ছবি : সংগৃহীত

‘দানা’ নামটি শুনলেই আমাদের অতি পরিচিত দানাপানির কথা মনে হয়। কিন্তু এই ‘দানা’ সেই দানা নয়। এই দানা কাতারের দানা। বলছি ঘূর্ণিঝড় ‘দানা’-র কথা। এ বছরের মে মাসে ঘূর্ণিঝড় ‘রেমাল’ আঘাত হেনেছিল বাংলাদেশসহ পশ্চিমবঙ্গের বেশকিছু জায়গায়। ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল লক্ষাধিক মানুষের। বাতিল হয়েছিল বিমানের বিভিন্ন দেশের ফ্লাইট। ঘূর্ণিঝড়ের প্রস্তুতি, সহায়তা ও ক্ষয়ক্ষতি মোকাবিলায় বিভিন্ন সরকারি বেসরকারি অফিসের ছুটি বাতিল করা হয়েছিল।

রেমালের মতোই আরেকটি ঘূর্ণিঝড় ‘দানা’। আবহাওয়া অধিদপ্তরের তথ্যমতে, ২৪ অক্টোবর ২০২৪ দিবাগত রাতে এটি প্রবল ঘূর্ণিঝড়ে রূপ নেবে। উপকূলে আঘাত হানার সময় এর গতিবেগ ঘণ্টায় ১২০ কিলোমিটার হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

আনন্দবাজার পত্রিকার তথ্যমতে, ঘূর্ণিঝড় ‘দানা’র প্রভাবে ভারতের ওড়িশার জগৎসিংহপুর, কেন্দ্রাপাড়া, ভদ্রক এবং বালেশ্বরে বাতাসের সর্বোচ্চ গতি ঘণ্টায় ১১০ কিলোমিটার ছাড়িয়ে যেতে পারে। ভারতের আবহাওয়া বিভাগ (আইএমডি) অতি ভারী বৃষ্টির ‘রেড অ্যালার্ট’  জারি করেছে জগৎসিংহপুর, কেন্দ্রাপাড়া, ময়ূরভঞ্জ, কটক, ভদ্রক এবং বালেশ্বরে জারি।

ক্ষয়ক্ষতি সামাল দিতে জেলাগুলোয় অভিজ্ঞ আইএএস অফিসারদের মোতায়েন করা হয়েছে। বিভিন্ন জেলায় মোতায়েন হয়েছে ২৮৮টি উদ্ধারকারী দল। আগামী তিনদিনের জন্য স্কুল-কলেজ বন্ধ রাখার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে পশ্চিমবঙ্গের ১৪টি জেলায়। বাতিল করা হয়েছে দুইশোরও বেশি ট্রেন। পশ্চিমবঙ্গের ৮০০টি দুর্যোগ আশ্রয় শিবিরের পাশাপাশি ৫০০টি অতিরিক্ত শিবির তৈরি করা হয়েছে।

বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, ঘূর্ণিঝড়টি ভারতের ওড়িশা বা পশ্চিমবঙ্গের উপকূলের দিকে অতিক্রম করতে পারে; তবে এর গতিপথও পরিবর্তিত হতে পারে। ঘূর্ণিঝড় ‘দানা’ বাংলাদেশে কতটা ক্ষয়ক্ষতি ঘটাবে সেই বিষয়ে পর্যাপ্ত তথ্য না থাকলেও ধারণা করা হয় বাংলাদেশের উপকূলসহ বিভিন্ন এলাকায় বৃষ্টি হতে পারে। যে কারণে চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, মোংলা ও পায়রা সমুদ্র বন্দরগুলোকে হুঁশিয়ারি সংকেত দেখাতে বলা হয়েছে।

ঘূর্ণিঝড় ‘দানা’-র ক্ষয়ক্ষতি মোকাবিলায় ব্যাপক প্রস্তুতি নিয়েছে বাংলাদেশ সরকার। স্ট্যান্ডিং অর্ডারস অন ডিজাস্টার (এসওডি) অনুযায়ী ‘দানা’ মোকাবিলায় ব্যাপক প্রস্তুতি নিয়েছেন উপকূলীয় জেলার জেলা প্রশাসকরা।

ঘূর্ণিঝড় আসলে কোনো অঞ্চলের সাইক্লোনিক সিস্টেম। বিশ্বের সব দেশেই গ্রীষ্মমণ্ডলীয় ঝড়ের একইভাবে নামকরণের রীতি চালু আছে।

পূর্বপ্রস্তুতি হিসেবে মেডিকেল টিম গঠন করা হয়েছে, প্রস্তুত রাখা হয়েছে ৮৮৫টি আশ্রয়কেন্দ্র এবং সিপিপি ও রেডক্রিসেন্ট স্বেচ্ছাসেবকরাও তৈরি আছেন। মানুষের আশ্রয়ের জন্য ৮২৩টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও ৬২টি সাইক্লোন শেল্টার প্রস্তুত রাখা হয়েছে। প্রস্তুত রয়েছে মেডিকেল টিম, ফায়ার সার্ভিসের উদ্ধারকারী দল।

ঘূর্ণিঝড়টির নামকরণ ‘দানা’ করেছে কাতার। আরবি ভাষার এই শব্দের অর্থ ‘সুন্দর এবং মূল্যবান মুক্তা’। ঘূর্ণিঝড়ের নামকরণ সম্বন্ধে অনেকেরই হয়তো ধারণা নেই। ২০০০ সালের আগে এ অঞ্চলে ঘূর্ণিঝড়ের কোনো নাম দেওয়া হতো না। কিন্তু এরপর থেকে ঝড়ের নামকরণ শুরু হয়।

ঘূর্ণিঝড়ের নাম দেওয়ার রীতি চালু করে ওয়ার্ল্ড মেটেরোলজিক্যাল অর্গানাইজেশন (World Meteorological Organization-WMO) ও ইউনাইটেড নেশনস ইকোনমিক অ্যান্ড সোশ্যাল কমিশন ফর এশিয়ার সদস্য দেশগুলো। ওয়ার্ল্ড মেটেরোলজিক্যাল অর্গানাইজেশন (WMO) অধীন জাতিসংঘের এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের সমুদ্রতীরবর্তী ১৩টি দেশের আবহাওয়াবিদদের সংস্থা এস্কেপ (ESCAP) ঘূর্ণিঝড়ের নাম দিয়ে থাকে।

নাম ঠিক করার সময় বেশকিছু জিনিস মাথায় রাখতে হয় যেমন কোনো গোষ্ঠী বা ধর্মীয় গোষ্ঠীকে আঘাত করে এমন কোনো নাম গৃহীত হবে না। একবার ব্যবহার করা নাম আর ব্যবহার করা যাবে না। প্রতিটি দেশ নাম প্রস্তাব করার সুযোগ পায়। এই ১৩টি দেশের কাছে আগাম পূর্বাভাস ও সতর্কবার্তা পাঠানো হয়।

ঘূর্ণিঝড়কে চিহ্নিত করার জন্যই নামকরণ প্রথা চালু করা হয়েছে। ঘূর্ণিঝড়ের নাম গ্রহণ করা মানুষের পক্ষে মনে রাখা সহজ করে তোলে। এই নামের সাহায্যে প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়া, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিভাগ, গবেষক বিজ্ঞানী ও সাধারণ মানুষরা যেন সহজেই এটিকে চিনতে পারে সে উদ্দেশ্যেই এই নামকরণ। 

নামের মাধ্যমেই বুঝিয়ে দেওয়া হয় এটি একটি আলাদা ঘূর্ণিঝড়। এ ব্যাপারে সচেতনতা বাড়াতে, প্রস্তুতি নিতে, বিভ্রান্তি দূর করতে এই নাম কাজে লাগে। ঘূর্ণিঝড় আসলে কোনো অঞ্চলের সাইক্লোনিক সিস্টেম। বিশ্বের সব দেশেই গ্রীষ্মমণ্ডলীয় ঝড়ের একইভাবে নামকরণের রীতি চালু আছে। ইংরেজি বর্ণমালার ২১টি অক্ষর ব্যবহার করে ঘূর্ণিঝড়ের নামকরণ করা হয়।

শুধুমাত্র কিউ (Q), এক্স (X), ওয়াই (Y) ও জেড (Z)—এই ৫টি অক্ষর বাদ দিয়ে নামকরণ করা হয়। সাধারণত এক বছরের জন্য পর্যায়ক্রমিকভাবে এই নামগুলো প্রস্তাব করা হয়। যদি কোনো বছর ২১টির বেশি ঘূর্ণিঝড় দেখা দেয়, তবে নামগুলোর সঙ্গে গ্রিক বর্ণমালা যুক্ত করে নামকরণ করা হয়।

২০০০ সালে ওমানের মাস্কাটে অনুষ্ঠিত হয়, পিটিসি (PTC/USER Global Summit)-এর ২৭তম অধিবেশন। পিটিসি বঙ্গোপসাগর এবং আরব সাগরে গ্রীষ্মমণ্ডলীয় ঘূর্ণিঝড়ের নাম ঠিক করতে রাজি হয়। প্যানেলের প্রতিটি দেশ তাদের সুপারিশ পাঠানোর পর, পিটিসি তার তালিকা তৈরি করে। তারপর ২০০৪ সালে এই অঞ্চলে ঘূর্ণিঝড়ের নামকরণ শুরু করে। পিটিসি ২০১৮ সালে, ইরান, কাতার, সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরশাহি এবং ইয়েমেনকেও তাদের সংগঠনভুক্ত করে।

২০২০ সালের এপ্রিলে, ১৬৯টি ঘূর্ণিঝড়ের নামের তালিকা প্রকাশিত হয়েছিল। সদস্য ১৩টি দেশের প্রত্যেক সদস্য ১৩টি করে নাম প্রস্তাব করেছিল। সেই তালিকা থেকেই বর্তমানে ঘূর্ণিঝড়ের নামকরণ করা হচ্ছে। কোন দেশে এই ঘূর্ণিঝড় তৈরি হয়েছে বা আঘাত হানবে তার ওপর নামকরণ বিবেচনা করা হয় না।

শুধুমাত্র কিউ (Q), এক্স (X), ওয়াই (Y) ও জেড (Z)—এই ৫টি অক্ষর বাদ দিয়ে নামকরণ করা হয়। সাধারণত এক বছরের জন্য পর্যায়ক্রমিকভাবে এই নামগুলো প্রস্তাব করা হয়।

বরং, দেশগুলোর পরপর নাম অনুযায়ী, ঘূর্ণিঝড়ের ক্ষেত্রে তা ব্যবহার করা হয়। যেমন, ঘূর্ণিঝড় ‘নিসর্গ’-র নাম দিয়েছিল বাংলাদেশ। আছড়ে পড়েছিল মহারাষ্ট্রে। ভারত নাম দিয়েছিল ‘গতি’। আছড়ে পড়েছিল সোমালিয়ায়। ইরান নাম দিয়েছিল ‘নিভার’ আর আঘাত হেনেছিল তামিলনাড়ুতে।

‘দানা’-র পর যে ঝড়টি আসবে তার নাম হবে ‘ফেইনজাল’, সেই নামটি দিয়েছে সৌদি আরব। ফেইনজালের পরের ঝড়টির নাম হবে ‘শক্তি’। আর এই নামটি দিয়েছে শ্রীলঙ্কা। শ্রীলঙ্কার পরে থাইল্যান্ডের দেওয়া ঘূর্ণিঝড়ের নাম ‘মন্থ’।

ক্রান্তীয় অঞ্চলের সমুদ্র উপকূলের দেশ হওয়ায় বাংলাদেশে ঘূর্ণিঝড় প্রবণ দেশ। বাংলাদেশের ইতিহাস ঘাটলে দেখা যায় ঘূর্ণিঝড়ের প্রাণহানিও নেহাত কম নয়। প্রাণহানি ছাড়াও ঘূর্ণিঝড়ে উপকূলীয় এলাকার মানুষের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির শিকার হতে হয়।

বাংলাদেশ ও সংলগ্ন বঙ্গোপসাগরের তীরবর্তী এলাকাটির আকৃতি ফানেলের আকৃতি হওয়ার কারণে বঙ্গোপসাগর থেকে সৃষ্ট ঘূর্ণিঝড়ের প্রকোপ বাংলাদেশ ভূখণ্ডের সমুদ্র তীরবর্তী জেলা; কক্সবাজার, চট্টগ্রাম, নোয়াখালী, খুলনা, বরিশাল, পটুয়াখালী ও ভোলাতে সবচেয়ে বেশি।

ইতিমধ্যে ঘূর্ণিঝড় ‘দানা’ বিভিন্ন এলাকায় আঘাত হেনেছে এবং ক্ষয়ক্ষতিও হয়েছে তবে প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলায় বাংলাদেশ অনেকটাই সফলতা অর্জন করেছে। বাংলাদেশের ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয় ও আবহাওয়া অধিদপ্তরের আর্থিক জোগান ও সক্ষমতা অনেক বেড়েছে। তাই আগে অনেক ক্ষয়ক্ষতি হলেও, কয়েক দশক ধরে ঝড় জলোচ্ছ্বাস ও অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগ বা ঘূর্ণিঝড়ে প্রাণহানি এবং ক্ষয়ক্ষতি পরিমাণ কমে এসেছে। তবে মাঝে মাঝেই অপ্রতিরোধ্য প্রকৃতির কাছে হার মেনে যায় মানুষ।

পাহাড়ি ঢল, বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস ও বজ্রপাতসহ নানা ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলায় আমাদের দেশে মাল্টিপারপাস সেল্টার সেন্টার স্থাপন করা প্রয়োজন। যেকোনো প্রাকৃতিক বা মনুষ্য সৃষ্টি দুর্যোগে এইসব শেল্টার সেন্টার সাপোর্ট সেন্টার হিসেবে কাজে লাগতে পারে।

ড. কবিরুল বাশার ।। অধ্যাপক, গবেষক, প্রাণিবিদ্যা বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
professorkabirul@gmail.com