্য এগিয়ে আসেন মনিকা চাকমা, সাবিনা খাতুনরা।

এবারের সাফে বাংলাদেশের শুরুটা মোটেও ভালো হয়নি। পাকিস্তানের সঙ্গে কোনো রকমে ড্র করে সাবিনারা। অথচ সর্বশেষ আসরে পাকিস্তানকে ৬-০ গোলে হারিয়েছিল লাল-সবুজের দল। স্বভাবতই পাকিস্তানের বিপক্ষে ম্যাচ নিয়ে শুরু হয় সমালোচনার ঝড়। এর পরদিন বোমা ফাটান মিডফিল্ডার মনিকা চাকমা।

তাদের কোচ পিটার বাটলার সিনিয়রদের পছন্দ করেন না, সংবাদ মাধ্যমে এমন অভিযোগ করেন মনিকা। তার ভাষায়, আমাদের হেড কোচ মারিয়া, মাসুরা আপু, কৃষ্ণাদি—তাদের পছন্দই করে না। তাদের নামাতেই চাননি। আমরা এনিয়ে কথাও বলেছিলাম কোচের সঙ্গে যে কেন তাদের নামাচ্ছেন না, আমরা যদি জিততে চাই, তাহলে ওদের অবশ্যই প্রয়োজন আছে। এরপরও কোচ মানেননি।’

পাকিস্তানের সঙ্গে ড্র করার পর বাংলাদেশকে মুখোমুখি হতে হয় শক্তিশালী ভারতের। বলা বাহুল্য এই আসরে সর্বাধিক পাঁচবারের চ্যাম্পিয়ন ভারত। আসরে টিকে থাকার জন্য এটা ছিল বাংলাদেশের জন্য ‘ডু অর ডাই’ ম্যাচ। এই ম্যাচে সিনিয়রদের বাইরে রাখেননি ইংলিশ কোচ পিটার জেমস বাটলার। এর সুফলও মেলে। দারুণভাবে উদ্দীপ্ত হয়ে ওঠে মেয়েরা।

ভারতকে ৩-১ গোলে বিধ্বস্ত করে সেমিফাইনালে উঠে আসে বাংলাদেশ। নিজেদের ভাঙন ঠেকিয়ে জীবনীশক্তির সবটুকু উজাড় করে দেয় মেয়েরা। ভারতকে এভাবে বিধ্বস্ত করার পর ট্রফি প্রাপ্য হয়ে ওঠে সাবিনা ব্রিগেডের। এরপর এই বাংলাদেশকে আটকে রাখার সাধ্য যেন কারোই ছিল না। তবে বিতর্ক তখনো শেষ হয়নি।

...ক্ষোভে দুঃখে জাতীয় দল থেকে অবসরে চলে যান বেশ কয়েকজন ফুটবলার। অথচ এদের বয়স ছিল মাত্র ২০ থেকে ২২ এর মধ্যে।

ভুটানের বিপক্ষে সেমিফাইনালের আগে বাংলাদেশ নারী দলের সাবেক কোচ গোলাম রব্বানী ছোটনকে নিয়ে বিস্ফোরক মন্তব্য করেন বর্তমান কোচ বাটলার। বলেন, ‘বাফুফের সঙ্গে সম্পৃক্ত কিছু লোক, সাবেক কোচ, মেয়েদের প্ররোচিত করে খেপিয়ে তোলার চেষ্টা করছে। ইংলিশ কোচ বাটলার কারও নাম উল্লেখ না করলেও তার অভিযোগের তীর যে ছোটনের দিকেই, সেটা পরিষ্কার।

ভারতকে হারানোর পর বাংলাদেশ অধিনায়ক সাবিনা জানান, ছোটনের একটি বার্তা তিনি সব খেলোয়াড়ের কাছে পৌঁছে দিয়েছিলেন। আর সেই বার্তাতেই দল উদ্দীপ্ত হয়ে ওঠে বলেও জানান সাবিনা। সেইসঙ্গে বলেন, ‘প্রত্যেকটি ম্যাচের আগে আমি চেষ্টা করি ছোটন স্যারের সঙ্গে একটু কথা বলার। কারণ, ১৪ বছরের সম্পর্ক ওনার সঙ্গে।’ এরপর, ভুটানকে হারিয়ে ফাইনাল নিশ্চিত করার পর ম্যাচসেরা হওয়া তহুরা খাতুন তার ট্রফি উৎসর্গ করেন সাবেক কোচ ছোটনকে।

তাদের প্রিয় ছোটন স্যারকে বাদ দিয়ে বাংলাদেশ নারী ফুটবল হয় না এটা বুঝিয়ে দেন সাবিনারা। বাটলারের করা কড়া মন্তব্যের কঠিন জবাব দেন সাবিনা। বলেন, ‘ব্যাপার হচ্ছে স্যারকে (ছোটন) নিয়ে উনি কতটুকু জানেন। আপনি তো তখনই তাকে নিয়ে কোনো মন্তব্য করবেন, যখন আপনি তার সম্পর্কে জানবেন।’

তাদের প্রিয় ছোটন স্যারকে বাদ দিয়ে বাংলাদেশ নারী ফুটবল সাধরণত দেখা যায় ঘর অশান্ত থাকে, এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে মাঠের পারফরম্যান্সে। উদ্দীপনা হারিয়ে যায়। কিন্তু বাংলাদেশের বীরকন্যাদের বেলায় এর ঠিক উল্টো চিত্র। ভারতকে ৩-১ গোলে বিধ্বস্ত করে সেমিফাইনালে ওঠার পর এ নিয়ে কথা বলেছেন লাল-সবুজ ব্রিগেডের অধিনায়ক সাবিনা খাতুন। জানান, ‘সমালোচনা থাকবেই। সমালোচনা কিংবা তর্ক-বিতর্ককে আমরা চ্যালেঞ্জ হিসেবে নেওয়া যায় এবং ভালো করা যায়। এটাকে আমরা ইতিবাচক হিসেবেই দেখি।’

বাংলাদেশ নারী ফুটবল দল একটা সুখী পরিবার জোর দিয়ে এমন কথা বলেন অধিনায়ক সাবিনা। আবেগঘন ভাষায় বলেন, ‘আমরা যেহেতু পরিবার ছেড়ে বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনে থাকি, ধরতে গেলে এটাই আমাদের পরিবার। আর এখানে আমরা সুখী পরিবার। মানুষ তো অনেক কিছুই বলে, সিনিয়র-জুনিয়র, এগুলো নিয়ে অনেক কিছু বলাবলি হচ্ছে, আসলে আমাদের মধ্যে ওরকম কিছু নেই।’

ঘর, মাঠ তো বটেই পুরো বাংলাদেশের নব বৈচিত্র্যকেই সরল আবেগ দিয়েই ধরে রেখেছেন সাবিনারা। এখানে পাহাড়ি মনিকা, রূপনার সঙ্গে তীব্র আনন্দে মেতে ওঠেন মাসুরাও। এক সুরে লাল-সবুজের কেতন ওড়ানোর দৃষ্টান্ত যেন আমাদের নারী ফুটবলাররা।

নাজমুল হক তপন ।। জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক