ছবি : সংগৃহীত

কয়েক বছর আগে নির্বাচনী আচরণ এবং প্রচারণা নিয়ে একটি গবেষণা করেছিলাম। উক্ত গবেষণাপত্রটি উপস্থাপনের জন্য তুরস্ক গেলাম। সেখানে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের নির্বাচন, রাজনীতি এবং গণতন্ত্রের আদ্যোপান্ত নিয়ে বিভিন্ন ধরনের গবেষণাপত্র উপস্থাপিত হয়।

বিভিন্ন দেশ থেকে আসা গবেষকগণ তাদের গবেষণাপত্রে বিশ্বব্যাপী নির্বাচন ও রাজনীতির গতি-প্রকৃতি তুলে ধরেন। সেখানে লক্ষ করা যায় যে, সংশ্লিষ্ট রাষ্ট্রগুলোয় নির্বাচনের ধরন ও প্রক্রিয়া রাজনীতির গতিপ্রকৃতির ওপর প্রভাব বিস্তার করে। এমনকি ওইসব গবেষণাপত্রে নির্বাচন ও গণতন্ত্রে অর্থের প্রভাব এবং এ বিষয়ে সহিংসতা সৃষ্টি ও আস্থা-অনাস্থার তথ্য উঠে আসে।

উল্লিখিত সম্মেলনে পরিষ্কারভাবে একটি সংশ্লেষণ তৈরি হয় যে নির্বাচনের সাথে সেই দেশের রাজনীতি এবং সহিংসতার নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে। এবং সেটি গোটা বিশ্বব্যাপী।

বর্তমানে বিশ্বব্যাপী গণতন্ত্র এবং নির্বাচন খুব বেশি আলোচিত শব্দযুগল। যেকোনো দেশের নির্বাচন প্রক্রিয়ার ধরন এবং প্রকৃতি রাজনীতির গতি নির্ধারণ করে থাকে। এক কথায় বলা যায়, নির্বাচন রাজনীতিকে প্রভাবিত করে। নির্বাচন নিয়ে সংঘর্ষ এবং হিংসাত্মক কর্মকাণ্ড যেন অঙ্গাঙ্গি বিষয় হয়েও দাঁড়িয়েছে গোট বিশ্বব্যাপী।

এ প্রসঙ্গে সারা বিশ্বের চিত্র প্রায় কাছাকাছি এবং অনেকটা একই। এই কর্মকাণ্ড যখন ভয়ঙ্কর পর্যায়ে পৌঁছে যাচ্ছে তখন আমরা শঙ্কিত হয়ে উঠছি। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে, ক্ষমতাসীন দল যদি মনে করে নিয়ন্ত্রণহীন সুষ্ঠু নির্বাচনে তাদের পরাজিত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে, তখন তারা প্রকাশ্যে কিংবা গোপনে নানা অজুহাতে সংঘর্ষ ও সংঘাত সৃষ্টি করে ভীতির রাজ্য স্থাপন করার চেষ্টা করছে—এমন অসংখ্য দৃষ্টান্ত রয়েছে। এর সাথে তারা তৈরি করে বেশকিছু আইন-কানুন যা দিয়ে ক্ষমতা আঁকড়ে থাকা যায়।

বিশ্বের বহু দেশে নির্বাচনী সংস্কার হয়েছে। রাজনৈতিক দলগুলো বারবার কমিটমেন্ট করছে—নির্বাচনকে অবাধ ও গ্রহণযোগ্য করে তোলার বিষয়ে। তারপরও কোনো না কোনোভাবে নির্বাচন প্রভাবিত হচ্ছে এবং প্রশ্নবিদ্ধও হয়েছে। বর্তমান সময়ে কাঙ্ক্ষিত পর্যায়ের গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় নির্বাচন কতটুকু ভূমিকা রাখছে—সেটি এখন অধিকভাবে ভেবে দেখার সময় এসেছে।

২০১২ সালে কেনেথ পি ভোগেল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করে ‘দ্য বিগ মানি’ শিরোনামে একটি বই লিখেছেন। সেখানে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের ডেমোক্রেসিকে ডলারোক্রেসি হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন। মূলত তিনি সেখানে বোঝাতে চেয়েছেন, তাদের নির্বাচনে ফান্ড তৈরি এবং নির্বাচনী ফলাফল নির্ধারণে ডলারের ভূমিকা অনেক বেশি।

...যুক্তরাষ্ট্রের ডেমোক্রেসিকে ডলারোক্রেসি হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন। মূলত তিনি সেখানে বোঝাতে চেয়েছেন, তাদের নির্বাচনে ফান্ড তৈরি এবং নির্বাচনী ফলাফল নির্ধারণে ডলারের ভূমিকা অনেক বেশি।

আমরা জানি কয়দিন পরেই যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। এ উপলক্ষে সেপ্টেম্বর থেকেই বিভিন্ন অঙ্গরাজ্যে আগে থেকেই চলছিল ভোট গ্রহণ। এতে অনেক সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে। ওরেগন ও ওয়াশিংটনে দুটি ব্যালট বাক্সে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। এতে কয়েক’শ কাস্ট করা ভোট নষ্ট হয়ে গেছে। দেশটির কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা এফবিআই এই দুটি ঘটনাকে পরস্পর যুক্ত বলে মনে করছে।

ওয়াশিংটন অঙ্গরাজ্যের ক্লার্ক কাউন্টির নির্বাচিত নিরীক্ষক গ্রেগ কিমসি বলেন, এটা হৃদয়বিদারক ঘটনা। তিনি আরও বলেন, এটি গণতন্ত্রের ওপর সরাসরি আঘাত। ব্যালট ড্রপ বাক্সে অগ্নিসংযোগের ঘটনার সমালোচনা এখন দেশজুড়ে। রিপাবলিকরা সমালোচনায় এগিয়ে। এ নিয়ে তারা আগের এক ষড়যন্ত্র তত্ত্ব সামনে আনছেন।

২০২০ সালের নির্বাচনে পরাজয়ের পর ট্রাম্প দাবি করেছিলেন, নির্বাচনে কারচুপি হয়েছে। যেসব দেশ গণতন্ত্রের রোল মডেল, যারা গণতন্ত্র পর্যবেক্ষণ করে, সেসব দেশেও কারচুপির প্রশ্ন ওঠে। আবার যারা গণতন্ত্রের সূচকে সর্বোচ্চ স্কোর অর্জন করে, তাদের নির্বাচনেও টুকটাক ব্যত্যয়ের ঘটনা রয়েছে। এজন্য নির্বাচনী গণতন্ত্র এমন এক প্রক্রিয়া যা হাতে নাতে কখনো ধরা যায় না।

বিশ্বব্যাপী রাজনীতি বিজ্ঞান ক্রমেই জটিল হচ্ছে। এ বিষয়ে বিস্তর হোমওয়ার্ক প্রয়োজন। মিডিয়া আগের চেয়ে অনেকটাই সক্রিয়। রাজনীতির সবটাই দেখছে এখন মিডিয়া। শাসক-বিরোধীর লড়াইটা কিংবা কোন রাজনীতিক হাতে কোন ব্র্যান্ডের ঘড়ি পরছেন—সবটাই দেখছে মিডিয়া এবং তা প্রচার করছে। তাই রাজনীতির হিসাবটা আরও কঠিন হয়েছে।

অতীত-বর্তমান ঘেঁটে বের করে আনতে হয় বিরোধী পক্ষের দুর্বল জায়গা। তারপর প্রস্তুতি নিয়ে আঘাত করতে হয় সেখানে। অক্লান্ত প্রক্রিয়া-থেমে থাকার পথ নেই। একজন যে রাজনৈতিক ক্রিয়া করবে, অন্যজন ঠিক তার বিপরীত প্রতিক্রিয়ার জন্য প্রস্তুতি নিয়ে রাখবে। কারণ ক্রিয়ার পরেই প্রতিক্রিয়ার উদ্ভব হবে।

তারপরও আমরা প্রত্যাশা করি বিশ্বের গণতান্ত্রিক দেশগুলো তাদের নির্বাচনী গণতন্ত্রের চর্চায় এগিয়ে যাবে সমানে। সুইডেন, সুইজারল্যান্ড, নরওয়ে, ফিনল্যান্ড—সবগুলোই জনসংখ্যার দিক থেকে ছোট ছোট দেশ। সেখানে একাধিক রাজনৈতিক দল সক্রিয়। তাদের মতপ্রকাশের পূর্ণ স্বাধীনতা রয়েছে।

সুইডেনের মতো দেশের গণতান্ত্রিক নীতিমালা অনুসরণ করলে যেকোনো দেশেই গণতন্ত্র কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় পৌঁছানোর রাস্তায় উঠতে পারে—এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। সুইডেনের গণতান্ত্রিক কাঠামোটি একটি সাংবিধানিক রাজতন্ত্রের ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে। যেখানে কার্যকর সংসদীয় গণতন্ত্র বিদ্যমান। সেখানে প্রতিনিধিত্বমূলক গণতন্ত্র চালু আছে।

বিভিন্ন দলের প্রার্থীরা সরাসরি ভোটের মাধ্যমে নির্বাচিত হন। কোনো দলকে সংসদে প্রবেশ করতে হলে জাতীয়ভাবে কমপক্ষে ৪ শতাংশ ভোট পেতে হয়, অথবা কোনো নির্দিষ্ট নির্বাচনী এলাকায় ১২ শতাংশ ভোট পেলেই তারা সংসদে প্রবেশ করতে পারে। সুইডেনের রাজা রাষ্ট্রপ্রধান হলেও তার হাতে কার্যত কোনো রাজনৈতিক ক্ষমতা নেই।

বারাক ওবামা প্রেসিডেন্ট প্রার্থিতার লড়াইয়ে ডেমোক্রেট প্রার্থী হিসেবে হিলারি ক্লিনটেনর কাছে বিজয়ী হয়েছিলেন। পরবর্তীতে বারাক ওবামা প্রেসিডেন্ট হয়ে হিলারিকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দিয়েছিলেন। অথচ প্রাথমিক নির্বাচনে দু’জনই দু’জনের সমালোচনায় ব্যস্ত ছিলেন।

প্রকৃত ক্ষমতা সংসদ এবং সরকারের মধ্যে বিভক্ত। সরকারের প্রধান হচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী, যিনি সংসদের সদস্যদের মাধ্যমে নির্বাচিত হন। সংসদ সদস্যরা আইন প্রণয়ন ও সরকারের কার্যক্রমের ওপর নজরদারি করেন। শক্তিশালী গণতান্ত্রিক কাঠামো সুইডেনকে একটি স্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিবেশ দিয়েছে।

তবে এই পরিবেশ সৃষ্টির মূল কারণ হলো সেখানে নাগরিকরা অতিমাত্রায় সচেতন এবং বিবেকবোধ সম্পন্ন। তারা কেবল আইনের মাধ্যমে নয়, নিজেদের নৈতিক চিন্তা ও বিবেক থেকে স্বাধীন ও যৌক্তিক ভূমিকা পালন করতে অভ্যস্ত।

অনেক সময় আমরা দুঃখ পাই, বাংলাদেশের রাজনৈতিক নেতারা একে অপরে কাদা ছোড়াছুড়ি করে। কিন্তু মজার বিষয় হলো—এমন পরিস্থিতি শুধু বাংলাদেশে নয়, গোটা বিশ্বব্যাপীই এ প্রক্রিয়া দৃশ্যমান। তাহলে আপনারাই বলুন, আইন করে কি এই কাদা ছোড়াছুড়ি রোধ করা যাবে? কখনোই নয়।

আমাদের নিজেদের বিবেক এবং চিন্তা যদি পরিশীলিত বা মার্জিত না হয় তাহলে কোনোভাবেই ইতিবাচক প্রত্যাশা তৈরি হবে না। আমরা অবাক হই যখন দেখি প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থীরা কাদা ছোড়াছুড়ি করছেন। আবার তাদের সহনশীল মানসিকতাও আমাদের অবাক করে। কারণ তাদের পারস্পরিক সহিষ্ণুতা যথেষ্ট যৌক্তিক পর্যায়ের।

তারা ব্যক্তিগত জীবনের রহস্য এবং গোপন জায়গায়ও আঘাত করতে দ্বিধা বোধ করেন না। তারপরও আমরা সেখান থেকে প্রত্যাশা করি একটি সহনশীল এবং গ্রহণযোগ্য মাত্রার রাজনীতি। আমরা সেখানে লক্ষ করে দেখি প্রাথমিক নির্বাচনে কে প্রার্থী হবেন, সেই লড়াইয়ে নিজের দলের ভেতরে যে গণতন্ত্র চর্চা এবং গণতান্ত্রিক মানসিকতার চর্চা দেখা যায় সেটি অনুকরণীয় কিংবা অনুসরণীয়।

আমরা দেখেছিলাম বারাক ওবামা প্রেসিডেন্ট প্রার্থিতার লড়াইয়ে ডেমোক্রেট প্রার্থী হিসেবে হিলারি ক্লিনটেনর কাছে বিজয়ী হয়েছিলেন। পরবর্তীতে বারাক ওবামা প্রেসিডেন্ট হয়ে হিলারিকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দিয়েছিলেন। অথচ প্রাথমিক নির্বাচনে দু’জনই দু’জনের সমালোচনায় ব্যস্ত ছিলেন। তারপরও বারাক ওবামার এমন উদার রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত গণতান্ত্রিক বিশ্বে মডেল হতে পারে।

কাজেই আমরা বাংলাদেশে যে কাঠামেই পছন্দ করি না কেন কিংবা যেমন আইনই তৈরি করি না কেন, অথবা যেমন সংস্কারই হোক না কেন, এগুলো বাস্তবায়নের মূলে রয়েছে নাগরিক এবং রাজনৈতিক দলগুলোর মানসিকতার পরিবর্তন। মানসিকতা পরিবর্তনের মধ্য দিয়েই একটি গ্রহণযোগ্য মানের উদার নির্বাচনী ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা পেতে পারে।

ড. সুলতান মাহমুদ রানা ।। অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
sultanmahmud.rana@gmail.com