ছবি : সংগৃহীত

প্রথমে একটা কৌতুক বলি। সোভিয়েত আমলের কৌতুক। রুটির দোকানের সামনে প্রচণ্ড ভিড়, লম্বা লাইন। এক লোক রুটির জন্য দুই ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে থেকে ক্লান্ত বিরক্ত হয়ে বলে, ধুর ঘোড়ার ডিম, আর সহ্য হচ্ছে না, আমি গেলাম—আজই ব্যাটা স্তালিনকে গুলি করবো আমি। লোকটা চলে গেছে, অন্যরা ঠিকই লাইনে দাঁড়িয়ে আছে রুটির জন্য।

আরও ঘণ্টা দুয়েক পর সেই লোকটা আবার রুটির দোকানের সামনে ফিরে এসে লাইনে দাঁড়ানো একজনকে বলল, ‘ভাই, আমি তো দুই ঘণ্টা আগে লাইনে আপনার আগে দাঁড়িয়েছিলাম, এখন কি আমি আপনার পেছনে দাঁড়াতে পারি প্লিজ!’ লাইনে দাঁড়িয়ে থাকা লোকটি বলল, ‘কেন, আপনি না গেলেন স্তালিনকে গুলি করতে!’ হতাশ লোকটি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, ‘ঐখানে লাইন আরও দীর্ঘ।’

আমাদের দেশে বাজারে জিনিসপত্রের সরবরাহে সে রকম কোনো সংকট নেই। তবে বাজারে পণ্যের দামের যে হাল সেটা তো আর মধ্যবিত্তকে ব্যাখ্যা করে বোঝানোর কিছু নেই। প্রতিদিন যেসব জিনিস মানুষের প্রয়োজন হয় নিতান্ত বেঁচে থাকার জন্য—চাল, ডাল, আলু, পটল, তেল, লবণ, দুধ, ডিম, চিনি প্রতিটা পণ্যের দাম নিম্নবিত্তের নাগালের বাইরে। মাছ-মাংসের দামের কথা আর বললাম না।

সাধারণ মধ্যবিত্ত-যারা সরকারি বেসরকারি চাকরি করে বা দোকানপাট চালায় বা ছোটখাটো ব্যবসা করে—ওদের মাসিক আয়ের অঙ্কটা নিয়ে বাজার মূল্যের সাথে একটা সমীকরণ করতে চেষ্টা করেন। মেলানো কঠিন হয়ে যাবে। শ্রমজীবী মানুষ যারা, গার্মেন্টস শ্রমিক বা অন্য কোনো শিল্পে কাজ করে এমন শ্রমিকরা, রিকশা যারা চালায়, যারা দিনমজুর হিসেবে কাজ করে ওদের আয় ধরে এই সমীকরণ মেলানোর কথা আর বললাম না—সেটার হিসাব আপনি মেলাতে পারবেন না।

প্রতিদিন টেলিভিশনের খবরে একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশ জুড়ে থাকে দ্রব্যমূল্যের হ্রাসবৃদ্ধির খবর আর বাজারে বাজারে ভোক্তা অধিকার কর্মকর্তাদের তৎপরতা ও কোনো দোকানদারকে কত টাকা জরিমানা করা হয়েছে সেইসব খবর। পাশাপাশি আরেকটা খবরও আসে মাঝে মাঝে—টিসিবি ট্রাকে করে নিত্যপ্রয়োজনীয় কয়েকটা পণ্য ন্যায্যমূল্যে বিক্রি করছে আর সেইসব ট্র্যাকের সামনে ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করছে মধ্যবিত্ত, নিম্নমধ্যবিত্ত ও দরিদ্র মানুষ। এইরকম পরিস্থিতি কোনো দেশের শাসকদের জন্যে বা ক্ষমতাসীন রাজনীতিবিদদের জন্যে সুখকর বা স্বস্তিদায়ক নয়।  

বাংলাদেশে এখন যারা রাষ্ট্রক্ষমতায় আছেন ওরা, ওদের ভাষায় একটা বিপ্লবের মাধ্যমে ক্ষমতা গ্রহণ করেছেন এবং সরকারটির ধরন হচ্ছে ‘অন্তর্বর্তীকালীন’ সরকার। রক্তক্ষয়ী এক আন্দোলনে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সরকারকে হটিয়ে এরা ক্ষমতায় বসেছে। ক্ষমতায় বসে এরা নানা জাতীয় ইস্যুতে আওয়ামী লীগের অনুসৃত নীতির উল্টো নীতি গ্রহণ করেছে বটে, কিন্তু অর্থনৈতিক নীতির প্রশ্নে আগের সরকারের অনুসৃত নীতির কোনো পরিবর্তন এরা করেনি।

নিত্যপণ্যের জন্য একটা আইন আছে, সেই আইনে সরকারকে ক্ষমতা দেওয়া আছে, কোনো পণ্যকে নিত্যপণ্য হিসেবে ঘোষণা করে সেটার মূল্য নির্ধারণ করে দেওয়া...

আওয়ামী লীগ ওদের বাজার নিয়ন্ত্রণের নীতি পাল্টে দলীয়ভাবে বাজার অর্থনীতির নীতি গ্রহণ করেছে আরও আগে। সরকারে গিয়ে ওরা সেই নীতিই অনুসরণ করেছে—বাজারে সরকারি হস্তক্ষেপ করা থেকে বিরত থেকেছে। আইডিয়াটা হচ্ছে যে, বাজারের অদৃশ্য হাতই নিয়ন্ত্রণ করবে দ্রব্যমূল্য। এর ফলাফল আমরা হাতেনাতে পেয়েছি, আওয়ামী লীগের শাসনামলে দ্রব্যমূল্য কখনোই নিয়ন্ত্রণে ছিল না, শ্রমজীবী মানুষদের তো বটেই, মধ্যবিত্তকেও ভুগতে হয়েছে প্রায় পুরো আওয়ামী লীগের শাসনামল।

এখন আওয়ামী লীগ চলে গেছে, বাজারে কোনো ইতিবাচক পরিবেশ তো আসেইনি, উল্টো বাজারের সব পণ্যের দাম বেড়েছে অস্বাভাবিকভাবে। কাঁচা মরিচের দাম, ডিমের দাম আর ইলিশ মাছের দাম নিয়ে সমাজে চালু হয়েছে নানাপ্রকার কৌতুক ও ঠাট্টা তামাশা।

এই সরকারও আওয়ামী লীগ সরকার যা যা করেছিল ঠিক তারই পুনরাবৃত্তি করছে। এরা বাড়তি যেটা করছে সেটা হচ্ছে বিগত আওয়ামী লীগ সরকারকে দোষারোপ করছে, দাবি করছে যে আওয়ামী লীগের সহচররাই নাকি সিন্ডিকেট বানিয়ে দ্রব্যমূল্য বাড়িয়ে চলেছে ইত্যাদি। রুটিন হিসেবে এরা ভোক্তা অধিকার কর্মকর্তাদের বাজারে পাঠাচ্ছে, সেইসব কর্মকর্তারা গিয়ে হতভাগা খুচরা বিক্রেতাদের ওপর হম্বিতম্বি করছে আর ধরে ধরে জরিমানা করছে।

ঠিক কী কারণে যে ভোক্তা অধিকারের ম্যাজিস্ট্রেটরা জরিমানা করছে সেটাও ঠিক স্পষ্ট নয়। ভোক্তা অধিকার আইনে ঐসব কর্মকর্তাদের বা ম্যাজিস্ট্রেটদের দ্রব্যমূল্য নির্ধারণের কোনো ক্ষমতা দেওয়া হয়নি বা দোকানদার কত লাভ করছে সেটা দেখার ক্ষমতা দেওয়া হয়নি।

কোনো পণ্যের গায়ে যদি খুচরা মূল্য লেখা থাকে তবে তার চেয়ে বেশি দামে সেই পণ্যটি বিক্রি করা অপরাধ। যেমন টুথপেস্ট বা সাবানের গায়ে দাম লেখা থাকে, সেই দামের বেশি বিক্রি করা যাবে না। কিন্তু সবজি বাজারের ক্ষেত্রে তা কীভাবে কার্যকর হবে? সবজি বাজারের গায়ে তো নির্ধারিত দাম নেই।

আরেকটা ক্ষেত্র আছে। নিত্যপণ্যের জন্য একটা আইন আছে, সেই আইনে সরকারকে ক্ষমতা দেওয়া আছে, কোনো পণ্যকে নিত্যপণ্য হিসেবে ঘোষণা করে সেটার মূল্য নির্ধারণ করে দেওয়া। সেটা একটা বিশেষ প্রক্রিয়া। ঐ যে পশুসম্পদ মন্ত্রণালয় বা অন্য কোনো মন্ত্রণালয় কোনো কোনো পণ্যের দাম ঘোষণা করে, সেগুলো এসেনশিয়াল কমোডিটি আইনের অধীনে মূল্য নির্ধারণ নয়—সেগুলো এমনিই একটা অনুশীলন, যেটা কেউ মানতে বাধ্য নয়।

এর মানে হলো, টেলিভিশনে খবরে দেখায় যে দোকানদাররা নির্ধারিত মূল্যের চেয়ে বেশি দামে ডিম বিক্রি করছে, এটা একটা বাজে কথা। আইনগতভাবে ডিমের কোনো নির্ধারিত মূল্য নেই, সুতরাং খুচরা বিক্রেতা যত দামেই বিক্রি করুক না কেন সেটা তো আর ‘নির্ধারিত মূল্যের’ চেয়ে কম বা বেশি হতে পারে না। যেখানে নির্ধারিত মূল্যই নেই সেখানে আবার কমই কী বা বেশিইবা কী!

ভোক্তা অধিকার কর্মকর্তারাদের কাজ হচ্ছে যেসব পণ্যের এমআরপি আছে সেটা যেন এমআরপির চেয়ে বেশি দামে বিক্রি না হয়, ভেজাল দেখা বা এইরকম কয়েকটা কাজ। দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ ভোক্তা অধিকার অধিদপ্তরের কাজ মোটেই নয়।

তাহলে সরকার কেন ভোক্তা অধিকার অধিদপ্তরের ম্যাজিস্ট্রেটদের বাজারে পাঠায়? অনুমান করি সরকার এটা করে ভয় দেখিয়ে খুচরা বিক্রেতাদের লাভটুকু কমিয়ে রাখতে আর মানুষকে দেখানোর জন্য যে আমরা একটা কিছু করছি। না হয় ম্যাজিস্ট্রেট পাঠিয়ে যে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ করা যায় না সেই কথাটা এই সরকারের প্রধান এবং উপদেষ্টারা তো সবারই জানার কথা।

দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে রাখতে হলে বাজারে সরকারকে হস্তক্ষেপ করতে হবে, বাজারে সরকারকে অংশগ্রহণ করতে হবে—মোদ্দা কথা, তথাকথিত অদৃশ্য হাতের কাছে বাজার ছেড়ে দিলে হবে না বা বাজার অর্থনীতি অনুসরণ করা যাবে না।

এরা সবাই কিনা বেশ উচ্চডিগ্রি সম্পন্ন, কয়েকজন আছেন আবার উকিল। এরা এই মৌলিক বিষয়টা জানবেন না সে কথা তো আমাকে বলেও বিশ্বাস করাতে পারবেন না। আমি নিশ্চিত যে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে রাখতে হলে কী করতে হবে সেকথা সরকারের লোকজনও অতি উত্তমরূপে জানেন।

দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে রাখতে হলে বাজারে সরকারকে হস্তক্ষেপ করতে হবে, বাজারে সরকারকে অংশগ্রহণ করতে হবে—মোদ্দা কথা, তথাকথিত অদৃশ্য হাতের কাছে বাজার ছেড়ে দিলে হবে না বা বাজার অর্থনীতি অনুসরণ করা যাবে না। কিন্তু এরা সেইসব কিছুই করবে না। কেননা নীতি হিসেবে এরা তো বাজার অর্থনীতিকে গ্রহণ করেছে, সেই থেকে শেখ হাসিনাও সরেননি, বর্তমান সরকারও সরবে না।

কৌতুক যেটা বলেছি সেটা ঠিক আমাদের বর্তমান অবস্থার সাথে পুরোপুরি মেলে না। তবে কেন কৌতুকটা বললাম? কেননা টিসিবির ট্রাকের সামনে মানুষের ভিড় আর লম্বা লাইন দেখে পুরোনো কৌতুকটা মনে পড়লো। দ্রব্যমূল্য এবং পণ্যের সরবরাহ ঠিক রাখা এটা একটা রাজনৈতিক প্রশ্ন। সরকার যদি কট্টর বাজার অর্থনীতিপন্থি হয়, তাহলে ওরা কখনোই বাজার নিয়ন্ত্রণ করবে না—তার জন্য চাই সেইরকম সরকার। আরেকটা ব্যাপারও আছে, এমনকি মুক্ত বাজার অর্থনীতিতেও দ্রব্যমূল্য হয়তো খানিকটা নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়, কিন্তু সেজন্য যেটুকু দক্ষতা প্রয়োজন তা আমাদের রাজনীতিবিদদের মধ্যে নেই।

তাহলে কি দ্রব্যমূল্য এইরকমই থাকবে? সম্ভবত তাইই থাকবে, যদি না আসলেই কোনো মৌলিক রাজনৈতিক পরিবর্তন এর মধ্যে হয়। হয়তো কোনোদিন ট্র্যাকের সামনের ভিড়ের চেয়ে সমাজ বদলের লড়াইয়ে ভিড় বড় হবে, তখন যদি কোনো আশার কথা শোনানো যায়।      

ইমতিয়াজ মাহমুদ ।। আইনজীবী, সুপ্রিম কোর্ট