ছবি : সংগৃহীত

‘তার সাহিত্য গঙ্গা যমুনার মতো হিন্দু ও ইসলাম ঐতিহ্যর মিলন যেমন ঘটেছে তেমনি বাংলার সাধনার তিনটি ধারা শক্তি, বৈষ্ণব, লোকায়ত অর্থাৎ আউল বাউল ধারাও মিশে একাকার হয়ে গেছে।’ (বাংলা সাহিত্য নজরুল / আজহারউদ্দীন খান)

বিদ্রোহী ও প্রেমিক কবি, গীতিকার, কাজী নজরুল ইসলাম বেশকিছু ভক্তিগীতি রচনা করেছিলেন, যার মধ্য শ্যামা গীতি ও ইসলামি সংগীত উল্লেখযোগ্য। আদরের সন্তান বুলবুলের আকস্মিক মৃত্যুতে কবি শোকাহত হন, গানে আর্তনাদ করেন—‘শূন্য এ বুকে পাখি মোর আর ফিরে আয়’। শেষে অধ্যাত্ম সাধনায় তিনি শান্তি খোঁজেন।

যোগী বরদাচরণ মজুমদারের সান্নিধ্যে আসেন। মৃত পুত্রকে দেখতে চান, মন শান্ত হয় না। এই সময় শাক্তপদ রচনায় মনপ্রাণ ঢেলে দেন। আজহারউদ্দীনের মতে, নজরুল তার গানে হৃদয়ের দরদ এমন করে মিশিয়েছেন যে, রসের নিবিড়তায় তার গান ও রামপ্রসাদের গান প্রায় একাত্ম হয়ে গেছে।

নজরুল রচিত শ্যামাসংগীতগুলোর কিছু ‘গানের মালা’ ১৯৩৪ গ্রন্থে আছে। আর সবগুলো গান সংকলিত হয়েছে ‘রক্তজবা ১৯৬৬’ গ্রন্থে। এই সংকলন শুরু হয়েছে ‘বল রে জবা বল’ গান দিয়ে, আর শেষ হয়েছে ‘স্থির হয়ে তুই বস দেখি মা’ দিয়ে। পরে কিছু গান প্রকাশক এই সংকলনে যুক্ত করেছিলেন। আপাদমস্তক অসাম্প্রদায়িক, মানবতাবাদী কবি হিসেবে নজরুল এই জন্য জনপ্রিয় ও শ্রদ্ধার পাত্র হয়েছেন।

লেটোর দলে থাকার ফলে তিনি গানে যেমন উৎসাহী হয়েছিলেন, তেমনি হিন্দু-মুসলিম সংস্কৃতি সম্পর্কে অবহিত হন। হিন্দু পুরান নিয়ে পালাগান লিখতেন। এর ফলে শ্যাম শ্যামা ও ইসলামি গান লেখায় সমস্যা হয়নি। ইসলামি গান তিনি যখন লেখেন, ‘তোরা দেখে যা আমিনা মায়ের কোলে’, ‘ওই রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ’, ‘মোহাম্মদ মোর নয়নমণি’, তখন সেই লেখাতেও দরদ ফুটে ওঠে।

শক্তিসাহিত্য একদিকে তমাশ্রিত তাত্ত্বিক, অন্যদিকে বাৎসল্যরস ও ভক্তেরা সেখানে প্রাধান্য পেয়েছে। বিশেষত মাতৃভাব শক্তিপদাবলির মূল সুর। রামপ্রসাদ ও কমলাকান্ত শ্রেষ্ঠ শাক্ত গীতিকার, যাদের গানে আধ্যাত্মিকতা ও সমকাল মিশে গেছে, নজরুল ও সেই পথের পথিক।

তার ‘আনন্দময়ীর আগমনে’ মাতৃবন্দনা হয়েও রাজনৈতিক চেতনার কবিতা। যেখানে তার আর্তি—‘দেব শিশুদের মারছে চাবুক,/বীর যুবাদের দিচ্ছে ফাঁসি,/ভূভারত আজ কসাইখানা/আসবি কখন সর্বনাশী?’

স্বদেশি আন্দোলনের প্রেক্ষিতে চারণ কবি মুকুন্দ দাসও গেয়েছিলেন ‘মাতঙ্গী মেতেছে আজ সমরঙ্গে’ বঙ্কিম চন্দ্রের ‘বন্দে মাতরম’ তো শ্রেষ্ঠ মাতৃমন্ত্র ও বন্দনা। বাঙালির প্রিয় শক্তিগীতি শুধু নজরুল নন, তার আগেও অনেক মুসলিম কবি গান লিখেছিলেন।

মজার কথা এই, কিছু মুসলিম কবি একসময় হিন্দু নামে ভক্তিগীতি লিখতেন, যেমন কে. মল্লিক অর্থাৎ মুহাম্মদ কাশেম, কিছু হিন্দিগায়ক আবার মুসলিম নাম নিয়ে গাইতেন। যেমন, চিত্ত রায়, ধীরেন্দ্রনাথ দাস। এরা দিলওয়ার হোসেন, গনি মিয়া নামে গাইতেন।

বাংলাদেশের খ্যাতনামা হাসন রাজাও হিন্দু ভক্তিমূলক গান গেয়েছেন। ‘আমার হৃদয়েতে শ্রীহরি / আমি কি তোর যম-কে ভয় করি’; বা ‘ওমা কালী কালী গো! এতনি ভঙ্গী জানো। / কত রঙ্গ ঢঙ্গ করো যা ইচ্ছা হয় মন।’; বা ‘কে বুঝিতে পারে মায়ের অনন্ত ব্যাপার’।

যেসব মুসলিম কবি শ্যামসংগীত লিখেছেন, তাদের মধ্য প্রথম নাম সা বিরিদ খাঁ। চট্টগ্রামের মানুষ। লিখেছেন, বিদ্যাসুন্দর, রসুলবিজয়। এরপরে মুসলিম শাক্ত কবিরা হলেন—আলী রাজা, নওয়াজিস খান, মির্জা হোসেন আলী, আকবর আলী, সৈয়দ জাফর খাঁ প্রমুখ।

সৈয়দ জাফরের লেখা—কেন গো ধরেছ নাম দয়াময়ী তায় সৈয়দ জাফর তরে কী ধন রেখেছ ধরে সম্পদ দুখানি পদ হরের হৃদয়। কালীপ্রসন্ন উপাধি পাওয়া মুনশি বেলায়েত লেখেন, কালী কহে এই সত্য, সকলি দেখ অনিত্য, চিন্তা করো পরমার্থ ছেদন হবে ভব বন্ধন। মির্জা হুসেন রাজপ্রসাদী সুরে লেখেন, আমি তোমার কি ধার ধারি, শ্যামা মায়ের খাস তালুকে বসত করি।

বাউল লালনও গেয়েছেন ‘কোন প্রেমে মা কালী / পদতলে মহেশ্বর বলি।’ আচার্য দীনেশচন্দ্র সেনের প্রাসঙ্গিক উক্তি উদ্ধৃত করি আমি নিজে দেখিয়েছি, ত্রিপুরাবাসী গোলাম মাহমুদ স্বীয় দলবল লইয়া স্বরচিত কালীবিষয়ক নানা সংগীত ঝিঁঝিট রাগিণীতে আসরে গাইতেন। (প্রাচীন বাংলা সাহিত্য মুসলামানের অবদান।)

বর্তমানে কিছু ভেদবুদ্ধিসম্পন্ন সাম্প্রদায়িক মানুষ যখন সাম্প্রদায়িক পৈশাচিক উল্লাসে মত্ত, তখন কবি কাজী নজরুল ইসলামের শাক্তগীতি মনে পড়ে—ওমা, তোর ভুবনে জ্বলে এত আলো, আমি কেন অন্ধ হয়ে দেখি শুধু কালো?

আমরাও চাই এই অন্ধকার দূর হোক। তাই নজরুল আজও প্রাসঙ্গিক। নজরুলের শ্যামাসংগীতে ভক্তি ও আবেগ মিশে গেছে, সহজেই তা শ্রোতার মন ও হৃদয়ে প্রবেশ করে। বলেছেন, ‘ভক্তি আমার ধূপের মতো/ ঊর্ধ্বে ওঠে অবিরত।’

কখনো তার আঁখি জল জবাফুল হয়। মুক্তির আশা ‘এলোকেশ হয়ে পায়ে লুটায়।’ তাই মা এলোকেশী। অভিন্ন ভাবনায় এও বলেন, ‘আমার মনের দোতারাতে শ্যাম ও শ্যামা দুটি তার।’ বলেন, ‘মা যে আমার শবের মাঝে শিব জাগায়।’

করুণাময় গোস্বামী বলেছেন, ... শ্যামা সংগীত রচয়িতা রূপে রামপ্রসাদ সেন বা কমলাকান্ত ভট্টাচার্য সাংগীতিক নান্দনিকতায় যে স্তরে উত্তীর্ণ হয়েছিলেন, নজরুল তদপেক্ষা উচ্চস্তরে পৌঁছেছিলেন, তিনি পূর্ববর্তী সংগীত রচয়িতাদের চেয়ে মহৎ প্রতিভার অধিকারী ছিলেন। তার এই উক্তিতে আতিশয্য আছে, সন্দেহ নেই, তবে নজরুলের প্রতি শ্রদ্ধা কতখানি তাও বোঝা যায়।

শ্যামা মাকে রামপ্রসাদ কন্যারূপে দেখেছেন, নজরুলও। লিখেছেন, ‘আমার কালো মেয়ে রাগ করেছে, তারে কে দিয়েছে গালি? রাগ করে সে সারামুখে মেখেছে আজ কালি।’ কখনো প্রশ্ন করেছেন, ‘মা হবি না মেয়ে হবি।’ বলেছেন, ‘আদরিনী মোর শ্যামা মেয়ে।’ কখনো অভিমানে গেয়েছেন—বলরে জবা বল কোন সাধনায় পেলি রে তুই শ্যামা মায়ের চরণতল?

অনুভব করেছেন, ‘আমার মা আছে রে সকল নামে’ কিংবা বলেন, ‘মাগো আজ বেঁচে আছি তোরই প্রসাদ পেয়ে।’ ডাকেন, ‘মাগো, চিন্ময়ী রূপ ধরে আয়।’ শোক-তাপে অস্থির, নজরুল শ্যামা মাকে আশ্রয় করে গেয়েছেন, ‘শ্মশানে জাগিছে শ্যামা’ বলেছেন, ‘জ্বলিয়া মারিলি কে সংসার জ্বালায়, তাহারে ডাকিছে মা কোলে আয়, কোলে আয়’। মায়ের প্রতি এই আন্তরিক শরণাগতি ভাবনায় নজরুলের ভক্তি ও গান একাকার হয়ে গেছে।

ড. তরুণ মুখোপাধ্যায় ।। কবি ও প্রাবন্ধিক; অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক, বাংলা, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, ভারত